Ajker Patrika

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায়

মো. ইকবাল হোসেন 
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৪: ৫৮
Thumbnail image

কোষ্ঠকাঠিন্য শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। অনেকের জন্যই এটি এক ভয়ানক বাস্তবতা। শরীর তো বটেই, মনের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কিন্তু সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণ দিয়ে অনায়াসে এ থেকে মুক্ত থাকা যায়। 

কোষ্ঠকাঠিন্য কী
যখন কোনো ব্যক্তি সহজে মলত্যাগ করতে সক্ষম হন না, সাধারণত এক থেকে দুই দিন পরপর মলত্যাগ করেন এবং মল শুষ্ক ও শক্ত হয়, সে অবস্থাকেই কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়। চিকিৎসকদের মতে, কারও যদি প্রতি সপ্তাহে তিনবারের কম পায়খানা হয়, সে অবস্থাই কোষ্ঠকাঠিন্য।

কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকতে সব ধরনের আঁশযুক্ত শাকসবজি খেতে হবেকারা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগেন
যেকোনো মানুষেরই কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। তবে বয়স্ক মানুষেরা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন। পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগার হার বেশি লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া যাঁদের ওজন বেশি, অলস জীবনযাপন করেন, তাঁদেরও কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগার ঝুঁকি থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় নারীদের কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। শিশু যখন বুকের দুধের পাশাপাশি নতুন খাবারে অভ্যস্ত হয়, তখন তাঁরও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। কম আঁশযুক্ত খাবার ও পানি কম খেলে যেকোনো মানুষেরই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। 

কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়
খাবার খাওয়ার পর সেগুলো প্রথমে আমাদের পাকস্থলীতে পৌঁছায়। পরে ক্ষুদ্রান্ত্রে কাইম হিসেবে অবস্থান করে। পরবর্তী সময়ে এই কাইম বৃহদন্ত্রে প্রবেশ করে। খাবারে আঁশের পরিমাণ কম থাকলে বৃহদন্ত্র খাবার থেকে পানি শোষণ করে। ফলে মল শুষ্ক ও শক্ত হয়ে যায়। বৃহদন্ত্রের চারটি অংশ আছে। তার মধ্যে সিগময়েডে সবচেয়ে বেশি ও শেষবারের মতো পানি শোষিত হয়। তাই মল যখন বের হয়, তখন প্রথম অংশের মলটুকু তুলনামূলক বেশি শুষ্ক ও শক্ত হয়। মল বৃহদন্ত্রে যত বেশি সময় থাকবে, তত বেশি পানি শোষিত হবে এবং মল বেশি শুষ্ক ও শক্ত হবে।  

এ ছাড়া কিছু ওষুধকে কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য দায়ী মনে করা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, আয়রন বা ক্যালসিয়াম-জাতীয় ওষুধ সেবনে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি বাড়ে।  

পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খেতে হবেজটিলতা
কোষ্ঠকাঠিন্য এক থেকে তিন মাসের বেশি স্থায়ী ও ঘনঘন হলে যা হয়—

  • পায়খানার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাইলস, অ্যানাল ফিশার, মলদ্বার বের হয়ে আসা, পেট ফাঁপা, অরুচির মতো কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে।  
  • রক্তস্বল্পতা, অবসাদ, অনিদ্রা, চোখে ব্যথা, চোখের নিচে কালি পড়া, মাথা ঘোরা, কোমরে ব্যথা, আলসেমি বৃদ্ধি পাওয়া ও মনোযোগ কমে পাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়।  
  • কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা যত দীর্ঘ হয়, রোগী তত বেশি দুর্বল ও হীনম্মন্য হয়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে চুলকানি, মুখে ঘা, মেচতার মতো সমস্যাও হতে পারে।  
  • রোগীর মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ফলে রোগী মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। 

খোসাসহ গোটা ফলে যথেষ্ট পরিমাণে আঁশ থাকেকোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে কিছু পরামর্শ
কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার জন্য মূলত আমাদের অসচেতনতাই দায়ী। আমরা আঁশযুক্ত খাবারগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে খাই না। মাছ, মাংস, ফাস্টফুড—এগুলোতে মানুষ বেশি আকৃষ্ট হয়। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের প্রতি বেশি সচেতন হতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে। তাহলেই আমরা খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত খাদ্য-আঁশ পাব। এই খাদ্য-আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।  

আমরা অলস জীবনযাপন বেশি উপভোগ করি, যা মোটেও উচিত নয়। সারা দিনে একটু শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। একটা কথা বিবেচনায় রাখতে হবে, আপনি শরীরকে যত বেশি সুখ দিতে চাইবেন, শরীরে অসুখের পরিমাণ তত বেড়ে যাবে। তাই প্রতিদিন একবেলা শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের অভ্যাস করুন। 

কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ

  • মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা
  • অনেকক্ষণ শুয়ে-বসে থাকা, শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস না থাকা
  • যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও তরল পান না করা
  • নিয়মিত ফাইবার বা আঁশ সমৃদ্ধ শাকসবজি ও মৌসুমি ফল না খাওয়া
  • নিয়মিত সঠিক ঘুম না হওয়া
  • চা-কফি, ফাস্টফুড, ভাজাপোড়াজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া 

গরু বা খাসির মাংস এড়িয়ে চললে কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে থাকবেকোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে যে খাবারগুলো উপকারী
কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সঠিক খাবার ব্যবস্থাপনাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। আঁশসমৃদ্ধ যেকোনো খাবারই কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রধান ভূমিকা পালন করে।  

  • খোসাসহ গোটা ফলে যথেষ্ট পরিমাণে আঁশ বা ফাইবার থাকে। যেমন আপেল, পেয়ারা, নাসপাতি, আঙুর ইত্যাদি। 
  • পাকা পেঁপে, পাকা বেলের শরবত, অ্যালোভেরা জুস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ওষুধের মতো কাজ করে। 
  • সব ধরনের শাক বেশি বেশি খেতে হবে। যেমন পুঁইশাক, পালংশাক, লালশাক, কচুশাক ইত্যাদি। 
  • সবজির মধ্যে ঢ্যাঁড়স, পেঁপে, ফুলকপি, পাতা কপি, কচুর লতি বেশ উপকারী। 
  • বৃহদন্ত্রে মলের চলাচল বাড়াতে হবে। সে জন্য নন স্টার্চ আঁশসমৃদ্ধ শাকসবজি ও বিভিন্ন ফল পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে।  
  • দিনে দু-তিনবার তোকমাদানা, ইসবগুলের ভুসি বা চিয়া সিড অথবা অ্যালোভেরা খাওয়া খুব উপকারী। 
  • ঘনঘন পরিমিত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সেই সঙ্গে পানির চেয়ে গাঢ়, যেমন মধু, টকদই, বেলের শরবত, পেঁপের শরবত, অ্যালোভেরা জুস, আখের রস ইত্যাদির মতো তরল পান করতে হবে। এর ফলে বৃহদন্ত্রে অন্তঃঅভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় মল শরীর থেকে পানি শোষণ করে নিজে নরম থাকবে। 
  • আয়রন ও ক্যালসিয়াম-জাতীয় ওষুধ সেবন বন্ধ করে আয়রন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। 

ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবেকোষ্ঠকাঠিন্য রোধে যেসব খাবার বাদ দেবেন
সঠিক খাদ্যাভ্যাসই যেহেতু কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে প্রধান চিকিৎসা, তাই খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। যে খাবারগুলো বাদ দেবেন—

  • কম আঁশযুক্ত খাবার যেমন কাচাকলা, ময়দার তৈরি খাবার ইত্যাদি। 
  • চা-কফি, পিৎজা, ফাস্ট ফুড, চিপস, চকলেট, তেলে ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া যাবে না। 
  • গরু বা খাসির মাংস এড়িয়ে চলতে হবে।  
  • রান্নায় মসলার পরিমাণ কমাতে হবে। ভাজি বা ভুনা খাবারের বদলে কম মসলাযুক্ত খাবার খেতে হবে।  
  • কিছু শুকনো খাবার বাদ দিতে হবে। যেমন, মুড়ি, চিড়া, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট ইত্যাদি। 
  • নুডলস-পাস্তা জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। 

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে ডিম সেদ্ধ খাওয়া যাবে কি? 
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে অবশ্যই সিদ্ধ ডিম খাওয়া যাবে। তবে সিদ্ধ ডিম কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে কোনো বিশেষ ভূমিকা পালন করে না। কারণ, ডিমে আঁশের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। আবার সেদ্ধ ডিমের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের কোনো অবনতিও হয় না। তাই সুষম খাবারে প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় সেদ্ধ ডিম রাখাই যায়। 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যায়াম
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে শারীরিক ব্যায়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন মাঝারি গতিতে হাঁটতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাইকেলও চালানো যেতে পারে। অথবা ঘরে যোগ ব্যায়ামও করা যেতে পারে। তবে একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে, ব্যায়ামের কারণে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে যে পানি বের হয়ে যাবে, সেটা পূরণ করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। 

চা-কফির মতো খাবার এড়িয়ে চললে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত থাকা যাবেকোষ্ঠকাঠিন্য হলে চিকিৎসা

  • মানসিক চাপ কমাতে হবে এবং রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। 
  • প্রতিদিন একবেলা শরীর চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।  
  • ধূমপান বা তামাক দিয়ে তৈরি কোনো কিছু সেবন করা যাবে না।  
  • ঘনঘন পানি ও অন্যান্য উপকারী তরল পান করতে হবে। 
  • অধিক আঁশসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। সে ক্ষেত্রে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে একটি সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।  
  • প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে হবে।  

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে রোগীর পরীক্ষা
কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। সে ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা দেওয়া হয় হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দেখার জন্য। অনেক সময় মলের সঙ্গে খুব সামান্য রক্ত বেরিয়ে যায়, যেটা রোগী বুঝতে পারে না। সে ক্ষেত্রে মলের সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে কি না, সেটা দেখার জন্য পরীক্ষা করাতে হবে। থাইরয়েড হরমোনসহ ডায়াবেটিস পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে কখনো কখনো। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মলদ্বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা বা মলদ্বারের ভেতরে কোনো টিউমার বা কোনো ক্ষত আছে কিনা, তা জানার জন্য কোলোনস্কপি করাতে হবে। এ ছাড়া পেট ব্যথা থাকলে আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে হবে। 

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে সুষম খাবারে প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাদ্যতালিকায় সেদ্ধ ডিম রাখা যাবেকোষ্ঠকাঠিন্য হলে কখন চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে
কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে সঠিক খাদ্যাভ্যাস। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাসের পরও যদি কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘস্থায়ী হয়, পেট ফাঁপা থাকে, শারীরিক দুর্বলতা থাকে, মলের সঙ্গে রক্ত যায় এবং মলদ্বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন দেরি না করে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, মলদ্বার দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষতিগ্রস্ত থাকলে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। 

লেখক: পুষ্টিবিদ ও পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত