মুঈদের স্বপ্নপুরীতে শিশুরা

মুঈদ হাসানের ডাকনাম তড়িৎ। বয়স তিরিশের কোঠায়, অবিবাহিত, বাড়ি টাঙ্গাইল। খ্যাপাটে মানুষ বলে পরিবারের সঙ্গে বনিবনা নেই বহুদিন। কিন্তু নিজের কাজে অটল আছেন তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা পরিষদ ভবনের পাশের রাস্তাটিতে বস্তির শিশুরা খেলাধুলা করে নিয়মিত। পৃথিবীর কোনো কষ্ট, দুঃখ যেন তাদের ছুঁতে পারে না। দিনের বেশির ভাগ সময় তাদের কাটে এই রাস্তার ধুলাবালুতে। ধুলাবালুমাখা খেলাধুলা থাকলেও তাদের নেই লেখাপড়ার সুযোগ। বিষয়টি খানিক ভাবায় তাঁকে। এরপর কিছুদিন কেটে যায়। কিন্তু শিশুদের নিয়ে ‘কিছু একটা করার’ স্বপ্নটা ভেতরে-ভেতরে তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁকে।

সময়টা ২০১১ সালের ১২ জুলাই। পথশিশুদের সুন্দর শৈশবের জন্য কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে মুঈদ হাসান তড়িৎ তৈরি করেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন’। টাঙ্গাইলের ডিস্ট্রিক্ট একুয়ার বস্তিতে শুরু হয় এর প্রথম প্রকল্প ‘স্বপ্নপুরী স্কুল’। শুরুতে ৩৭ শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। সপ্তাহে চার দিন করে ক্লাস নেন সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীরা। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া ১০০ টাকা মাসিক চাঁদায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের বই-খাতাসহ শিক্ষাসামগ্রী কিনে দেওয়া হয়। মাসে এক দিন ভালো খাবার এবং ঈদে নতুন জামাও কিনে দেওয়া হয় ফাউন্ডেশন থেকে।

বর্তমানে টাঙ্গাইলের আশিকপুর বেদেপল্লি, ডিস্ট্রিক্ট একুয়ার বস্তি এবং বোয়ালীতে স্বপ্নপুরী স্কুলের তিনটি শাখা চালু রয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ১৫৮। ঢাকায় এ স্কুল চালু হলেও করোনা এবং আর্থিক সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়। বলে রাখার মতো বিষয় হলো, স্বপ্নপুরী স্কুলটির আট শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।

স্কুলটির সাবেক শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার। চতুর্থ শ্রেণি থেকে তিনি স্বপ্নপুরী স্কুলে পড়েছেন। বাল্যবিবাহের হাত থেকে বাঁচিয়ে তাঁকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয় ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। এখন খাদিজা আক্তার টাঙ্গাইলের সরকারি সাদত কলেজে ইতিহাস বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছেন। কিছুদিন আগে তিনি ডিস্ট্রিক্ট একুয়ার বস্তির স্বপ্নপুরী স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছেন।

শিশুদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনটি বস্তির ৩০টি পরিবারকে স্বনির্ভর করেছে। পরিবারগুলোতে সেলাই মেশিন, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য নগদ অর্থ, ১০০ হাঁসের ছানা কিংবা দুটি করে ছাগল কিনে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ১৩ দুস্থ মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ডিস্ট্রিক্ট একুয়ার বস্তিতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ১০ টাকার বাজার চালু করেছে ফাউন্ডেশনটি। সেখানে বস্তির সবাই ১০ টাকার বিনিময়ে চাল, ডাল, মাছ, মুরগি ও সবজি কিনতে পারে।

মুঈদের এসব পাগলামি দেখে তাঁর বাবা বিরক্ত হয়ে ওঠেন। দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সম্পর্কে। কিন্তু মুঈদ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। নিজস্ব অর্থায়নে টাঙ্গাইলের বোয়ালীতে তিনি গড়ে তুলেছেন স্থায়ী স্বপ্নপুরী স্কুল, স্কুলের পাশে ক্যাফে। লেখাপড়া শেষে শিশুরা সেই ক্যাফেতে কাজ করে নিজেদের খরচ বহন করতে পারবে। পাশাপাশি ক্যাফের লভ্যাংশ দিয়ে স্কুলের যাবতীয় খরচ মেটানো যাবে। শিশু হত্যা ও নির্যাতন বন্ধে সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি দিয়েছেন মুঈদ ও তাঁর ফাউন্ডেশন।

ফাউন্ডেশনটি এখন কাজ করছে ৩০টিরও বেশি প্রকল্প নিয়ে। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মুঈদ বলেন, ‘সাধ্যের মধ্যে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই। যুবকদের সংগঠিত করে কর্মসংস্থান, একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি অনাথ আলয়সহ অনেক কিছুই করার ইচ্ছা আছে।’