Ajker Patrika

ছোটবেলার রঙিন ঈদ

আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২২, ১৫: ৫৭
Thumbnail image

ছেলেটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল

নাসরীন জাহান, কথাসাহিত্যিক

কোরবানির ঈদ নিয়ে আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে আমার আব্বা চাকরি করতেন। আমার নানার বাড়িও হালুয়াঘাটে যেহেতু, তাই আমরা নানার বাড়িতেই থাকতাম তখন। আব্বা বোহিমিয়ান জীবনযাপন করতেন। তাই ধর্ম নিয়ে যেমন কোনো রকম সংস্কার ছিল না, তেমনি ধর্ম বিরোধিতাও ছিল না।

আব্বা ঈদে কোরবানি দিতেন না। কিন্তু যখন নানা বাড়িতে থাকতাম, তখনকার একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। গৃহপালিত পশুর কোরবানি দেওয়ার একটা প্রচলন ছিল গ্রামে। গ্রামের অন্যান্য শিশুর মতোই নানাবাড়িতে যে গরুটি কোরবানির জন্য স্থির করা হয়েছিল, সেই গরুটির সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল।

কোরবানির আগে গরুটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমি তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার চোখ ভিজে উঠেছিল। কী মায়া! গরুটার চোখে। আমার ভেতরটা তোলপাড় করছিল। এখনো ভুলতে পারি না সেই গরুটার কথা।

সেই কোরবানির মাংস আমি খেতে পারিনি। আমার নানার বাড়ি ছিল খান বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে যে রাস্তা তার ওপারে তালুকদার বাড়ি। সারা বছর রেষারেষি চললেও ঈদের দিন দেখতাম দুই বাড়ির লোকজন একসঙ্গে ঈদের মাঠে যাচ্ছে নামাজ পড়তে। কোলাকুলি করে বাড়ি ফিরত। ঈদের আরেকটা জিনিস খুব ভালো লাগত।

ছোটবেলায় রাস্তা পেরিয়ে ঈদগাহ মাঠে গিয়ে যখন দেখতাম ধনী-গরিব-চাকর-মালিক সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে, খুব আনন্দ হতো।

আমাদের বাড়িতে ছিল একটা মেহেদিগাছ। আমিই লাগিয়েছিলাম। ঈদের আগের দিন সেই গাছের পাতা তুলে বেটে সুন্দর করে হাতে পরে নিতাম আর টিপ কাজলে সাজতাম। 
কোরবানির ঈদ নিয়ে আমার আরেকটি খারাপ অভিজ্ঞতা হলো।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমরা হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ শহরে চলে এসেছি। একটি ছেলেকে আমার খুব পছন্দ। কোরবানির দিন ভাবলাম আমাদের বাড়িতে যেহেতু কোরবানি নেই, সেই ফাঁকে যাই ছেলেটির পাড়ায়।

যদি তার দেখা পাই। কাজল, টিপ আর মেহেদি পরা সুন্দর করে সেজে গেলাম ছেলেটির পাড়ায়। ছেলেটির সঙ্গে দেখা হলো। তারপর সে যেটা বলল, তা আমার সেদিন তো বটেই, এখনো কানে বাজে। ‘কোরবানির দিনে ঘুরে বেড়াচ্ছ যে! তোমাদের কোরবানি নেই?’ আমার জীবনে এর চেয়ে বড় অপমান আর নেই। কোরবানির ঈদ সেদিন অপমানে ম্লান হয়েছিল।

আখতার-জাহানঘরে ঘরে মানুষ কোরবানি দিত না 

আখতার জাহান, সাহিত্যিক ও ঢাকাবিষয়ক গবেষক

আমার নিজের চোখে দ্যাখা, ষাইট বচ্ছর আগে বকরি ঈদে বড় মাইনষেগো গরু ভোইস কোরবানি দিত। যাগো আওকাত কম অরা বকরি কোরবানি দিত। বেশির ভাগ মাইনষে বকরি কোরবানি 
দিত বইলা আমরা কোরবানি ঈদেরে বকরি ঈদ ক‌ইতাম।

ওই দিনে এ্যাত ঘরে ঘরে মানুষ কোরবানি দিত না। সব মহল্লায় হাতে গোনা কয়েক ঘরে বড় মাইনষের বাড়িতে কোরবানি অইত। মাগার বকরি ঈদের ইন্তেজাম আর খুশি গরিব, পয়সাআলার ঘরে ঘরে লাইগা যাইত ঈদের দশ দিন আগে চান উঠনের বাদেই।

ঈদের কয়েক দিন আগে থেকাই হুনা যাইত, পাটা খোদাই আলার আওয়াজ। একঘরে পাটা খোদাইআলার ডাক পড়লে আশপাশের ওই চাখলার সবতে পাটা খোদাই করত। বকরি ঈদ সামনে বাটা-কুটা কত কিছু করণ লাগব পাটা না ছিনকায়া (খোদাই) ধার না করলে কি চলে? বাড়ির গেরথানীরা (কর্ত্রী) ছুরি, চাক্কু, বঁটি ধার ক‌ইরা আইনা দিবার লেগা মরদানা গো তাগাদা দিত।

বকরি ঈদের আগের দিন সব ঘরে ঘরে হলদি, মরিচ, আদরক, রসুন আর গরম মসল্লা বাটনের ধুম পড়ত রাইতভর।

যে বাড়িতে কোরবানি অইত, ওই বাড়িতে গরু আইত এক হপ্তা আগে। গরুর গলায় রঙিন কাগজের বা বাদলার মালা পিন্দায়া সাজায়া লিয়া আইত। ঢাকাইয়ারা বেশির ভাগ গরু কিনত রহমতগঞ্জের গনী মিয়ার হাট থেকা—মীর কাদিমের সাদা গরু। মহল্লার সব পোলাপান মহা ব্যস্ত। যে বাড়িতে কোরবানি অইব ওই বাড়ির পোলাপান ছাড়া ভি মহল্লার আর সব ছোট ছোট পোলাপান গরুর খেজমতে লাইগা থাকত দিন রাইত। আর পোলাপানের মধ্যে তকরাল (তর্ক) লাইগা যাইত, কুন বাড়ির কোরবানির গরু কত বড়।

যে বাড়িতে কোরবানি অইত, পয়লাই গরুর পিছলা রান মাইয়া পোলার হৌড় বাড়িতে পাঠায়া দেওনের রেওয়াজ আছিল; যা অহনতক চ‌ইলা আইতাছে। এ্যরবাদে মহল্লার সব বাড়ির ঘরে ঘরে কোরবানির গোশত পৌঁছায়া দিত।

ঈদের দিন কোরবানির অহনের বাদেই, গরিব পয়সাআলা ঘরে ঘরে কোরবানির গোশত রান্ধনের ধুম লাইগা যাইত আর বাতাসে ওই রান্ধা গোশতের খোশবু ছড়ায়া যাইত। ছোট-বড় সবতে লাকড়ির চুলার সামনে বয়া চুলা থেকা গরম-গরম গোশত পেয়ালাতে লিয়া খাওনের ধুম পড়ত। কোরবানির গোশত দিয়া মোগলাই খানা, পয়সাআলা গরিব সব ঘরে ঘরে তৈয়ার করত।

আমাগো ঢাকাইয়াগো ঘরে ঘরে বেশি গোশত কোর্মা রাইন্ধা চর্বিতে ডুবায়া সংরক্ষণের একটা পদ্ধতি আছে, যা বচ্ছরভর রাখন যাইত বড় বড় ডেগ ভ‌ইরা। ওই রান্ধা গোশতের কোর্মা থেকা গোশতের ঝুরি ঢাকাইয়াগো পছন্দের খানা। অরা বকরি ঈদের দুই দিন বাদে থেকা ওই ঝুরি গোশত দিয়া বাকরখানি রুটি তৈয়ার ক‌ইরা খাইত।

পুরান ঢাকার আদি ঢাকাইয়া বাড়ি থেকা বিহান বিয়ালে গোশতের কোর্মা গরমের খোশবু বাইর অয়া তামাম চাখলা মো-মো করত। ওই খোশবুতে মাইনষের জিভ ভ‌ইরা যাইত। ওই গোশতের কোর্মা দিয়া বহুত বাড়িতে মহরমের আশুরার দিন খিচুড়ি রাইন্ধা গরিব-দুঃখীর ভিতরে বাটনের রেওয়াজ আছিল। অহন আর ওই কোর্মা সব বাড়ি ব‌উ-ঝিরা রান্ধবার জানে না। আর রান্ধব কি, অহন তো সব গোশত রাখে ডিপ ফ্রিজে ভইরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত