Ajker Patrika

ইতিহাস বুকে নীলকুঠি

হারুনুর রশিদ, রায়পুরা (নরসিংদী)
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ০৯: ২৯
Thumbnail image

নরসিংদীর রায়পুরায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নীলকুঠি বাসস্ট্যান্ড। এর উত্তর দিকে ৩০০ গজ যেতেই চোখে পড়বে একটি চিমনি। জায়গাটি রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মাহমুদাবাদ নীলকুঠি নামে পরিচিত। মাহমুদাবাদ গ্রামের নামে এ নীলকুঠির নাম রাখা হয়।

নীলকুঠি মিস্ত্রিবাড়ির জয়নাল আবেদিন মিস্ত্রি জানান, তাঁর পূর্বপুরুষদের আদিভূমি ছিল যশোরে। এককালে এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। জনমানবহীন জায়গাটিতে তিনজন ইংরেজ বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁদের নাম জিপি ওয়াইজ, ডব্লিউ ওয়াটস ও জর্জ লেমন। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জাহাজ ভিড়িয়ে কুঠি স্থাপন করেন তাঁরা। নীল উৎপাদনের জন্য তাঁদের দরকার ছিল দক্ষ শ্রমিক। তখন এখানে সে রকম দক্ষ শ্রমিক ছিল না। তাই ইংরেজরা যশোর থেকে একজন দক্ষ মিস্ত্রি নিয়ে আসেন। তাঁর নাম ছিল মনোহর মিস্ত্রি। তাঁর হাত ধরেই এ অঞ্চলের নীল উৎপাদন শুরু। পরে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেই মনোহর মিস্ত্রি থেকে আজকের এই মিস্ত্রিবাড়ি।

পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদতীরবর্তী মিস্ত্রিবাড়িতে অবস্থিত এ নীলকুঠির চিমনি। এ চিমনি দেখলেই আপনার মনে পড়ে যাবে নীল চাষ নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের এক রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, বেলাব উপজেলার নীলক্ষা, রায়পুরার বটতলী, মির্জানগর, হাইরমারা, চরসুবুদ্ধি, আগারনগর, মাহমুদাবাদ ও দৌলতকান্দি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তখন নীল চাষ হতো। নীল উদ্ভিদটির প্রাপ্তবয়স্ক পাতার অংশবিশেষ কেটে বড়সড় পাত্রে ভিজিয়ে রাখা হতো। তারপর পানি ছেঁকে আরেকটি পাত্রে ঢালা হতো। তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হতো নীল রং। এই পুরো প্রক্রিয়ায় বড় বড় চুল্লির ছিল বিশেষ অবদান। অনুমান করা যায়, আগুনে নীল যখন বাষ্পীভূত হতো, তখন চিমনির মুখ দিয়ে উড়ে যেত সাদা ধোঁয়া! সে ধোঁয়া ছিল ইংরেজদের ক্ষমতা আর অর্থের দাপটের চিহ্ন।

নীল চাষ করতে না চাইলেও নীলকরদের দাদনে আটকে যেতেন কৃষকেরা। কোনো কোনো সময় তাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়েও পালাতেন। তখন নীলকররা কৃষকদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতেন। ইংরেজরা কখনো কখনো তাঁদের পেছনে লাঠিয়াল বাহিনী লেলিয়ে দিত। কোনো কোনো বিদ্রোহী কৃষককে জ্বলন্ত চুল্লিতে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে।

ভারত উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা চলে গেছে আজ বহুদিন হলো। তারপর পুরো ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে দুই ভাগে। তারও পরে এক ভাগ থেকে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু থেকে গেছে মাহমুদাবাদ নীলকুঠির ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন। পরে এ কুঠির নাম থেকে বাসস্ট্যান্ড ও বাজারের নামকরণ করা হয়। এ বাসস্ট্যান্ড নরসিংদী জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার এবং ভৈরব থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে।

দীর্ঘদিন ধরে চিমনিটি সংরক্ষণের অভাবে অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। এর উচ্চতা প্রায় ৭৫ ফুট এবং প্রস্থ ১০ ফুট। দেয়ালের পুরুত্ব দুই ফুট। চিমনিটির ইটের তৈরি দেওয়ালে অনেক গর্ত।

সাপসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও পাখি সেসব গর্তে বাসা বেঁধেছে।

কুঠির দক্ষিণ দিকে পুরোনো দালানে বাস করেন আবুল কালাম মিস্ত্রি। তিনি জানান, অযত্নে-অবহেলায় চিমনিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর সংরক্ষণে সবার সহযোগিতা দরকার।

স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, চিমনিটি এই অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুঠিটিকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত