Ajker Patrika

গাছের ওপর ৭৩৮ দিন

জাকির হোসেন তপন
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২২, ১২: ৪৫
গাছের ওপর ৭৩৮  দিন

পোশাকি নাম জুলিয়া লোরেন হিল। তবে নাম-পদবির মাঝখানের ‘লোরেন’কে বাদ দিয়ে তিনি তাতে ‘বাটারফ্লাই’ বসিয়ে দিয়েছেন। কারণ, আক্ষরিক অর্থেই তাঁর হাতে একদিন একটি প্রজাপতি বসেছিল। তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর!

এখন তিনি জুলিয়া বাটারফ্লাই হিল নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। জুলিয়ার জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪।

আমেরিকার মিসৌরির বাসিন্দা জুলিয়া। সাত বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে এক দিনের সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর হাতের আঙুলে একটি প্রজাপতি এসে বসে। গোটা সফরে সেটি নাকি সেখান থেকে নড়েনি। তার পর থেকেই মধ্য নামে ‘বাটারফ্লাই’ বসিয়ে দেন জুলিয়া। আজও তা তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন।

২৩ বছর বয়সে তিনি যে কাজ করেছিলেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। সে সময় একটি প্রাচীন গাছ বাঁচাতে সেই গাছের মগডালে চড়ে বসেছিলেন জুলিয়া। তারপর তাতেই কাটিয়ে দেন একটানা ৭৩৮ দিন! দুই বছরের বেশি সময়ের পরে নিজের দাবি পূরণ করাতে বাধ্য করেন আমেরিকার এক অর্থলোভী সংস্থাকে।

আরও অনেকের মতোই ক্যারিয়ার সচেতন ছিলেন মিসৌরি প্রদেশের মাউন্ট ভার্নন শহরে বেড়ে ওঠা জুলিয়া। ১৬ বছর বয়সে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশন করা থেকে  ম্যানেজারি—একটানা ছুটে চলেছিলেন জুলিয়া।

মিডল স্কুলে পড়ার সময় একটি দুর্ঘটনায় প্রায় মরতে বসেছিলেন ২২ বছরের জুলিয়া। ১৯৯৬ সালের আগস্টে আরকানসাসের রাস্তায় বন্ধুর পাশে বসে তাঁর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সে সময়ই ওই পথ-দুর্ঘটনা ঘটে। পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা মারে অন্য একটি গাড়ি। সে ধাক্কায় স্টিয়ারিং হুইলটি জুলিয়ার মাথায় ঢুকে যায়। ওই দুর্ঘটনার পর বছরখানেক কথা বলা বা হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন জুলিয়া। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে ওই দুর্ঘটনাটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

জুলিয়া বলেন, ‘সেরে ওঠার পর বুঝতে পারি, আমার গোটা জীবনের ভারসাম্যই তো বিগড়ে যাওয়া...হাইস্কুল থেকে পাস করার পর ১৬ বছর বয়স থেকে একটানা রোজগার করে চলেছি। ক্যারিয়ার, সাফল্য আর সমস্ত পার্থিব বিষয়বস্তুর দিকেই ঝোঁক। ওই গাড়ি দুর্ঘটনা যেন আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল!’

জুলিয়া আরও বলেন, ‘জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই গাড়ি দুর্ঘটনা। ভবিষ্যতে সদর্থক পদক্ষেপের জন্য যা কিছু করতে পারি, তা-ই করার কথা ভেবেছিলাম। যে স্টিয়ারিং হুইলটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, তা যেন আমার জীবনকে নতুন পথে ঘুরিয়ে দিয়েছিল!’

দেড় হাজার বছরের পুরোনো গাছে জুলিয়া
সুস্থ হয়ে ওঠার পর আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান শুরু করেছিলেন জুলিয়া। সে সময় জঙ্গল বাঁচানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজও শুরু করেন। তিনি দেখেছিলেন, হামবোল্ট কাউন্টির রেডউড ফরেস্টে এক বিশাল গাছের নিচে পালা করে বসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। উদ্দেশ্য, আমেরিকার প্যাসিফিক লাগার কোম্পানির (পিসিএল) লোকজন যাতে ক্যালিফোর্নিয়ার ওই রেডউড গাছটি কেটে না ফেলে।

হামবোল্ট কাউন্টির ওই গাছটি এত বিশাল যে স্ট্যাফোর্ড এলাকাটিকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছিল। স্থানীয় লোকজন গাছটিকে ‘স্ট্যাফোর্ড জায়ান্ট’ বলে ডাকত। বাসিন্দাদের দাবি ছিল, পিসিএলের যথেচ্ছ গাছ কাটার জেরেই এলাকায় ভূমিধস দেখা দিয়েছে। তাতে ১৭ ফুট কাদায় ডুবে গিয়েছে গোটা স্ট্যাফোর্ড এলাকা। এটি ১৯৯৬ সালের কথা।

১৮০ ফুট উঁচু প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো ওই গাছটি বাঁচাতে পরিবেশকর্মীরা তখন নানা উপায় নিয়ে ভাবছেন। কোনো একজনকে ওই গাছে উঠিয়ে অবস্থান কর্মসূচির কথাও ভাবা হচ্ছে। জুলিয়া সে সময় কোনো পরিবেশ রক্ষাকারী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বার্থে আর ঘটনাচক্রকে ওই গাছে তিনিই চড়ে বসেছিলেন।

১৯৯৭ সালের ১০ ডিসেম্বর স্ট্যাফোর্ড জায়ান্টে চড়েন জুলিয়া। তাঁর কথায়, ‘গাছে বসার জন্য উপযুক্ত আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে সবাই আমার দিকেই তাকাল, আমাকে পছন্দ করল।’ তারপর প্রকৃতির জন্য এক অসম্ভব ভালোবাসার ইতিহাস রচিত হলো। ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই গাছেই কাটিয়েছিলেন তিনি।

ওই গাছ ‘লুনা’ বলেও পরিচিত। জুলিয়া গাছে চড়ার সময় রাতের আকাশে ছিল উজ্জ্বল চাঁদের আলো। ওই প্রতিবাদকে স্মরণীয় করে রাখতে সে সময় জুলিয়ার আশপাশে থাকা লোকজন ওই গাছের নাম দিয়ে দেন ‘লুনা’, লাতিন ভাষায় তা চাঁদের প্রতিশব্দ। মধ্যরাতে হুকের সঙ্গে রশি বেঁধে জুলিয়া গাছে চড়েন।

দুই বছর ধরে লুনায় ছয় ফুট বাই চার ফুট একটি কাঠের পাটাতনে বসবাস করেছিলেন জুলিয়া। একটি কুকারে রান্নাবান্না বা গাছের ডালেই ব্যায়াম করা অথবা সৌরশক্তিতে নিজের মোবাইল চালু রাখার পদ্ধতিও জেনে নিয়েছিলেন তিনি। স্লিপিং ব্যাগের সঙ্গে নিজেকে দড়িতে বেঁধে তাতেই ঘুমোতেন। জুলিয়াকে খাবার জোগান দেওয়ার আট সদস্যের একটি দলও ছিল।

গাছের ডালে বসেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন জুলিয়া। সেখান থেকেই টেলিভিশন শো করা বা প্রতিবাদে অংশ নেন তিনি। তাঁকে গাছ থেকে হটানোর জন্য পিসিএলের তরফে হেলিকপ্টারে করে লোকজন পাঠানো হতো বলেও অভিযোগ আছে। তবে সে সবে দমেননি জুলিয়া।

জুলিয়ার একরোখা বিক্ষোভের কাছে অবশেষে হার মানে পিসিএল। ১৯৯৯ সালে সংস্থাটি জুলিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়। জুলিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়, লুনার আশপাশের ২০০ ফুট পর্যন্ত কোনো গাছ কাটা চলবে না। এরপর গাছ থেকে নেমে আসতে রাজি হন জুলিয়া।

ওই আন্দোলনের পর জুলিয়ার জীবনেও বদল এসেছে। এখন পর্যন্ত আড়াই শোর বেশি ইভেন্টে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন তিনি। বই লিখেছেন। জড়িয়ে পড়েছেন বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। ‘সার্কল অব লাইফ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়া জানিয়েছেন, পরিবেশ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদল করাই লক্ষ্য তাঁর!

সূত্র: জুলিয়াবাটারফ্লাইহিল ডট কম, ট্রিসিসটারস ডট ওআরজি
লেখক: সংগীতশিল্পী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত