Ajker Patrika

কাগজে এতিম, বাস্তবে নয়

বরগুনা প্রতিনিধি
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২২, ১০: ২৮
Thumbnail image

বরগুনায় মাদ্রাসাছাত্রদের এতিম ও অসহায় দেখিয়ে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। কাগজে–কলমে এতিম দেখানো হলেও বাস্তবে এতিম নয়, এমন শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করে এতিমখানার পরিচালকেরা বরাদ্দের টাকা লোপাট করেছেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তবে জেলা প্রশাসনের দাবি, ভুয়া এতিম দেখিয়ে বরাদ্দ লোপাটের আর সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে প্রকৃত এতিমদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইউসুফ আলীর দেওয়া তথ্য মতে, বরগুনায় সরকারের তালিকাভুক্ত ক্যপিটেশন গ্রান্টপ্রাপ্ত মোট ১২৪টি এতিমখানা রয়েছে। যার মধ্যে এতিম দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ জনকে। ক্যপিটেশন বরাদ্দের অনুকূলে এতিমখানার ৬-১৮ বছর বয়সী এতিম অর্থাৎ পিতৃহীন বা পিতৃমাতৃহীন দরিদ্র শিশুর শতকরা ৫০ ভাগ বরাদ্দের আওতায় আসবে। অর্থাৎ, একটি এতিমখানায় যদি ১০০ শিক্ষার্থী থাকে তবে ৫০ জনের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হবে। একজন এতিমকে মাসে ২ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৬ মাসে ১২ হাজার করে বছরে দুইবারে মোট ২৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে একজন এতিম খাবার বাবদ এক হাজার ৬০০, পোশাক বাবদ ২০০, ওষুধ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২০০ এই তিনটি খাতে মোট ২ হাজার টাকা পায়।

বরগুনা জেলায় এ অর্থ বছরে ২ হাজার ৩৮৮ জন এতিমের অনুকূলে মোট ৫ কোটি ৩১ লাখ ২ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। যার প্রথম কিস্তির ২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ইতিমধ্যে ক্যপিটেশন গ্রান্টপ্রাপ্ত ১২৪টি এতিমখানায় দেওয়া হয়েছে।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার জেলার বেশ কয়েকটি এতিমখানা পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণ এই অর্থ এতিমদের পেছনে খরচ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তাঁর ভিন্ন চিত্র। বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের আঙ্গারপাড়া হাশেমিয়া শিশু সদনে কাগজে–কলমে ৩৮ জন এতিম দেখানো হয়েছে। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে কোনো এতিম নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো রান্নাও হয়নি। নেই কোনো বাবুর্চিও।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সম্প্রতি এতিমখানাটির সাইনবোর্ড পাল্টে আঙ্গারপাড়া হাশেমিয়া শিশু সদনের বদলে রাখা হয়েছে আঙ্গারপাড়া ইসলামিয়া শিশু সদন। সরকারি অর্থের এমন দুর্নীতি লুকাতে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এতিমখানার পরিচালক, এমনটাই জানিয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

আঙ্গারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কবির দফাদার জানান, সরকারি কি অনুদান পায় না পায়, তা আমরা জানি না।

স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘গত ৭–৮ বছরে এখানে আমরা কোনো এতিম শিশু থাকতে দেখিনি। এখানে কাউকে রান্নাও করতে দেখিনি।’

এতিমখানাটির তত্ত্বাবধায়ক দুলাল দফাদারে দাবি, তাঁর এখানে নিয়মিত রান্না হয়, বাবুর্চিও আছেন। তবে কয়েক দিন হলো এতিম শিশুরা বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় আপাতত রান্না বন্ধ রয়েছে।

বরগুনা শহরের মাদ্রাসা সড়কের নেছারিয়া শিশু সদনটিও সরকারের ক্যপিটেশন গ্রান্ট পাওয়া এতিমখানার তালিকাভুক্ত। কাগজে–কলমে এখানে ৪২ জনের অনুকূলে মাসে ৮৪ হাজার আর বছরে ১০ লাখ ৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দারুল উলুম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা লাগোয়া ছাত্রদের হোস্টেলকে সুকৌশলে নেছারিয়া শিশু সদন ও মাদ্রাসাটির সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২ জনকে এতিম দেখিয়ে এখানেও বরাদ্দের সিংহভাগ অর্থ লোপাট করেছেন পরিচালক মামুন–অর-রশীদ। তাঁর সামনেই শিশু সদনের এতিম হিসেবে বরাদ্দ আসা দুজন শিক্ষার্থীর কাছে বাবার নাম ও পেশা জানতে চাওয়া হয়। ওই শিশুদের একজনের বাবা পেশায় মুদি দোকানি ও একজনের বাবা মাছ ধরেন। উভয়েরই মা–বাবা জীবিত আছেন। এমনকি তাদের অনুকূলে বরাদ্দ আসে এমন তথ্যও জানে না শিশুরা।

তবে দারুল উলুম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও নেছারিয়া শিশু সদনের পরিচালক মামুন-অর-রশীদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এতিমখানায় এতিম ও অসহায় শিশু আছে। তাঁদের নিয়মিত খাবার, পোশাক ও ওষুধ কিনে দেওয়া হয়।’

বরগুনা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, ‘এতিমখানায় যে অনিয়ম হয় না এমন না। আমরা ইতিমধ্যে অনেকের ক্যপিটেশন গ্রান্ট বন্ধ করেছি। বাকিদেরও সরেজমিন পরিদর্শন করে, এতিম না পাওয়া গেলে বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বরাদ্দ পাওয়া এতিমখানাগুলো আমরা জরিপ করেছি। ইতিমধ্যে প্রকৃত এতিমদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পরবর্তী বরাদ্দে নিয়মানুযায়ী প্রকৃত এতিম ছাড়া কেউ যাতে বরাদ্দ না পায় সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যারা সরকারি অর্থ লোপাট করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত