Ajker Patrika

পুষ্টিহীনতা প্রকট তৃণমূলে

এস এস শোহান, বাগেরহাট
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২: ০৬
পুষ্টিহীনতা প্রকট তৃণমূলে

বাগেরহাটের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধী, খর্বাকার ও কম ওজনের শিশু জন্ম দিচ্ছেন এসব এলাকার মায়েরা। অল্প বয়সে কর্মক্ষমতা হারানো ও বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার সমস্যা রয়েছে এসব মানুষের মধ্যে, যা জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মা-বাবার মতো পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাতারে থেকে যাচ্ছে এসব শিশু।

সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে প্রতিনিয়ত পুষ্টিহীনতা বাড়ছে এ জেলায়। এর সঙ্গে ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থিক অসচ্ছলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, বাগেরহাট জেলায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ২১ শতাংশ শিশু কম ওজন-সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে। খর্বাকার শিশু রয়েছে ২৭ শতাংশ। এর বাইরে ক্রমেই দুর্বল হওয়ার সমস্যায় রয়েছে ৭ শতাংশ শিশু। সমাজে এসব শিশুই পুষ্টিহীন ও দুর্বল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। এগুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও দৈব্যচয়নের প্রভাব হিসেবে দেখেন অভিভাবকেরা।

জাতীয় পুষ্টিনীতি অনুযায়ী, পুষ্টিজ্ঞান বৃদ্ধি, উত্তম খাদ্যচর্চার প্রসার, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে উৎসাহদান কার্যক্রম পরিচালনার কথা রয়েছে সরকারের। কিন্তু প্রান্তিক এলাকায় সে কার্যক্রম নেই বললেই চলে। মাঠপর্যায়ে পুষ্টিবিদ থাকার কথা থাকলেও, বাগেরহাট জেলায় পুষ্টিবিদের কোনো পদ নেই।

সরেজমিনে শরণখোলা, কচুয়া, রামপাল ও মোংলা উপজেলা ঘুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির।

শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের ভোলারচর, সোনাতলা ও শরণখোলা গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই স্বাভাবিকের থেকে কম উচ্চতার শিশু রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যাও কম নয়। পুষ্টিহীনতায় ভোগা পূর্ণবয়স্ক মানুষও রয়েছেন অনেক পরিবারে; যাঁরা ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সেই সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এসব এলাকার নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টি-সম্পর্কিত তেমন জ্ঞান নেই। জন্মনিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত জ্ঞান বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকেরা। 
ভোলারচর এলাকায় পুষ্টিহীনতায় ভোগা হাজেরা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৩২ বছর; কিন্তু যে কেউ দেখলে আমাকে ৫০ বছর বয়সী নারী বলে মনে করেন। আমার তিনটি বাচ্চাও খুব ছোট।’

হাজেরা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে তেমন ভালো খাবার খেতে পারিনি। না খেয়েও দিন গেছে অনেক। এ কারণে হয়তো এই অবস্থা।’

একই এলাকায় বেড়িবাঁধের পাশে মা-বাবার সঙ্গে থাকে সাত বছর বয়সী শিশু কারিমা আক্তার। এ বয়সেই কারিমার দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। ওজন ও উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। কারিমার পাঁচ বছর বয়সী ছোট ভাই রবিউল ইসলাম কারিমার থেকে খানিকটা লম্বা হলেও, ওজন অনেক কম। ১৬ মাস বয়সী বোন রাহিমা আক্তারও দুর্বল স্বাস্থ্যের।

কারিমার মা মাহিনুর বেগম বলেন, ‘তিনটা বাচ্চাই অসুস্থ। মাতৃত্বকালীন ভাতাও পাই না।’

সোনাতলা ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী কুলসুম আক্তার বলে, ‘আমাদের কোনো শিক্ষক কখনো পুষ্টির বিষয়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরের আলোচনা করেন না।’

শুধু শরণখোলাই নয়, কচুয়ার বিষারখোলা, টেংরাখালী, ফুলতলা, মালিপটন, মোংলার সুন্দরবন, জয়মনি, চাঁদপাই, কানাইনগর, রামপালের হুড়কা, কালেখার বেড়, চাঁদপুর, শঙ্কনগর, গৌরম্বারচর, আধাঘাট, মোরেলগঞ্জ বহরবুনিয়া, উত্তর ফুলহাতা, ঘষিয়াখালী, চিংড়াখালী, জামুয়া, পূর্বচণ্ডিপুর, কামলা, বড়হরিপুর, ছোটহরিপুর, শৈলখালীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় দরিদ্র পরিবারের অনেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।

শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রিয় গোপাল বিশ্বাস বলেন, মারাত্মক পুষ্টিহীন শিশুদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেশির ভাগ অভিভাবক তাঁদের শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে চান না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পুষ্টি-সম্পর্কিত জ্ঞান প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

বাগেরহাটের জেলা পুষ্টি উন্নয়ন কমিটির সদস্যসচিব ও সিভিল সার্জন জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাগেরহাটে পুষ্টিবিদের পদ নেই। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোনো জরিপও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত