কামরুল হাসান
কিছুদিন আগেও মৎস্য ভবনের মোড়ে হাইকোর্টের জমিতে ছিল সড়ক ও জনপথের প্রধান কার্যালয়। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে সেখানে এক ঠিকাদার খুন হয়েছিলেন ঠিকাদারির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধে। সেই খুনের মামলার ফলোআপ করতে গিয়ে কয়েকজন বড় ঠিকাদারের সঙ্গে চেনাজানা হয়। তাঁদেরই একজন একদিন ফোন দিয়ে সড়ক ভবনে আসতে বললেন।
সড়ক ভবনের পেছনের দিকে খুব সুন্দর পরিবেশে একটি ক্যানটিন ছিল, ঠিকাদারেরা সেখানে বসে গল্পগুজব করতেন। তিনিও আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। চা খেতে খেতে বললেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের আড়াই শ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ প্রভাবশালীরা ভাগ করে নিচ্ছেন। এ জন্য নাকি হোটেল ভাড়া নিয়ে ৫-৬ দিন ধরে মিটিং চলছে। এই ভাগাভাগিতে আছেন সরকারি দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য, রয়েছেন বিরোধী দলের ডাকসাইটে নেতাও। আরও আছেন এক শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাঁর অনুরোধ, আমি যেন এ নিয়ে রিপোর্ট করি। কিন্তু সেই রিপোর্টে কোনোভাবেই তাঁকে জড়ানো যাবে না।
ঠিকাদারের এই কথা শুনে আমার প্রথম খটকা লাগল, তিনি নিজে ঠিকাদার হয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারায় অংশ না নিয়ে কেন আমাকে এ তথ্য দিলেন? আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এ ধরনের খবরের তথ্য জোগাড় করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। তা ছাড়া এগুলো সহজে প্রমাণও করা যায় না। একটু খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, এ ঘটনার পেছনে রাজনীতি আছে।
এটা ছিল ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়, যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। ঠিকাদারদের ভেতরেও এখনকার মতো দলীয় মেরুকরণ। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ও যুবদলের ঠিকাদারেরা তখন ছিলেন লাভের গুড়ের পিঁপড়া। আর আমার সোর্স সেই ঠিকাদার যুবলীগ করতেন বলে কিছুটা কোণঠাসা। তিনি চান, টেন্ডার নিয়ে যে সমঝোতা হচ্ছে, তা যেন ফাঁস হয়ে যায়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগে তখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন মাসুদুল হক। তিনি বসতেন সড়ক ভবনের তৃতীয় তলায়। তাঁর কক্ষে গিয়ে পরিচয় দিতেই একথা-সেকথার ফাঁকে কাজ ভাগাভাগির কথা তুলতেই তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সব শুনে আমাকে কোনো সাহায্য করতে রাজি হলেন না। কিন্তু এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রের একটি সেট আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি যখন তাঁর রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন বলছিলেন, …ভাই, আমাকে তো পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমার মনে হলো, তিনি কোনো কারণে খুব ভয় পেয়েছেন।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর রুম থেকে বের হতে হতে মনে হলো, হালে পানি পেলাম। কাগজগুলো এখন ভালো করে পড়তে হবে, এ জন্য নিরাপদ স্থান দরকার। বাইক নিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম পার্কের ভেতরে। পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসেই পড়ে ফেললাম সব নথিপত্র।
এটা ছিল পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম বা সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির কাজ। সংক্ষেপে এ কাজকে বলা হতো ‘পিএমপি’। সে বছর এর আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নকাজের জন্য দরপত্র ডাকা হয়। এ দরপত্রের সবকিছু হয়েছে খুব গোপনে। দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি কোনো সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। শুধু পিএমপির তালিকাভুক্ত ২১৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়ে দরপত্র চাওয়া হয়। এতে ৬৪টি জেলায় ১১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে ২৪৯ কোটি টাকার কাজ করার কথা ছিল।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আমাকে বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর চার বছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগে এটা ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। স্বাভাবিকভাবেই এ কাজ বাগানোর দিকে সবার নজর ছিল। সেই কাজ কবজা করতে শুরু থেকেই নানা ছক কষা হচ্ছিল। তিনি আমাকে বলছিলেন, এর আগে এ ধরনের দরপত্রের ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথের জেলা কার্যালয় থেকেও দরপত্র বিক্রি করা হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা সেটা করতে পারেননি। তিনি ইশারায় যা বললেন তার অর্থ হলো, এতে মন্ত্রী নাজমুল হুদার সায় ছিল। আর ভাগাভাগির বিষয়টি সম্পন্ন না হওয়ায় দরপত্র জমা দেওয়ার তারিখও বাড়াতে হয়। এর মধ্যে ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে, সন্ত্রাসীরা তাদের দরপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। সমঝোতার আগে কেউ যাতে দরপত্র জমা না দিতে পারে, সে জন্য সড়ক ভবনে পাহারা বসানো হয়েছে।
আমি সবকিছু বাদ দিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম, কোথায় সেই বৈঠক হচ্ছে। গুলিস্তানে হোটেল পীর ইয়ামেনি তখন কেবল চালু হয়েছে। প্রথমে গেলাম পীর ইয়ামেনি হোটেলে। সেখানে কিছু নেই। মনে হলো, পূর্বাণীতে হতে পারে। সেখানেও কেউ নেই। আমার ধারণা ছিল, এত মানুষ নিয়ে শেরাটন-সোনারগাঁওয়ে তাঁরা যাবেন না। পল্টন মোড়ের প্রীতম হোটেলের তখন খুব নামডাক। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতেই একজন বললেন, আজাদ হোটেলে বড় পার্টি হচ্ছে। এলাম বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের মুখে পুরানা পল্টনের গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে।
কার্ড বিক্রির প্রতিষ্ঠান আজাদ প্রডাক্টস কিছুদিন আগে এ হোটেল চালু করেছে। প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি একসময় আজাদ প্রডাক্টসের ম্যানেজার ছিলেন। ঝকমকে এই হোটেলের দোতলার বলরুমে ঢুকেই দেখি এলাহি কাণ্ড। শত শত লোক। কেউ কথা বলছেন, কেউ বসে আছেন। সামনে মঞ্চের মতো একটি স্থানে ১৫-২০ জন বসে। মনে হলো সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে সেখানেই।
ভালো করে দেখলাম, এখানে সবাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোক। তাঁরা সবাই যে সবাইকে চেনেন, এমন নয়। চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ কথা শুনলাম। পাশে একজনের কাছে কৌশলে জানতে চাইলাম কী হচ্ছে। তিনি মনে করলেন, আমিও ঠিকাদারের লোক। বললেন, এর আগে ২৪ নভেম্বর (২০০৫) থেকে এ বৈঠক হয়েছে টানা তিন দিন ধরে। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় ২ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় দফার বৈঠক শুরু হয়। ৩ ডিসেম্বর সারা দিন-রাত বৈঠক হয়েছে। ভোরবেলায় সবাই একমত হয়েছেন। দুই দফায় সব লোক এই হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেছেন। রাতে বিএনপির দুজন এমপি হোস্টেলে এসেছিলেন। আমি যাওয়ার একটু আগে এসেছিলেন শেরপুরের তখনকার বিএনপির সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক রুবেল।
এটুকু শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ে গেল। আর বসে না থেকে জনে জনে কথা বলে ছোট ছোট করে তথ্য জোগাড় করতে থাকলাম। একজন বললেন, সমঝোতা বৈঠকের খরচ বাবদ আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করবেন ঠিকাদারদের নেতা শাহাবুদ্দিন বাচ্চু। তবে হোটেলের হলটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ঠিকাদার জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর নামে। টিংকুর তখন পুরানা পল্টন ও মগবাজারে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাঁর সবকিছু দেখভাল করতেন তাঁরই বন্ধু আবদুর রাজ্জাক, যিনি কালা রাজ্জাক নামে বেশি পরিচিত। রাজশাহী বোর্ডে মেধাতালিকায় থাকা বগুড়ার ছেলে এই রাজ্জাক ডাকসু নির্বাচন করেছিলেন।
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। জানতে পারলাম, এর আগে ঠিকাদারেরা সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ কম দরে কাজ করতেন। এই বৈঠকে তাঁরা এক জোট হয়েছেন, সরকারের দেওয়া দরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি দরে দরপত্র জমা দেবেন। আর তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে যাঁরা কাজ পাবেন না, তাঁদের ৭-৮ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। বৈঠকের খরচের জন্য সব ঠিকাদারকে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে।
কারা কত ভাগে পেল, তার একটি হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করে যা শুনলাম তা হলো, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের দল পাঁচটি কাজ পেয়েছে। তারা সে কাজ ৩ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সুব্রত বাইনের তিন ক্যাডার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসে সুব্রত বাইন মোবাইল ফোনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। বিএনপির সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাহমুদুল হক রুবেল, নাদিম মোস্তাফা, আবদুল গফুর ভূঁইয়ার লোকেরাও কাজ পেয়েছেন।
৭ ডিসেম্বর (২০০৫) পত্রিকায় এ নিয়ে বড় নিউজ ছাপা হয়েছিল। সেই রিপোর্টে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, নাদিম মোস্তাফা ও মাহমুদুল হক রুবেলের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তাঁরা সবকিছু অস্বীকার করেছিলেন।
কিছুদিন পরে গেলাম এ রিপোর্টের ফলোআপ করতে। দেখি, দরপত্র জমা দেওয়ার পর কার্যাদেশ দেওয়া হয়ে গেছে। গেলাম সেই প্রকৌশলীর দপ্তরে। তিনি বললেন, ভেতরে যা-ই হোক না কেন, ওপরের সবকিছু হয়েছে আইন মেনেই। তারপর তিনি আক্ষেপ করে বললেন, সাংবাদিক সাহেব, রাজনীতিবিদদের হাত ঈশ্বরের মতো লম্বা, আপনারা তাঁদের টিকিটাও ছুঁতে পারবেন না। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
আরও পড়ুন:
কিছুদিন আগেও মৎস্য ভবনের মোড়ে হাইকোর্টের জমিতে ছিল সড়ক ও জনপথের প্রধান কার্যালয়। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে সেখানে এক ঠিকাদার খুন হয়েছিলেন ঠিকাদারির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধে। সেই খুনের মামলার ফলোআপ করতে গিয়ে কয়েকজন বড় ঠিকাদারের সঙ্গে চেনাজানা হয়। তাঁদেরই একজন একদিন ফোন দিয়ে সড়ক ভবনে আসতে বললেন।
সড়ক ভবনের পেছনের দিকে খুব সুন্দর পরিবেশে একটি ক্যানটিন ছিল, ঠিকাদারেরা সেখানে বসে গল্পগুজব করতেন। তিনিও আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। চা খেতে খেতে বললেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের আড়াই শ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ প্রভাবশালীরা ভাগ করে নিচ্ছেন। এ জন্য নাকি হোটেল ভাড়া নিয়ে ৫-৬ দিন ধরে মিটিং চলছে। এই ভাগাভাগিতে আছেন সরকারি দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য, রয়েছেন বিরোধী দলের ডাকসাইটে নেতাও। আরও আছেন এক শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাঁর অনুরোধ, আমি যেন এ নিয়ে রিপোর্ট করি। কিন্তু সেই রিপোর্টে কোনোভাবেই তাঁকে জড়ানো যাবে না।
ঠিকাদারের এই কথা শুনে আমার প্রথম খটকা লাগল, তিনি নিজে ঠিকাদার হয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারায় অংশ না নিয়ে কেন আমাকে এ তথ্য দিলেন? আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এ ধরনের খবরের তথ্য জোগাড় করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। তা ছাড়া এগুলো সহজে প্রমাণও করা যায় না। একটু খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম, এ ঘটনার পেছনে রাজনীতি আছে।
এটা ছিল ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের ঘটনা। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়, যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। ঠিকাদারদের ভেতরেও এখনকার মতো দলীয় মেরুকরণ। স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ও যুবদলের ঠিকাদারেরা তখন ছিলেন লাভের গুড়ের পিঁপড়া। আর আমার সোর্স সেই ঠিকাদার যুবলীগ করতেন বলে কিছুটা কোণঠাসা। তিনি চান, টেন্ডার নিয়ে যে সমঝোতা হচ্ছে, তা যেন ফাঁস হয়ে যায়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগে তখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন মাসুদুল হক। তিনি বসতেন সড়ক ভবনের তৃতীয় তলায়। তাঁর কক্ষে গিয়ে পরিচয় দিতেই একথা-সেকথার ফাঁকে কাজ ভাগাভাগির কথা তুলতেই তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সব শুনে আমাকে কোনো সাহায্য করতে রাজি হলেন না। কিন্তু এ-সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রের একটি সেট আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি যখন তাঁর রুম থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন বলছিলেন, …ভাই, আমাকে তো পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমার মনে হলো, তিনি কোনো কারণে খুব ভয় পেয়েছেন।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর রুম থেকে বের হতে হতে মনে হলো, হালে পানি পেলাম। কাগজগুলো এখন ভালো করে পড়তে হবে, এ জন্য নিরাপদ স্থান দরকার। বাইক নিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম পার্কের ভেতরে। পার্কের একটি বেঞ্চিতে বসেই পড়ে ফেললাম সব নথিপত্র।
এটা ছিল পিরিয়ডিক মেইনটেন্যান্স প্রোগ্রাম বা সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির কাজ। সংক্ষেপে এ কাজকে বলা হতো ‘পিএমপি’। সে বছর এর আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নকাজের জন্য দরপত্র ডাকা হয়। এ দরপত্রের সবকিছু হয়েছে খুব গোপনে। দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি কোনো সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। শুধু পিএমপির তালিকাভুক্ত ২১৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়ে দরপত্র চাওয়া হয়। এতে ৬৪টি জেলায় ১১২টি প্যাকেজের মাধ্যমে ২৪৯ কোটি টাকার কাজ করার কথা ছিল।
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আমাকে বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর চার বছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগে এটা ছিল সবচেয়ে বড় কাজ। স্বাভাবিকভাবেই এ কাজ বাগানোর দিকে সবার নজর ছিল। সেই কাজ কবজা করতে শুরু থেকেই নানা ছক কষা হচ্ছিল। তিনি আমাকে বলছিলেন, এর আগে এ ধরনের দরপত্রের ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথের জেলা কার্যালয় থেকেও দরপত্র বিক্রি করা হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা সেটা করতে পারেননি। তিনি ইশারায় যা বললেন তার অর্থ হলো, এতে মন্ত্রী নাজমুল হুদার সায় ছিল। আর ভাগাভাগির বিষয়টি সম্পন্ন না হওয়ায় দরপত্র জমা দেওয়ার তারিখও বাড়াতে হয়। এর মধ্যে ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে, সন্ত্রাসীরা তাদের দরপত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। সমঝোতার আগে কেউ যাতে দরপত্র জমা না দিতে পারে, সে জন্য সড়ক ভবনে পাহারা বসানো হয়েছে।
আমি সবকিছু বাদ দিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম, কোথায় সেই বৈঠক হচ্ছে। গুলিস্তানে হোটেল পীর ইয়ামেনি তখন কেবল চালু হয়েছে। প্রথমে গেলাম পীর ইয়ামেনি হোটেলে। সেখানে কিছু নেই। মনে হলো, পূর্বাণীতে হতে পারে। সেখানেও কেউ নেই। আমার ধারণা ছিল, এত মানুষ নিয়ে শেরাটন-সোনারগাঁওয়ে তাঁরা যাবেন না। পল্টন মোড়ের প্রীতম হোটেলের তখন খুব নামডাক। সেখানে গিয়ে খোঁজ করতেই একজন বললেন, আজাদ হোটেলে বড় পার্টি হচ্ছে। এলাম বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের মুখে পুরানা পল্টনের গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলে।
কার্ড বিক্রির প্রতিষ্ঠান আজাদ প্রডাক্টস কিছুদিন আগে এ হোটেল চালু করেছে। প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি একসময় আজাদ প্রডাক্টসের ম্যানেজার ছিলেন। ঝকমকে এই হোটেলের দোতলার বলরুমে ঢুকেই দেখি এলাহি কাণ্ড। শত শত লোক। কেউ কথা বলছেন, কেউ বসে আছেন। সামনে মঞ্চের মতো একটি স্থানে ১৫-২০ জন বসে। মনে হলো সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে সেখানেই।
ভালো করে দেখলাম, এখানে সবাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোক। তাঁরা সবাই যে সবাইকে চেনেন, এমন নয়। চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ কথা শুনলাম। পাশে একজনের কাছে কৌশলে জানতে চাইলাম কী হচ্ছে। তিনি মনে করলেন, আমিও ঠিকাদারের লোক। বললেন, এর আগে ২৪ নভেম্বর (২০০৫) থেকে এ বৈঠক হয়েছে টানা তিন দিন ধরে। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় ২ ডিসেম্বর থেকে দ্বিতীয় দফার বৈঠক শুরু হয়। ৩ ডিসেম্বর সারা দিন-রাত বৈঠক হয়েছে। ভোরবেলায় সবাই একমত হয়েছেন। দুই দফায় সব লোক এই হোটেলে খাওয়াদাওয়া করেছেন। রাতে বিএনপির দুজন এমপি হোস্টেলে এসেছিলেন। আমি যাওয়ার একটু আগে এসেছিলেন শেরপুরের তখনকার বিএনপির সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক রুবেল।
এটুকু শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ে গেল। আর বসে না থেকে জনে জনে কথা বলে ছোট ছোট করে তথ্য জোগাড় করতে থাকলাম। একজন বললেন, সমঝোতা বৈঠকের খরচ বাবদ আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করবেন ঠিকাদারদের নেতা শাহাবুদ্দিন বাচ্চু। তবে হোটেলের হলটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ঠিকাদার জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর নামে। টিংকুর তখন পুরানা পল্টন ও মগবাজারে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাঁর সবকিছু দেখভাল করতেন তাঁরই বন্ধু আবদুর রাজ্জাক, যিনি কালা রাজ্জাক নামে বেশি পরিচিত। রাজশাহী বোর্ডে মেধাতালিকায় থাকা বগুড়ার ছেলে এই রাজ্জাক ডাকসু নির্বাচন করেছিলেন।
বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। জানতে পারলাম, এর আগে ঠিকাদারেরা সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে ২০-২৫ শতাংশ কম দরে কাজ করতেন। এই বৈঠকে তাঁরা এক জোট হয়েছেন, সরকারের দেওয়া দরের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি দরে দরপত্র জমা দেবেন। আর তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে যাঁরা কাজ পাবেন না, তাঁদের ৭-৮ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। বৈঠকের খরচের জন্য সব ঠিকাদারকে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হবে।
কারা কত ভাগে পেল, তার একটি হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করে যা শুনলাম তা হলো, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের দল পাঁচটি কাজ পেয়েছে। তারা সে কাজ ৩ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সুব্রত বাইনের তিন ক্যাডার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসে সুব্রত বাইন মোবাইল ফোনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন। বিএনপির সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মাহমুদুল হক রুবেল, নাদিম মোস্তাফা, আবদুল গফুর ভূঁইয়ার লোকেরাও কাজ পেয়েছেন।
৭ ডিসেম্বর (২০০৫) পত্রিকায় এ নিয়ে বড় নিউজ ছাপা হয়েছিল। সেই রিপোর্টে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, নাদিম মোস্তাফা ও মাহমুদুল হক রুবেলের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তাঁরা সবকিছু অস্বীকার করেছিলেন।
কিছুদিন পরে গেলাম এ রিপোর্টের ফলোআপ করতে। দেখি, দরপত্র জমা দেওয়ার পর কার্যাদেশ দেওয়া হয়ে গেছে। গেলাম সেই প্রকৌশলীর দপ্তরে। তিনি বললেন, ভেতরে যা-ই হোক না কেন, ওপরের সবকিছু হয়েছে আইন মেনেই। তারপর তিনি আক্ষেপ করে বললেন, সাংবাদিক সাহেব, রাজনীতিবিদদের হাত ঈশ্বরের মতো লম্বা, আপনারা তাঁদের টিকিটাও ছুঁতে পারবেন না। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
আরও পড়ুন:
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪