Ajker Patrika

তিনি অধরাই থেকে গেলেন

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ১২
Thumbnail image

লোকটা তাঁর ডান হাতটা টেবিলের ওপর রেখে তর্জনী দিয়ে ঠকঠক করে আওয়াজ করে যাচ্ছেন। কিছুতেই থামছেন না। একটু পরে পাশে রাখা একটি চাবির গোছা হাতে তুলে নিলেন। সেই চাবি দিয়ে টেবিলের ওপর বাড়ি দিচ্ছেন। এবার আওয়াজ আরও একটু বেশি। এ রকম পরিবেশে এসব শব্দ শুনতে খুবই বিশ্রী লাগছে। অগত্যা খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম, এটা কেন করছেন?

লোকটা আমার দিকে তাকালেন; কিন্তু প্রশ্ন শুনে এতটুকু বিরক্ত হলেন না। ফিসফিসিয়ে বললেন, একটা আওয়াজ কানের কাছে ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই তাড়াতে পারছি না।

একটু অবাক হয়ে বললাম, কী বলেন—কিসের আওয়াজ?

তিনি বললেন, আমার মরা ছেলেটার ডাক…আব্বা, আব্বা।

কী বলব, মুখে কথা সরছে না। তিনি যাতে স্বাভাবিক হতে পারেন, সে জন্য আরও কিছু সময় তাঁর সামনে বসে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি শান্ত হলেন। বললেন, কী জানতে চান?

তাঁর নাম এস এম আমিনুর রহীম। পেশায় আইনজীবী। তাঁর স্ত্রী শামসি আরাও একই পেশায়। শ্যামলীর একটি বাসায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল বছর দশেক আগে। কিন্তু বাড়ির নম্বর ঠিক মনে নেই।

এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। ছেলেটিই বড়, নাম শামস রহীম শাম্মাম। মাস্টারমাইন্ড থেকে ও-লেভেল শেষ করে ধানমন্ডির ম্যাপললিফে এ-লেভেলে পড়ছিল। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামে যে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই তালিকায় তাঁর ছেলে শাম্মামও ছিল। ঘটনার দু-তিন দিন পর আমি এসেছিলাম এই পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই বলতে পারলেন না, শুধু কাঁদলেন। তাঁর সেই বুকফাটা কান্না এখনো আমার কানে বাজে।

গত বৃহস্পতিবার ছয় শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার মামলার রায় হয়। কাগজে দেখলাম, ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড আর ১৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ২৫ জন। খালাস বা সাজা পাওয়া সবাই আসলে বরদেশী গ্রামের বাসিন্দা, যাঁরা এক ঘণ্টায় ছয় তরুণকে পিটিয়ে মেরেছিলেন।

সেদিন ওই ঘটনা কাভার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, গ্রামবাসীর বাইরে আরও কেউ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, যিনি চাইলে এই শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা না করে উল্টো তরুণদের পিটিয়ে মারতে জনতার হাতে ঠেলে দিয়েছিলেন। আমি জানি, এই মামলার বিচারে হয়তো তাঁকে অভিযুক্ত করা যায়নি। কারণ, কাউকে অভিযুক্ত করতে সাক্ষ্য-প্রমাণ লাগে। লোকটির ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই হয়েছে। সেই যে প্রবাদে আছে: ‘সত্যি থাকে আইনের পাতায়।’

পিটিয়ে মারার ঘটনা আমি জেনেছিলাম বেশ দেরিতে। পরদিন সকালে। আমার আগে সহকর্মী গোলাম মর্তূজা ও স্থানীয় প্রতিনিধি অরূপ রায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। আমি যখন গেলাম, তখন থানা থেকে লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। বেলাও বেশ বেড়েছে।

ঢাকা থেকে সাভারে যাওয়ার পথে আমিনবাজার সেতুর ওপর থেকে বাঁয়ে তাকালেই চোখে পড়ে ট্রাক টার্মিনাল। এর পেছনে ক্যাবলার চর। এটা আসলে চর নয়, নিচু জায়গা ভরাট করে এই নাম দিয়েছে মানুষ। ট্রাক টার্মিনালের পাশে সরু গলির বসতি, কোনো বড় রাস্তা নেই। এই গ্রামের নামই বরদেশী। একসময় পুলিশের খাতায় গ্রামটির পরিচিতি ছিল ‘ফেনসিডিল কেনাবেচার গ্রাম’ হিসেবে। দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত থেকে আসা ফেনসিডিলের চালান ঢাকায় আসার আগে খালাস হতো বরদেশী গ্রামে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত ঢাকায়।

সেই গ্রামে ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে আল আমিন, শামস রহীম, কামরুজ্জামান কান্ত, সিতার জাবীর মুনির, টিপু সুলতান আর ইব্রাহিম খলিল গিয়েছিল শখ করে ঘুরতে। দলের সবাই ছাত্র। রাত ১টার দিকে তারা রিকশায় দারুসসালাম থেকে পর্বত সিনেমা হলের সামনে নেমে হেঁটে ব্রিজ পার হয়ে বালুর মাঠে আসে। শুরু করে ঘোরাঘুরি।

এত রাতে একদল কিশোরকে ঘুরতে দেখে সন্দেহ হয় গ্রামবাসীর। তাঁরা ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করে। লোকজনের চিৎকার শুনে কিশোরদল ভয়ে গ্রাম ছেড়ে মাঠের দিকে চলে যায়। এবার গ্রামের তিন মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়—গ্রামে ডাকাত হানা দিয়েছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে শত শত মানুষ সাত তরুণকে ঘেরাও করে। এরপর শুরু হয় লাঠিপেটার মচ্ছব। জনতার সেই জিঘাংসায় প্রাণ যায় ছয় তরুণের। প্রাণে বেঁচে যায় একজন—আল আমিন।

আল আমিনের মুখে শুনেছিলাম সেই ঘটনার বিবরণ। আল আমিন বলে, ‘যতবার বলি আমরা ছাত্র, কিন্তু কেউ কথা শোনে না। সবাই ডাকাত বলে মারতে থাকে। মারধরের সময় আমি এক মুরুব্বির পায়ে ধরে বলি: চাচা, আমি ডাকাত নই, ছাত্র। তিনি আমাকে ঠেলে দেন। দেখি, সেখানে পুলিশের এক দারোগা দাঁড়িয়ে। সেই দারোগার পায়ে পড়ে বলি: আমাকে বাঁচান, আমি ছাত্র। তখন দারোগা খুব শান্ত গলায় লোকজনকে বলেন, “সবাইকে মারলে তো হবে না। অন্তত একজনকে তো বাঁচায়ে রাখতে হবে।” এরপর আমি বেঁচে যাই।’

আল আমিনের সেই বক্তব্য শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, গ্রামের লোকজন যখন কিশোরদের পিটিয়ে মারছিল, তখন পুলিশের এক এসআইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবাইকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে পিটিয়ে মারতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। আল আমিনের এই বক্তব্য কাগজে ছাপাও হয়েছিল। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আল আমিন। কিন্তু সেই এসআইকে কেউ শনাক্তই করেনি, ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক।

ঘটনা শুধু এখানেই শেষ নয়। সাভার থানার পুলিশ পরে কিশোরদের সবাইকে ডাকাত সাজিয়ে মামলা করে। পরে জনতার চাপে ওই মামলা টেকেনি। উল্টো রথের যাত্রা শুরু হয়।
সাভার থানা থেকে ফেরার পথে সব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সেই বুকফাটা কান্না এখনো কানে বাজে। কিশোর কামরুজ্জামান কান্তর মা কুসুম আক্তার বলেছিলেন, রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ছেলের গায়ে লাল রঙের পাঞ্জাবিটা তিনিই পরিয়ে দিয়েছিলেন।

উন্মত্ত গ্রামবাসীর পিটুনিতে কান্তর সেই পাঞ্জাবি ছিঁড়ে যায়। ঘটনার পরদিন বালুর মাঠে সেই পাঞ্জাবিটা পড়ে ছিল। হতভাগ্য মা তা কোনো দিন ভাবতেও পারেননি।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত