কামরুল হাসান
ফোন বাজছে তো বাজছেই। ভোরের ঘুমে নিমগ্ন। চোখ মেলে স্ক্রিনে দেখি র্যাবের কমান্ডার মাসুক হাসান। হ্যালো বলতেই বললেন, দৌড় দেন মধ্যবাড্ডার আনন্দনগরে। বিগ শট। নিমেষে ঘুম উবে গেল। পড়িমরি করে উঠে বাইকটা নিয়েই দিলাম ছুট। সোজা বাড্ডায়। ফজরের নামাজ পড়ে লোকজন সবে বের হচ্ছেন। মধ্যবাড্ডার মোড়ে এসে এক মুসল্লির কাছে জানতে চাইলাম, আনন্দনগরে কোন পথে যাব। তিনি ডান দিকে একটি রাস্তা দেখিয়ে বললেন, র্যাবের অনেক গাড়ি গেছে এদিকে।
আনন্দনগরে ঢুকে দেখি, র্যাবের অনেক গাড়ি রাস্তায় দাঁড় করানো। আমাকে দেখে র্যাবের এক সদস্য একটি গলি দেখিয়ে সেদিকে যেতে বললেন। একটু এগোতেই মনে হলো, সামনে একটি ঝিল। বাড়িঘরও কম। ঝিলের ঠিক মাঝখানে একটি দোতলা বাড়ি, সেখান থেকে একজনকে ধরে আনছেন র্যাবের কয়েকজন সদস্য। কাছে আসতেই দেখি, হ্যান্ডকাফ পরা লোকটা। ছোটখাটো চেহারা। মুখে দাড়ি নেই। পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। সারা শরীর ভেজা। গা থেকে পানি পড়ছে। তাঁর পেছনেই র্যাবের মেজর আতিক।
সাতসকালে আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তিনি বললেন, চিনছেন? উনি আবদুল হান্নান মুনশি। আমি বললাম, মানে—মুফতি হান্নান? এবার তিনি গলায় বেশ জোর দিয়ে একটু টেনে বললেন, ইয়েস। তো ভেজা কেন? তিনি বললেন, এত বড় জঙ্গি জীবন বাঁচাতে ঝিলের পচা পানিতে লাফ দিয়েছিল। সেখান থেকে তুলে আনলাম। এটা ২০০৫ সালের ১ অক্টোবরের সকাল।
১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর থেকেই একের পর এক জঙ্গিনেতার নাম শোনা যাচ্ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে তখন আমরা জানতে পারছিলাম, আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধফেরত একদল জঙ্গি দেশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। তারাই এসব হামলা করছে। এগুলোর মধ্যে ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা পুঁতে রাখার ঘটনা ঘটে। তখনই আলোচনায় আসে মুফতি হান্নানের নাম।
মুফতি হান্নানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মূলত গোপালগঞ্জে। তিনি যশোরের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। সেখানে পড়ার সময় ১৯৮৭ সালে ‘উচ্চশিক্ষা’র জন্য পাকিস্তানের করাচিতে নিউ টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানেই জঙ্গিবাদে জড়ান। আফগানিস্তানে তখন সোভিয়েত বাহিনী যুদ্ধ করছিল। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হন। বাংলাদেশে ফিরে ১৯৯৪ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশে যোগ দেন। শুরুতে কোটালীপাড়া থানার প্রচার সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু দ্রুতই নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা আর দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের সুবাদে কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠেন। মুফতি হান্নান আফগান স্টাইলে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। প্রথমে দেশি বোমা ব্যবহার করলেও পরে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া বোমা বানানো এবং হামলার বিষয়েও তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। তিনি নিজেও প্রশিক্ষণ দিতেন।
এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শুরুটাই হয়েছিল হরকাতুল জিহাদের হামলার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে বড় জঙ্গি হামলার বেশির ভাগ হয়েছে মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ছিল তাদের টেস্ট কেস। সেই ঘটনার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মুফতি হান্নান নিজে ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় সাত বছরে ১৩টি জঙ্গি হামলা হয়। এসব হামলায় ১০১ জন নিহত এবং ৬০০ জন আহত হন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে হান্নানের নেতৃত্বে।
সেই ভয়ংকর জঙ্গিকে গ্রেপ্তার নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা চলছিল। এর কারণও ছিল। ধরা পড়ার পর হান্নান নিজেই সবার সামনে তা ফাঁস করে দেন। গ্রেপ্তার করা হান্নানকে সেদিন বিকেলে র্যাব-১-এর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়। তখন সাংবাদিকেরা তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জবাবে হান্নান বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনার পর তিনি কিছুদিন চুপ করে ছিলেন। এরপর চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। মাসিক মদিনা পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর কাছে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনও করেন। চারদলীয় জোট সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয়, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলেই তাঁকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। তিনি দাড়ি কেটে ফেলে একের পর এক বাসা বদল করে ঢাকাতেই থাকতে শুরু করেন। পরদিন এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিএনপি সরকারকে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁকে বিভিন্ন মামলায় ৪০০ দিন রিমান্ডে রাখা হয়। দেশে আর কোনো আসামিকে এত দিন রিমান্ডে রাখার নজির নেই। তিনি সব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে দুটি মামলায় ফাঁসি হয়। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর হয় কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে।
মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তারের এক দিন পর আমি তাঁর স্ত্রী জাকিয়া পারভিন রুমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি যা বললেন, তা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। র্যাব-১-এর অধিনায়ক (প্রয়াত) গুলজার উদ্দিন আমাকে প্রায়ই বলতেন, জঙ্গিরা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে। হান্নানের স্ত্রী রুমাকে দেখে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। রুমা আমাকে বললেন, মাত্র ২১ দিন আগে তাঁরা এ বাসায় আসেন। চার হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া করেন হান্নান। ছেলে শাহাবুদ্দিন (৯) ও নূরুল্লাহ (৫) এবং মেয়ে নিশি (৫) ও নাজনীনকে (২) নিয়ে তাঁদের সংসার। তাঁদের সব ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। এ বাড়িতে বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নেই। তাঁর স্বামী কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও আসেন না। তাঁরা কোথায় থাকেন, সেটাও কাউকে জানানো হয় না। গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত স্বামীর এসব অপকর্মের কথা তিনি জানতেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় হান্নানের জড়িত থাকার খবর তিনি শুনেছেন। মুফতি হান্নান তাঁর কাছে এসব কথা কখনো স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, এসব ষড়যন্ত্র।
রুমা আমাকে বললেন, মুফতি হান্নান আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে কখনো তিনি এসব নিয়ে স্বামীকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। তাঁর গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। আগে থেকেই চেনাজানা ছিল। সেই সুবাদে ১৯৯৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ার ঘটনার পর থেকে হান্নান বাড়ির বাইরে থাকতেন। তিনি সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাস করতেন। তবে কোটালীপাড়ার ঘটনার পর (শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রাখা) হান্নান তাঁদের নিয়ে কিছুদিন মাগুরায় এবং কিছুদিন খুলনায় ছিলেন। আড়াই বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথমে তাঁরা গাজীপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে পোলট্রি খামার গড়ে তোলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে সেই ব্যবসায় লোকসান হয়। এরপর রামপুরা ডিআইটি রোড এলাকায় চলে আসেন। সেখানে একটি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকান নিয়ে হান্নান ব্যবসা শুরু করেন। এক বছর সেখানে থেকে চলে আসেন মধ্যবাড্ডার আনন্দনগরে।
রুমা বলছিলেন, হান্নান দিনের বেলা বাসা থেকে তেমন বের হন না। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কোনো মেলামেশাও ছিল না। সব সময় তিনি নিজের নাম ‘জামান’ বলে জানাতেন। তাঁর ছেলেমেয়েরাও বাবার নাম জামান বলেই জানে।
আফগান যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হাতের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে মুফতি হান্নান নিজের ছেলেমেয়েদের বলতেন, সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়েছেন। তাঁর ফেরার জীবনের কোনো কথা স্ত্রী-সন্তানদের জানাতেন না। ছদ্মবেশ ধরতে নিজের নামটি পর্যন্ত বদলে ফেলেছিলেন। কিন্তু এত কিছু লুকানোর পরও শেষরক্ষা হলো? ভুল রাজনীতি এবং ভুল পৃষ্ঠপোষকতা কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, মুফতি হান্নান তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
আরও পড়ুন
ফোন বাজছে তো বাজছেই। ভোরের ঘুমে নিমগ্ন। চোখ মেলে স্ক্রিনে দেখি র্যাবের কমান্ডার মাসুক হাসান। হ্যালো বলতেই বললেন, দৌড় দেন মধ্যবাড্ডার আনন্দনগরে। বিগ শট। নিমেষে ঘুম উবে গেল। পড়িমরি করে উঠে বাইকটা নিয়েই দিলাম ছুট। সোজা বাড্ডায়। ফজরের নামাজ পড়ে লোকজন সবে বের হচ্ছেন। মধ্যবাড্ডার মোড়ে এসে এক মুসল্লির কাছে জানতে চাইলাম, আনন্দনগরে কোন পথে যাব। তিনি ডান দিকে একটি রাস্তা দেখিয়ে বললেন, র্যাবের অনেক গাড়ি গেছে এদিকে।
আনন্দনগরে ঢুকে দেখি, র্যাবের অনেক গাড়ি রাস্তায় দাঁড় করানো। আমাকে দেখে র্যাবের এক সদস্য একটি গলি দেখিয়ে সেদিকে যেতে বললেন। একটু এগোতেই মনে হলো, সামনে একটি ঝিল। বাড়িঘরও কম। ঝিলের ঠিক মাঝখানে একটি দোতলা বাড়ি, সেখান থেকে একজনকে ধরে আনছেন র্যাবের কয়েকজন সদস্য। কাছে আসতেই দেখি, হ্যান্ডকাফ পরা লোকটা। ছোটখাটো চেহারা। মুখে দাড়ি নেই। পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। সারা শরীর ভেজা। গা থেকে পানি পড়ছে। তাঁর পেছনেই র্যাবের মেজর আতিক।
সাতসকালে আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তিনি বললেন, চিনছেন? উনি আবদুল হান্নান মুনশি। আমি বললাম, মানে—মুফতি হান্নান? এবার তিনি গলায় বেশ জোর দিয়ে একটু টেনে বললেন, ইয়েস। তো ভেজা কেন? তিনি বললেন, এত বড় জঙ্গি জীবন বাঁচাতে ঝিলের পচা পানিতে লাফ দিয়েছিল। সেখান থেকে তুলে আনলাম। এটা ২০০৫ সালের ১ অক্টোবরের সকাল।
১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর থেকেই একের পর এক জঙ্গিনেতার নাম শোনা যাচ্ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে তখন আমরা জানতে পারছিলাম, আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধফেরত একদল জঙ্গি দেশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। তারাই এসব হামলা করছে। এগুলোর মধ্যে ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা পুঁতে রাখার ঘটনা ঘটে। তখনই আলোচনায় আসে মুফতি হান্নানের নাম।
মুফতি হান্নানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মূলত গোপালগঞ্জে। তিনি যশোরের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। সেখানে পড়ার সময় ১৯৮৭ সালে ‘উচ্চশিক্ষা’র জন্য পাকিস্তানের করাচিতে নিউ টাউন মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানেই জঙ্গিবাদে জড়ান। আফগানিস্তানে তখন সোভিয়েত বাহিনী যুদ্ধ করছিল। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে আহত হন। বাংলাদেশে ফিরে ১৯৯৪ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশে যোগ দেন। শুরুতে কোটালীপাড়া থানার প্রচার সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু দ্রুতই নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা আর দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের সুবাদে কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠেন। মুফতি হান্নান আফগান স্টাইলে বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালাচ্ছিলেন। প্রথমে দেশি বোমা ব্যবহার করলেও পরে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া বোমা বানানো এবং হামলার বিষয়েও তাঁর সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। তিনি নিজেও প্রশিক্ষণ দিতেন।
এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শুরুটাই হয়েছিল হরকাতুল জিহাদের হামলার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে বড় জঙ্গি হামলার বেশির ভাগ হয়েছে মুফতি আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ছিল তাদের টেস্ট কেস। সেই ঘটনার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মুফতি হান্নান নিজে ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ও পরিকল্পনায় সাত বছরে ১৩টি জঙ্গি হামলা হয়। এসব হামলায় ১০১ জন নিহত এবং ৬০০ জন আহত হন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে হান্নানের নেতৃত্বে।
সেই ভয়ংকর জঙ্গিকে গ্রেপ্তার নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা চলছিল। এর কারণও ছিল। ধরা পড়ার পর হান্নান নিজেই সবার সামনে তা ফাঁস করে দেন। গ্রেপ্তার করা হান্নানকে সেদিন বিকেলে র্যাব-১-এর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়। তখন সাংবাদিকেরা তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জবাবে হান্নান বলেন, গোপালগঞ্জের ঘটনার পর তিনি কিছুদিন চুপ করে ছিলেন। এরপর চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। মাসিক মদিনা পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর কাছে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনও করেন। চারদলীয় জোট সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হয়, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলেই তাঁকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। তিনি দাড়ি কেটে ফেলে একের পর এক বাসা বদল করে ঢাকাতেই থাকতে শুরু করেন। পরদিন এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিএনপি সরকারকে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁকে বিভিন্ন মামলায় ৪০০ দিন রিমান্ডে রাখা হয়। দেশে আর কোনো আসামিকে এত দিন রিমান্ডে রাখার নজির নেই। তিনি সব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে দুটি মামলায় ফাঁসি হয়। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর হয় কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে।
মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তারের এক দিন পর আমি তাঁর স্ত্রী জাকিয়া পারভিন রুমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি যা বললেন, তা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। র্যাব-১-এর অধিনায়ক (প্রয়াত) গুলজার উদ্দিন আমাকে প্রায়ই বলতেন, জঙ্গিরা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে। হান্নানের স্ত্রী রুমাকে দেখে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। রুমা আমাকে বললেন, মাত্র ২১ দিন আগে তাঁরা এ বাসায় আসেন। চার হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া করেন হান্নান। ছেলে শাহাবুদ্দিন (৯) ও নূরুল্লাহ (৫) এবং মেয়ে নিশি (৫) ও নাজনীনকে (২) নিয়ে তাঁদের সংসার। তাঁদের সব ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। এ বাড়িতে বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নেই। তাঁর স্বামী কারও সঙ্গে মেলামেশা করেন না। তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও আসেন না। তাঁরা কোথায় থাকেন, সেটাও কাউকে জানানো হয় না। গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত স্বামীর এসব অপকর্মের কথা তিনি জানতেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় হান্নানের জড়িত থাকার খবর তিনি শুনেছেন। মুফতি হান্নান তাঁর কাছে এসব কথা কখনো স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, এসব ষড়যন্ত্র।
রুমা আমাকে বললেন, মুফতি হান্নান আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে কখনো তিনি এসব নিয়ে স্বামীকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। তাঁর গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। আগে থেকেই চেনাজানা ছিল। সেই সুবাদে ১৯৯৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ার ঘটনার পর থেকে হান্নান বাড়ির বাইরে থাকতেন। তিনি সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাস করতেন। তবে কোটালীপাড়ার ঘটনার পর (শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রাখা) হান্নান তাঁদের নিয়ে কিছুদিন মাগুরায় এবং কিছুদিন খুলনায় ছিলেন। আড়াই বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথমে তাঁরা গাজীপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে পোলট্রি খামার গড়ে তোলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে সেই ব্যবসায় লোকসান হয়। এরপর রামপুরা ডিআইটি রোড এলাকায় চলে আসেন। সেখানে একটি ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকান নিয়ে হান্নান ব্যবসা শুরু করেন। এক বছর সেখানে থেকে চলে আসেন মধ্যবাড্ডার আনন্দনগরে।
রুমা বলছিলেন, হান্নান দিনের বেলা বাসা থেকে তেমন বের হন না। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কোনো মেলামেশাও ছিল না। সব সময় তিনি নিজের নাম ‘জামান’ বলে জানাতেন। তাঁর ছেলেমেয়েরাও বাবার নাম জামান বলেই জানে।
আফগান যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হাতের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে মুফতি হান্নান নিজের ছেলেমেয়েদের বলতেন, সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়েছেন। তাঁর ফেরার জীবনের কোনো কথা স্ত্রী-সন্তানদের জানাতেন না। ছদ্মবেশ ধরতে নিজের নামটি পর্যন্ত বদলে ফেলেছিলেন। কিন্তু এত কিছু লুকানোর পরও শেষরক্ষা হলো? ভুল রাজনীতি এবং ভুল পৃষ্ঠপোষকতা কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, মুফতি হান্নান তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
আরও পড়ুন
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪