Ajker Patrika

বিনিয়োগ সম্মেলন

বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য সেরা জায়গা: ইউনূস

  • এক ব্যক্তি ও চার প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা।
  • সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান।
  • স্বাস্থ্যসেবা খাত শক্তিশালী করতে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা কামনা।
বাসস, ঢাকা  
আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৩: ২৭
সম্মেলনের প্রথম দিনে ‘এক্সিলেন্স ইন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ছবি: পিআইডি
সম্মেলনের প্রথম দিনে ‘এক্সিলেন্স ইন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ছবি: পিআইডি

বাংলাদেশকে ব্যবসার জন্য সেরা জায়গা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার বিশ্বকে বদলে দেওয়ার অভিনব সব ধারণা রয়েছে। এসব ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাই আমরা আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, যেন আপনারা শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকেই বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হন।’

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বুধবার চার দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এই আহ্বান জানান। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বাংলাদেশে ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আপনি যদি কোনো লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তাহলে বাংলাদেশই আপনার সেই জায়গা। বাংলাদেশ কাজ করে দেখায়, আর একবার কেউ শুরু করলে অন্যরাও তার অনুসরণ করে।’ কীভাবে মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে সুখী হয়, তার বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘টাকা উপার্জন করে মানুষ নিঃসন্দেহে আনন্দ বা সুখ পায়, কিন্তু অন্যকে সুখী করার মধ্যে অতিরিক্ত আনন্দ বা সুখ নিহিত রয়েছে।’

সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, তাহলে আপনি সুখ এবং অতিরিক্ত আনন্দ—দুটিই পাবেন।’ তিনি একই সঙ্গে অর্থ উপার্জন এবং মানুষের জীবন পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্ব বদলে দেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং এর মাধ্যমে নতুন সভ্যতা গঠনের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলছি, আমরা “তিন শূন্য”র একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি। এটা সরকার দিয়ে নয়, ব্যবসার মাধ্যমে করা সম্ভব। কারণ, এটা সরকারের কাজ নয়, বরং মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ।’

ব্যবসা-বাণিজ্য মানুষের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নতুন সভ্যতা হবে এমন একটি সভ্যতা, যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না। আমরা তা করতে পারি। এটি হওয়া উচিত ব্যবসায়িক উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে।’ কার্বন নিঃসরণকে আত্মবিধ্বংসী ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে তিনি সম্পদ কেন্দ্রীকরণ না করার আহ্বান জানান। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘অর্থ উপার্জন আনন্দের হলেও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। এটি পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।’

প্রধান উপদেষ্টা শূন্য বেকারত্বের ধারণার ওপরও গুরুত্ব দেন এবং বলেন, তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দিতে সক্ষম।

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে যুক্তরাজ্যের সহায়তা কামনা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যকে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যদূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই আহ্বান জানান। বৈঠকে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের বর্তমানে নার্সের সংকট রয়েছে। তবে নার্সিং শুধু জাতীয় সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর। এখানে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হলো ওষুধশিল্প। আমরা অনুরোধ করছি, পেটেন্ট সুরক্ষা তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিন, যাতে প্রতিটি দেশ সাশ্রয়ীভাবে সামাজিক ব্যবসা মডেলে টিকা উৎপাদন করতে পারে।’

উভয় পক্ষ শিক্ষা, টেক্সটাইল শিল্প, প্রতিরক্ষা, বিমান চলাচলসহ কৌশলগত সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন। জেন্ডার সমতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন আমাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে।’

কয়েকটি খাতে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা

বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানিয়েছেন, চলমান বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিতে আসা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েকটি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যাল ও কৃষি।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বব্যাপী উন্নত মানের নিটেড টেক্সটাইল, ডাইং প্রসেস এবং পোশাক উৎপাদনের জন্য চীনভিত্তিক স্বনামধন্য পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বাংলাদেশে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এই লক্ষ্যে বিডা ও হান্ডা টেক্সটাইল কোং লিমিটেডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়। তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতাধীন টেক্সটাইল ও ডাইং খাতে ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের আওতাধীন পোশাকশিল্পে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আমাদের একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। আমরা চিন্তাভাবনা করেছি, ফ্রি ট্রেড জোনের দিকে চলে যাব। সংযুক্ত আরব আমিরাতে জেবেল আলী পোর্ট আছে, সেটি আমিরাতের অর্থনীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখে। সেই বন্দরের মতো করে আমরা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় এই ফ্রি ট্রেড জোনের কথা চিন্তা করছি।’

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের তৃতীয় দিনে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে, দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কৌশল নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে এফবিসিসিআই। সেমিনারের শুরুতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান নীতিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিনিয়োগসংক্রান্ত ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর সমাধান করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার অবকাঠামোতে বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে।

এদিকে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’-এ কর-স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য একটি প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করব; যা নিশ্চিত করবে ন্যায্য আচরণ, কর-স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের অধিকার। এই আইনি কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তা দেবে এবং বাংলাদেশকে একটি স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসাবান্ধব দেশ হিসেবে তুলে ধরবে।

এর আগে তৃতীয় দিনের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সামিটের উদ্বোধন করেন। সামিটে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি, বিকাশ বাংলাদেশ, ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি এবং ফ্যাব্রিকস লাগবে লিমিটেডসহ মোট চার প্রতিষ্ঠানকে ‘এক্সিলেন্স ইন ইনভেস্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছে সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের হাতে স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

এরপর বেলা ২টা থেকে সাড়ে ৩টায় নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জি শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবসায় বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয় প্রাণ-আরএফএল। সৌরবিদ্যুৎ থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে জানায় প্রাণ-আরএফএল।

চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে চারটি সেশন হবে। সেশনগুলো হলো ‘ডিজিটাল ইকোনমি’, ‘টেক্সাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস, হেলথকেয়ার অ্যান্ড ফার্মা’ এবং ‘অ্যাগ্রো প্রসেসিং’ শীর্ষক সেশন। সব শেষে বিডার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ নিয়ে সমাপনী সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত