Ajker Patrika

কুড়িগ্রামের বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা, ৩ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত

চিলমারী ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৪, ১৯: ২৫
Thumbnail image

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যায় ধুঁকছে কুড়িগ্রামের হাজারো পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে নতুন করে ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে পানি বাড়তে শুরু করায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় পাওয়া প্রতিবেদনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিনটি নদী পাঁচ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া, উলিপুরের হাতিয়া এবং চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভূরুঙ্গামারীর পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার এবং কুড়িগ্রাম শহরের সেতু পয়েন্টে ধরলা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টা থেকে এসব নদনদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামের ধরলা অববাহিকায় ১৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা উত্তরাঞ্চলের উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময় ধরলা ও দুধকুমার নদের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। 
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার তথ্য বলছে, চলমান বন্যায় জেলার ৯ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে প্লাবিত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের দাবি, পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। 

গতকাল বুধবার থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া লোকজনও বৃষ্টির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন। গবাদিপশু নিয়ে দুর্ভোগের মাত্রা চরমে পৌঁছেছে। 

চিলমারীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত। ছবি: আজকের পত্রিকাচিলমারীর রমনা মডেল ইউনিয়নের মাঝিপাড়া এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, ‘টানা ১০ দিন ধরে ঘরে-বাইরে পানি। চৌকির ওপর ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি। কাজ-কামাই নাই, খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট।’ 

চিলমারীর থানাহাট ইউনিয়নের ডেমনারপাড়া এলাকার বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ির চারপাশে পানি। গরু-ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু-ছাগলকে খাবার দিতে পারছি না।’ 

সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটা চরের বন্যাকবলিত অনেক পরিবার গবাদিপশু নিয়ে গোয়াইলপুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রলাকাটার চর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে মানুষ ও পশু মিলে গাদাগাদি করে সেখানেই বসবাস করছে। বৃষ্টি তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। 
ওই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা মামুন বলেন, ‘চরের মানুষের জীবন আসলে কঠিন। আমরা খুব কষ্টে আছি। একদিকে ভাঙন, আরেক দিকে বন্যা। গরু-ছাগল নিয়ে একসঙ্গে থাকতে হইতেছে। থাকার পরিবেশ নাই। তারপরও বাধ্য হয়া আছি।’ 

এক সপ্তাহ ধরে স্কুলঘরে আশ্রয় নিয়ে থাকা এই বানভাসি বলেন, ‘২০-২৫টা পরিবার স্কুলে আশ্রয় নিছি। যে বৃষ্টি শুরু হইছে তাতে অবস্থা আরও খারাপ। চুলাও ভিজি গেইছে। আইজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিবারগুলা রান্নাও করতে পারে নাই।’ ওই চরে পানিবন্দী পরিবারগুলো সহায়তার অভাবে খাদ্যকষ্টে আছে বলেও জানান তিনি। 

ওই এলাকার ওয়ার্ড সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রলাকাটার চর, গোয়াইলপুরীর চর আমার ৮ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত। প্রায় দুই সপ্তাহ ধইরা এই ওয়ার্ডের চার শতাধিক পরিবার পানিবন্দী। আবার পানি ফিকতাছে। ভাঙনকবলিত ৪০টি পরিবার একবার খাদ্য সহায়তা পাইছে। আর কোনো পরিবার কোনো সাহায্য পায় নাই। আমি বারবার চাইলেও কোনো বরাদ্দ পাই নাই।’ 

বন্যায় জেলার লাখো মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। পরিস্থিতির অবনতি হয়ে বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকার মানুষজন। আশ্রয়, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দিনযাপন করছেন বানভাসিরা। এ অবস্থায় প্লাবিত এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি সহায়তাই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু-একটি বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কিছু ব্যক্তি ছাড়া ত্রাণ বিতরণে বড় কোনো উদ্যোগ নেই। 

সদরের গোয়াইলপুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে পানিবন্দী মানুষ। ছবি: আজকের পত্রিকাচিলমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৬৬  টন চাল ও ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দ চাল ও টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। তবে গো-খাদ্যের কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।’ 

চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রুকুজ্জামান শাহীন বলেন, ‘বন্যাকবলিত মানুষেরা আমার কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। চিলমারীতে আরও ত্রাণ চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।’ 

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আমরা ত্রাণ সহায়তা বিতরণ জোরদার করেছি। যেসব স্থানে সহায়তা পৌঁছায়নি সেখানেও পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়া প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। দুর্গত মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত