Ajker Patrika

পাশাপাশি তিন শিশুর কবর, এক বিষাদের গল্প

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪৪
ছবি: আজকের পত্রিকা
ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। ফেসবুকে ঢুকলেই ওই দুর্ঘটনার মন খারাপ করা ছবি ও ভিডিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে যায় ‘এসএসসি ০৫-এইচএসসি ০৭’ গ্রুপের একটি পোস্টে। সেখানে লেখা আছে, ‘এক বন্ধুর ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ যোগাযোগ করি পোস্টদাতা শামসুজ্জামান সোহাগের সঙ্গে।

তিনি জানান, বন্ধু ইমরান হোসেন কুতুবের একই পরিবারের তিনটি ফুল ঝরে গেছে। সোহাগ যোগাযোগ করিয়ে দেন উত্তরার আরেক বন্ধু জনির সঙ্গে। গতকাল জনির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি উত্তরার দিয়াবাড়ির উদ্দেশে।

সময় দুপুর গড়িয়ে গেছে। আমি তখনো দিয়াবাড়ির উত্তর পাশে তুরাগ থানার তারারটেক রোডে। এবড়োখেবড়ো ও খানাখন্দে ভরা এই রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করি, কুতুবদের বাড়ি কোথায়? এক কিশোর এগিয়ে আসে। বলে, মারা গেছে যে বাড়ির? বলি, হ্যাঁ। সে আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলে, রোডের শেষ প্রান্তে তারারটেক জামে মসজিদ। তার সামনেই ওই বাড়ি।

ওই কিশোরের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে তারারটেক জামে মসজিদে পৌঁছে দেখি সামনে ছোট পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে পাশাপাশি সাজানো তিনটি শিশুর তাজা কবর। দেখে মনে হলো, মাত্রই দাফন শেষ হয়েছে। কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এক ব্যক্তি। মুখটা বিষণ্ন তাঁর। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই জানালেন কুতুবের চাচাতো ভাই তিনি, নাম মো. রাসেল। কথায় কথায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রাসেল। বললেন, ‘এই দেখেন। জোহরের নামাজ শেষে দাফন দিয়েছি। আমার চোখের সামনেই তিনজন একসঙ্গে খেলাধুলা করত। আমি কয়েক দিন আগে বলেছি, তোদের একটা মাঠ কইরা দিতাছি। আজ তারা নেই। সব শেষ হইয়া গেল।’

মসজিদের পাশে যে বাড়ি, সেখান থেকেও কান্নার শব্দ আসছিল তখন। নিহতদের পরিবারের কেউ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। রাসেলের কাছ থেকেই জানতে হলো সব। তিনি জানালেন, মাইলস্টোনে এই পরিবারের যে তিন শিশু মারা গেছে, তাদের মধ্যে আশিকুর রহমান উমাইর কুতুবের ছেলে। ওই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত সে। একই শ্রেণিতে পড়ত কুতুবের চাচা মো. সেলিমের ছেলে মাহমুদুল ইসলাম আরিয়ান। আর কুতুবের ফুপাতো ভাই মো. শাহীন সরকারের ছেলে মো. বাপ্পি সরকার পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিভীষিকাময় পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে রাসেল বলেন, ‘আমরা বাড়ির সামনে ছিলাম। হঠাৎ শুনি বিকট আওয়াজ। দৌড়ায়ে বের হইয়া যাই। গিয়ে দেখি উমাইর আর বাপ্পি স্কুলের পাশেই মাঠে পড়ে আছে। সেনাবাহিনী নিয়ে যাবে। আমার এক চাচাতো ভাইকে দিয়ে দিই তাদের সঙ্গে। আমি পরে একটা বাইক (মোটরসাইকেল) নিয়ে হাসপাতালে যাই। প্রথমে লুভানা হসপিটালে নেয়। পরে সেখান থেকে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয় বাচ্চা দুটোকে। ইউনাইটেড হাসপাতালেই মারা যায় উমাইর। আর বাপ্পিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বার্ন হাসপাতালে (জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট)।’

রাসেল একটু থেমে আবার বলেন, ‘এরপরে আরেক চাচাতো ভাই ফোন দিয়ে বলে আমাদের সেলিম চাচার ছেলে আরিয়ানও পুড়ে গেছে। ওকেও নিয়ে যাই বার্ন হাসপাতালে। পরে বার্ন হাসপাতালেও কাউরে বাঁচাইতে পারি নাই, ভাই।’

রাসেলের চোখ বেয়ে জল ঝরে। একটু পরপর এলাকার লোকজন আসছে। কবর জিয়ারত করছে। রাসেলের কাছ থেকে শুনছে প্রিয়জন হারানোর ঘটনা। রাসেল জানান, এই রোডের দুই ধারে তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা থাকেন। তাঁরা এখানকারই স্থানীয় মানুষ। এই রোডের আরও দুটি মেয়ে মারা গেছে। এই এলাকার মোট পাঁচটি শিশু মারা গেছে।

বিকেলের রোদ ততক্ষণে মিহি হয়ে আসে। গাছের পাতার ফাঁক গলে সেই রোদ এসে পড়েছে কবরের গায়। ইমরান হোসেন কুতুব এগিয়ে আসেন সন্তানের কবরের কাছে। বসে পড়েন। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন কবরের গায়। হাত বোলানো নয়, আদর করে দেন। এই আদর তিনি করেছেন গত কয়েকটি বছর। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ডুকরে কেঁদে ওঠেন। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী। এই ভার তিনি সইবেন কেমন করে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পাচার করা ৭৮১ কোটি টাকা ফেরত দিতে চেয়েও জামিন পেলেন না নাসার চেয়ারম্যান নজরুল

জীবন বিলিয়ে দিয়ে উত্তরার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীদের বাঁচালেন, কে এই মাহরীন চৌধুরী

পাইলটের শেষ বার্তা: বিমান ভাসছে না, নিচে পড়ছে

মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরাই ছিল ৩৭ বছরের মাসুকার ‘সংসার’, যুদ্ধবিমান তছনছ করে দিল

চোখের জলে পাইলট তৌকিরের বিদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত