Ajker Patrika

গাজীপুর

বেলাই বিল গিলছে ভূমিদস্যুরা

  • আদালতের নিষেধাজ্ঞা না মেনে বিল ভরাট চলছে দিনের বেলায়।
  • বেলাই বিলের আয়তন ছিল ৫০ বর্গকিমি, এখন ৮ বর্গকিমি।
  • ভরাটে নাম এসেছে ‘নর্থ সাউথ’ ও ‘তেপান্তর’ গ্রুপের।
  • অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, কাজ হয়নি।
মো. রিয়াদ হোসাইন, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) 
বেলাই বিলের জমি ভরাটে ফেলা হয়েছে বালু। পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে বিল ভরাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাইট অফিস। সম্প্রতি গাজীপুরের টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের নলছাটা এলাকা থেকে তোলা ছবি। আজকের পত্রিকা
বেলাই বিলের জমি ভরাটে ফেলা হয়েছে বালু। পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে বিল ভরাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাইট অফিস। সম্প্রতি গাজীপুরের টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের নলছাটা এলাকা থেকে তোলা ছবি। আজকের পত্রিকা

অবৈধ দখলে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে গাজীপুরের ‘ফুসফুস’ খ্যাত বেলাই বিল। উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে বিল ভরাটের অভিযোগ উঠেছে প্রভাবশালী ‘নর্থ সাউথ’ ও ‘তেপান্তর’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। রাতের আঁধারে শুরু হওয়া এই দখলের কাজ এখন দিনের আলোতেও চলছে। স্থানীয় প্রশাসন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও কোনো কাজ হচ্ছে না। হুমকিতে পড়েছে বিলের প্রাণপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।

সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের পাশ ঘেঁষে নলছাটা এলাকায় বেলাই বিলে নিজেদের সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে নর্থ সাউথ ও তেপান্তর গ্রুপ। কিছুদিন আগেও রাতের আঁধারে বালু ভরাটের কাজ চললেও এখন কোনো রাখঢাক ছাড়াই দিনদুপুরে ডাম্প ট্রাক দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে।

বেলাই বিল ভরাটের বিষয়ে ২০১৯ সালে এক রিট আবেদন করা হয়েছিল হাইকোর্টে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেলাই বিলে যেকোনো ধরনের ভরাট, দখল এবং শ্রেণি পরিবর্তনের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। তবে সেই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভরাট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুরা। গত বছর অভিযান চালিয়ে কয়েকজন কর্মচারীকে কারাদণ্ড দেওয়া হলেও বালু ভরাট বন্ধ হয়নি।

ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দালাল হিসেবে নিয়োগ করেছে। এই দালালেরা কৃষকদের নানা প্রলোভনে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। অনেক ক্ষেত্রে জমির পুরো টাকা পরিশোধ হয়নি। শুধু বায়নাপত্র করেই জোরপূর্বক জমি ভরাট শুরু করে দেয়।

উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের দড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রিতা পালমা বলেন, ‘এই এলাকায় সাইদুল নামের এক ব্যক্তি নর্থ সাউথ গ্রুপের দালাল হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রথমে আমাকে জমি বিক্রির প্রলোভন দেখান। রাজি না হলে শুরু হয় ভয়ভীতি দেখানো। পরে বিষয়টি উপজেলা ও খানা প্রশাসনকে জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গত বছর রাতের আঁধারে আমার জায়গায় বালু ফেলা হয়। এখন দিনের বেলায়ও ডাম্প ট্রাক দিয়ে বালু ভরাট করা হচ্ছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী জানান, ৪-৫ বছর আগে তাঁর চার বিঘা জমি এক কোটি টাকা দাম বলে কেনা হয়। পরে তাঁকে মাত্র ২২ লাখ টাকা দিয়ে জমি ভরাট করে ফেলে। বাকি টাকা তিনি আজও পাননি, চাইতে গেলে টালবাহানা করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিল দখল করে নর্থ সাউথ গ্রুপের তৈরি করা একটি অবৈধ স্থাপনায় (সাইট অফিস) দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি প্রথমে আদালতের নির্দেশে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করলেও পরে রহস্যজনকভাবে তা পুনরায় স্থাপন করে। এ বিষয়ে কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আক্তার হোসেন বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই যে কাউকে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিতে তারা বাধ্য। তবে একটি অবৈধ স্থাপনায় কীভাবে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়, সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

নর্থ সাউথ ও তেপান্তরের সাইট অফিসে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় পরিবেশবাদীরা বলছেন, অতীতে বেলাই বিলের আয়তন ৫০ বর্গকিলোমিটার ছিল। দখল হতে হতে এখন মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটারে ঠেকেছে। বিলটি ভরাট হলে প্রথমত, এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য চিরতরে হারিয়ে যাবে; দ্বিতীয়ত, বিলপারের হাজারো জেলে পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় খাদ্য উৎপাদনে। সর্বোপরি বর্ষা মৌসুমে পানি ধারণের এই প্রাকৃতিক আধার হারিয়ে গেলে গাজীপুর এবং এর আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

এ বিষয়ে কথা হলে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, ‘বেলাই বিল রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিল ভরাটের উদ্যোগের খবর পাওয়ামাত্র অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বহু টাকার মালপত্র জব্দ করেছি। বেশ কয়েকজনকে আটক করে জরিমানাসহ জেলহাজতে পাঠানো হয়। বেলাই বিল রক্ষায় কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।’

অবৈধ স্থাপনায় বিদ্যুৎ-সংযোগের বিষয়ে ইউএনও তনিমা বলেন, এ বিষয়ে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত