ভাবনা মুখার্জী
দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। তারেক মাসুদের লেখালেখির প্রতি আগ্রহের অনুপম নিদর্শন ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ শীর্ষক গ্রন্থ। দীর্ঘ ২৫ বছরে তিনি চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে চলচ্চিত্র-ভাবনা, দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের সংকট ও সম্ভাবনা এবং চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট তাঁর নানামুখী অভিজ্ঞতার মর্মছেঁড়া কথা।
তারেক মাসুদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাদ্রাসার মাধ্যমে। একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নানান রকম সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। চলচ্চিত্র, রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি তখনই। তারপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ দিয়ে চলচ্চিত্রজীবনে প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে দেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রাণভোমরা হয়ে ওঠেন।
বইটির শুরুর দিকের বেশ কয়েকটি লেখা তাঁর নিজের চলচ্চিত্রগুলো তৈরির অভিজ্ঞতা নিয়ে। ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’ এবং ‘মাটির ময়না’ নির্মাণের সময়কালের গল্প, বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সিনেমার কথা বলেছেন তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেই সঙ্গে আছে চলচ্চিত্র আন্দোলনের ৪০ বছর পূর্তিতে তাঁর সিনেমা যাত্রার আগেরকার চিন্তাভাবনা নিয়ে কথা। এ ছাড়া স্মৃতিকথা লিখেছেন সত্যজিৎ রায় ও আলমগীর কবিরকে নিয়ে। এ ছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাজ নিয়ে আলোচনাও ছিল। সাধারণত যাঁদের প্রতি আমাদের প্রবল মুগ্ধতা কাজ করে, তাঁদের সম্পর্কে আমরা একটু পক্ষপাতদুষ্ট থাকি। কিন্তু তিনি যাঁদের গুণমুগ্ধ ছিলেন, তাঁদের অপছন্দের ব্যাপারগুলোতে সমালোচনা করেছেন বেশ সাবলীলভাবেই।
তারেক মাসুদ ছিলেন স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা। তৎকালীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে তিনি সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন এবং নিজের মতো বিশ্লেষণ করে লিখেছেন।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অনবদ্য; বিশেষ করে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কতটুকু সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা আমরা জানি। আগে সেই সংঘর্ষ তুলনামূলক বেশিই ছিল বৈকি। তাঁর লেখাগুলো পড়লে তখনকার নির্মিত স্বাধীন ধারার সব চলচ্চিত্র দেখলে ব্যাপারটা আরও গভীরভাবে অনুভব করা যাবে।
তারেক মাসুদের লেখার একটা অংশজুড়ে তিনি কথা বলেছেন নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। বলেছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের আড্ডাগুলো নিয়ে, যেগুলো তাঁকে ‘তারেক মাসুদ’ হতে সাহায্য করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক, আহমদ ছফার সান্নিধ্য, বন্ধুমহল ইত্যাদি সম্পর্কে সুন্দর স্মৃতিকথামূলক লেখা আছে বইটিতে।
চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো নিয়েও তিনি কথা বলেছেন এ বইয়ে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর শুটিং করার পর তৈরি হয় তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র।
বইটিতে রয়েছে এর পেছনের নানা কথা। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি তৈরি করেন সিনেমার ঐতিহাসিক ব্যাকরণের বিরুদ্ধে যাওয়া চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’। ‘মাটির ময়না’ সিনেমাটি যখন বাংলাদেশের সেন্সরে আটকে ছিল, তখন সেই একই সিনেমা বিশ্বের নানান জায়গা থেকে প্রশংসা আর পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছিল। ক্ষোভ, হতাশা আর আনন্দের সম্মিলিত চিত্র ফুটে ওঠে ‘মাটির ময়না’ নিয়ে তাঁর প্রতিটি লেখায়।
তারেক মাসুদের লেখার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই বিষয়ক চলচ্চিত্র নিয়ে নানা রকম কথা। আফসোস করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংরক্ষণ না করার ফলে সেগুলোর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। দুঃখ প্রকাশ করেছেন জহির রায়হানের চলে যাওয়া নিয়ে।
তারেক মাসুদ ছিলেন বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর লেখালেখিগুলো জীবদ্দশায় সংকলিত আকারে প্রকাশিত হলে বইটি আরও গোছানো হতো বলে আমার বিশ্বাস।
চমৎকার এ বইটিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সংকট, তবু তার প্রবল আশাবাদ এবং সম্ভাবনা—সবই তাঁর প্রাঞ্জল লেখনীতে সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
চলচ্চিত্রপ্রেমীসহ সব ধরনের পাঠককে তৃপ্ত করতে সক্ষম হবে আশা করি।
দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। তারেক মাসুদের লেখালেখির প্রতি আগ্রহের অনুপম নিদর্শন ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ শীর্ষক গ্রন্থ। দীর্ঘ ২৫ বছরে তিনি চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, তাতে প্রতিফলিত হয়েছে চলচ্চিত্র-ভাবনা, দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের সংকট ও সম্ভাবনা এবং চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট তাঁর নানামুখী অভিজ্ঞতার মর্মছেঁড়া কথা।
তারেক মাসুদের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাদ্রাসার মাধ্যমে। একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নানান রকম সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। চলচ্চিত্র, রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি তখনই। তারপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ দিয়ে চলচ্চিত্রজীবনে প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে দেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রাণভোমরা হয়ে ওঠেন।
বইটির শুরুর দিকের বেশ কয়েকটি লেখা তাঁর নিজের চলচ্চিত্রগুলো তৈরির অভিজ্ঞতা নিয়ে। ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’ এবং ‘মাটির ময়না’ নির্মাণের সময়কালের গল্প, বিশ্বসভায় বাংলাদেশের সিনেমার কথা বলেছেন তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সেই সঙ্গে আছে চলচ্চিত্র আন্দোলনের ৪০ বছর পূর্তিতে তাঁর সিনেমা যাত্রার আগেরকার চিন্তাভাবনা নিয়ে কথা। এ ছাড়া স্মৃতিকথা লিখেছেন সত্যজিৎ রায় ও আলমগীর কবিরকে নিয়ে। এ ছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাজ নিয়ে আলোচনাও ছিল। সাধারণত যাঁদের প্রতি আমাদের প্রবল মুগ্ধতা কাজ করে, তাঁদের সম্পর্কে আমরা একটু পক্ষপাতদুষ্ট থাকি। কিন্তু তিনি যাঁদের গুণমুগ্ধ ছিলেন, তাঁদের অপছন্দের ব্যাপারগুলোতে সমালোচনা করেছেন বেশ সাবলীলভাবেই।
তারেক মাসুদ ছিলেন স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা। তৎকালীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকে তিনি সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছেন এবং নিজের মতো বিশ্লেষণ করে লিখেছেন।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অনবদ্য; বিশেষ করে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কতটুকু সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা আমরা জানি। আগে সেই সংঘর্ষ তুলনামূলক বেশিই ছিল বৈকি। তাঁর লেখাগুলো পড়লে তখনকার নির্মিত স্বাধীন ধারার সব চলচ্চিত্র দেখলে ব্যাপারটা আরও গভীরভাবে অনুভব করা যাবে।
তারেক মাসুদের লেখার একটা অংশজুড়ে তিনি কথা বলেছেন নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। বলেছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের আড্ডাগুলো নিয়ে, যেগুলো তাঁকে ‘তারেক মাসুদ’ হতে সাহায্য করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক, আহমদ ছফার সান্নিধ্য, বন্ধুমহল ইত্যাদি সম্পর্কে সুন্দর স্মৃতিকথামূলক লেখা আছে বইটিতে।
চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো নিয়েও তিনি কথা বলেছেন এ বইয়ে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর শুটিং করার পর তৈরি হয় তাঁর প্রথম প্রামাণ্যচিত্র।
বইটিতে রয়েছে এর পেছনের নানা কথা। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে তিনি তৈরি করেন সিনেমার ঐতিহাসিক ব্যাকরণের বিরুদ্ধে যাওয়া চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’। ‘মাটির ময়না’ সিনেমাটি যখন বাংলাদেশের সেন্সরে আটকে ছিল, তখন সেই একই সিনেমা বিশ্বের নানান জায়গা থেকে প্রশংসা আর পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছিল। ক্ষোভ, হতাশা আর আনন্দের সম্মিলিত চিত্র ফুটে ওঠে ‘মাটির ময়না’ নিয়ে তাঁর প্রতিটি লেখায়।
তারেক মাসুদের লেখার একটি বড় অংশজুড়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই বিষয়ক চলচ্চিত্র নিয়ে নানা রকম কথা। আফসোস করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংরক্ষণ না করার ফলে সেগুলোর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। দুঃখ প্রকাশ করেছেন জহির রায়হানের চলে যাওয়া নিয়ে।
তারেক মাসুদ ছিলেন বাংলাদেশের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর লেখালেখিগুলো জীবদ্দশায় সংকলিত আকারে প্রকাশিত হলে বইটি আরও গোছানো হতো বলে আমার বিশ্বাস।
চমৎকার এ বইটিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের সংকট, তবু তার প্রবল আশাবাদ এবং সম্ভাবনা—সবই তাঁর প্রাঞ্জল লেখনীতে সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
চলচ্চিত্রপ্রেমীসহ সব ধরনের পাঠককে তৃপ্ত করতে সক্ষম হবে আশা করি।
সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকর্মকে ‘বুর্জোয়া’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করা হয় চীনে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শেকসপিয়ারের সব সাহিত্যকর্ম—যেমন হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, ওথেলো ইত্যাদি—চীনে নিষিদ্ধ হয়, কারণ সেগুলোতে চীনা কমিউনিস্ট আদর্শের ‘সঠিক রাজনৈতিক
১৩ দিন আগেকবি নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে...
১৩ দিন আগেবাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে নজরুল অন্যতম। সাধারণত জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের বেলায় দেখা যায় কালের সীমা অতিক্রম করলে তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় আর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য কালের সীমা অতিক্রম করে আজও পাঠকপ্রিয় হয়ে আছে। এর মূলে রয়েছে তাঁর সচেতন জীবনবোধ...
১৩ দিন আগেনজরুলকে ভুল ভাবে পড়ার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো তাঁকে প্রায়শই রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে দাঁড় করানোর রাজনৈতিক প্রবণতা। এই আইডেনটিটি পলিটিকস শুধু বিভাজন তৈরি করে না, নজরুলের মৌলিক অবস্থানকেও বিকৃত করে।
১৪ দিন আগে