Ajker Patrika

নিক্কেই এশিয়ার নিবন্ধ /মিয়ানমার থেকে মাতারবাড়ী: বঙ্গোপসাগরে শক্তির খেলা

অনলাইন ডেস্ক
বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে সাত সদস্য দেশের নেতারা। ছবি: এএফপি
বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে সাত সদস্য দেশের নেতারা। ছবি: এএফপি

গত এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে একসঙ্গে ছবি তুলেছিলেন বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের সাতটি দেশের নেতারা। সেখানে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জাতীয় বা আনুষ্ঠানিক পোশাকে ছিলেন। ছবিটিকে ‘বৈচিত্র্যের উদযাপন’ কিংবা ‘অনৈক্যের প্রতীক’— দুভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তবে এই ছবি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনগুলো যেখানে সুসমন্বিত, সেখানে বিমসটেক বেশ স্বতন্ত্র। আসিয়ান সম্মেলনে নেতারা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী বাটিক শার্ট পরেন ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে হাত মেলান।

বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর নেতারা সাত বছরের মধ্যে প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ করেন গত ৪ এপ্রিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্তকারী আঞ্চলিক জোট ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের’ (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এই নেতারা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে এক হয়েছিলেন। এই সমাবেশ আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা ও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান টানাপোড়েনের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে।

বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের উপস্থিতি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের এক স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ছিল। তিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর তাঁকে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাই বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন ও মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সহায়তা আকর্ষণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে। এর কিছু দিন আগেই মিয়ানমারে বিধ্বংসী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে।

এই সম্মেলনে আরেকটি কূটনৈতিক আলোচনার বিষয় ছিল—ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম সাক্ষাৎ। বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে নির্মম ক্র্যাকডাউন চালানোর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান। মোদি-ইউনূস আলোচনা কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়। কারণ, তাঁরা উভয়ই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইউনূস শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের আহ্বান জানান। বিপরীতে মোদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য চাপ দেন।

১৯৯৭ সালে বিমসটেক প্রতিষ্ঠিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের পর নতুন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ যখন ব্যাপকভাবে চলছিল, ঠিক সে সময়টাতেই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা কাঠামো হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জোটটি। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের হাত ধরে এই জোট যাত্রা শুরু করে। জোটের সদস্য দেশগুলোর অবস্থান ও সংস্কৃতি মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও জটিলতাকেই প্রতিফলিত করে।

ভারত ‘লুক ইস্ট’ নীতির মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী ছিল। থাইল্যান্ড দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য পরিপূরক ‘লুক ওয়েস্ট’ নীতি অনুসরণ করছিল। বঙ্গোপসাগরের সীমান্তবর্তী দুটি অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরির অগ্রণী প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেয় দেশ দুটি।

মিয়ানমার শুরুতেই বিমসটেকে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে যোগ দেয় নেপাল ও ভুটান। এর মাধ্যমে জোটের সাত সদস্যের সংখ্যা পূর্ণ হয়। জোটের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে। সে সময় সদস্য দেশগুলো একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) রূপরেখায় সই করে। কিন্তু আলোচনা আটকে থাকে। এর একটি কারণ ছিল—মিয়ানমারের উপস্থিতি। সামরিক শাসনের অধীনে থাকায় দেশটি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল।

২০১০-এর দশকে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়। ২০১১ সালে মিয়ানমার বেসামরিক শাসনে ফেরে। এতে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জোয়ার শুরু হয়। ২০১৬ সালে অং সান সু চির নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার নির্বাচিত হলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়। এতে আঞ্চলিক সংহতি নতুন করে শুরু হওয়ার আশা জাগে। একই সময়ে ২০১৪ সালে ভারতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসে। দেশটি ‘লুক ইস্ট’ নীতিকে আরও শক্তিশালী ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ কৌশলে পরিবর্তন করে। একই বছর বিমসটেকের একটি স্থায়ী সচিবালয় স্থাপন করা হয় ঢাকায়। ২০১৬ সালে জোটের নেতারা ভারতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পান। এটি জোটের কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধির প্রতীকী স্বীকৃতি ছিল।

কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর আঞ্চলিক সহযোগিতার গতি আবারও থমকে যায়। এর পরপরই ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন ফিরে আসে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়। এসব ঘটনা জোটের দুই প্রধান চালিকাশক্তি ভারত ও থাইল্যান্ডের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দেয়।

ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিতে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অঞ্চলটি সম্মিলিতভাবে ‘সেভেন সিস্টার্স অ্যান্ড ওয়ান ব্রাদার’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে—আসাম, মিজোরাম ও সিকিমের মতো রাজ্যগুলো। এই রাজ্যগুলো মূল ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে অবস্থিত এটি এক সরু ভূখণ্ড। সরু অংশে এর প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই পথটি ‘চিকেন’স নেক’ নামে পরিচিত।

ভারতের অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভারত পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দিয়েছে। দেশটি বহুজাতিক ‘এশিয়ান হাইওয়ে’ প্রকল্প নিয়েও কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ভারতকে থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা।

কিন্তু মিয়ানমারের অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পটি ফের থমকে গেছে। এই রুটে মিয়ানমার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট দেশ। থাইল্যান্ডও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে পশ্চিমে নিজেদের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে আগ্রহী। এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্প ছাড়াও থাইল্যান্ড মিয়ানমারে দাওয়েতে একটি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। এই প্রকল্পে তারা জাপানের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। তবে মিয়ানমারের চলমান অস্থিরতা থাইল্যান্ডের ‘লুক ওয়েস্ট’ কৌশলের ওপর কালো ছায়া ফেলেছে।

এতসব বাধা সত্ত্বেও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলন এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্ম দিয়েছে। সম্মেলনে নেতারা ছয়টি নথিতে স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো—সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি। এই চুক্তিতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সামুদ্রিক সংযোগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকটের কারণে বিমসটেক যখন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত ছিল, ঠিক সেই সময়েই—২০০০-এর দশক থেকে চীন এই অঞ্চলের জলসীমায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে থাকে। তথাকথিত ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ বা ‘মুক্তোর মালা’ কৌশলের মাধ্যমে বেইজিং ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ধরে বন্দর, নৌঘাঁটি ও পরিকাঠামোর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এর ফলে সমুদ্রপথে তাদের কৌশলগত প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

২০০৭ সালে চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা বন্দর উন্নয়নে সহযোগিতা শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে মিয়ানমারের কায়াকপায়ু বন্দর প্রকল্পে হাত দেয়। এই প্রকল্পগুলো শেষ হলে আংশিক পরিচালনগত নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। সম্প্রতি জানা গেছে, বেইজিং মিয়ানমারের গ্রেট কোকো দ্বীপে একটি নজরদারি কেন্দ্র তৈরি করছে। ১৯৯০-এর দশকে মিয়ানমার দ্বীপটি চীনের কাছে লিজ দিয়েছিল।

এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত ২০১০ সাল থেকে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে শহরে একটি বন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সিত্তে বন্দরটি কায়াকপায়ুর ঠিক উত্তরে অবস্থিত। একই সময়ে ভারত নিজেদের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সামরিক ও পরিকাঠামোগত উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। সেখানে তারা একটি সমন্বিত কমান্ড বেস স্থাপন করেছে। কৌশলগতভাবে এটি গ্রেট কোকো দ্বীপ থেকে খুব অল্প দূরত্বেই অবস্থিত।

সমুদ্রে চীন ও ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে মিয়ানমার। বিশ্বব্যাপী নিজেদের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে তুলে ধরলেও মিয়ানমারের প্রতি ভারতের নীতি আশঙ্কাজনক। তারা দেশটির সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে। এই কৌশলগত হিসাবটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে স্পষ্ট হয়েছে। সেখানে মোদি মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেছেন। যদিও এর ফলে পশ্চিমা সরকার ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনার ঝুঁকি ছিল।

ভারতের ক্রমবর্ধমান চীনবিষয়ক অস্বস্তি বাংলাদেশের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্চের শেষ দিকে বিমসটেক সম্মেলনের ঠিক আগে ইউনূস বেইজিং সফর করেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জানা যায়, ওই সাক্ষাতে ইউনূস বাংলাদেশকে ভারতের সাতটি ‘ভূখণ্ডে আবদ্ধ’ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের জন্য ‘সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য চীন বাংলাদেশকে ওই অঞ্চলে কৌশলগত প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

এই মন্তব্য ভারতে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ভারতের জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ১৯৬২ সালের চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের বেদনা এখনও সেখানে বিদ্যমান। সূত্রমতে, সম্মেলনে মোদি ইউনূসকে সতর্ক করে বলেন, ‘যেকোনো উসকানিমূলক বক্তব্য এড়িয়ে চলা শ্রেয়।’ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই কূটনৈতিক ফাটল পরিস্থিতি দ্রুত উসকে দেয় এবং দুই দেশ একে অপরের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

বঙ্গোপসাগর অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মাতারবাড়ীতে জাপান ২০১৪ সাল থেকে বন্দর উন্নয়ন করছে। মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রস্তাব পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এটি জাপানকে দেয়। রাশিয়া উন্নয়ন প্রচেষ্টায় যোগ দিতে সম্মত হওয়ায় মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা দাওয়েই বন্দর প্রকল্পে নতুন গতি এসেছে। এদিকে থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পশ্চিম আন্দামান সাগর উপকূলে রানংয়ে একটি নতুন বন্দরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, এটিকে দাওয়েইয়ের বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এটি চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এটি বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ। এই সংযোগ পথই প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম নৌচলাচল পথে তৈরি সুযোগ দিয়েছে। বঙ্গোপসাগর মালাক্কা প্রণালির পশ্চিম প্রবেশদ্বার এবং এই প্রণালি একটি গুরুত্বপূর্ণ চোক পয়েন্ট। এই পথে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এবং মোট তেল সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশ পরিবাহিত হয়।

তবে লজিস্টিক ভূমিকা ছাড়াও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। টোকিওর সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ইয়াসুহিরো কাওয়াকামি বলেন, ‘প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগর একটি আপেক্ষিক “ব্ল্যাঙ্ক স্পট বা কালো বিন্দু”, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই শূন্যতা অন্যান্য শক্তিকে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে এবং এই জলসীমায় প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার করার সুযোগ করে দিয়েছে।’

বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানভাবে স্বীকার করছে। ২০১৮ সালে মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের নাম পরিবর্তন করে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড রাখা হয়। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ছিল। এ ছাড়া মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড কাঠামোতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। এই কাঠামোর অধীনে ওয়াশিংটন বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে যৌথ সামুদ্রিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। তবে এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এখনো বেশ সীমিত।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি অনেক বেশি। সেখানে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনের মতো প্রধান মিত্ররা রয়েছে। তবে ন্যাটো বাহিনী প্রভাবিত আটলান্টিকের চেয়েও এখানে মার্কিন উপস্থিতি কম। দীর্ঘদিন ধরে প্রধানত নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলেও বঙ্গোপসাগর এখন বৃহত্তর অর্থনৈতিক গুরুত্ব লাভ করতে চলেছে। সম্প্রতি বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর সভাপতিত্ব করেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা। তিনি দীর্ঘকাল ধরে আটকে থাকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এটি অঞ্চলের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সাহায্য করবে।

বিমসটেকের সাতটি সদস্য রাষ্ট্রের সম্মিলিত জনসংখ্যা ১৭৩ কোটি। এটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। উন্নত সামুদ্রিক সংযোগ ও বাণিজ্য উদারীকরণ একসঙ্গে আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী সম্ভাবনা তৈরি করে।

শীর্ষ সম্মেলনের সময়টি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘পাল্টাপাল্টি’ শুল্ক ঘোষণার পরপরই। নিরাপত্তা ও বাণিজ্য—উভয় ক্ষেত্রেই ট্রাম্প ২.০ যুগে যুক্তরাষ্ট্র সেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা গঠনে একসময় নিজেই সহায়তা করেছিল। ফলে আঞ্চলিক সংগঠন ও এফটিএগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে সম্মিলিত আত্মরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিকসের উন্নয়ন গবেষণাকেন্দ্রের মহাপরিচালক সো উমেজাকি বলেছেন, মার্কিন নীতির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা আসিয়ানকে তার দীর্ঘদিনের পূর্বমুখী মনোযোগ পুনর্বিবেচনা করতে এবং পশ্চিমাঞ্চলে মনোযোগ ফেরাতে উৎসাহিত করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে একটি বিষয় মোটেও বিস্ময়কর হবে না। সেটি হলো ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিমসটেকের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখানো। এই দুটি দেশই বঙ্গোপসাগরের সীমানায় অবস্থিত।

ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে জড়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা বাড়বেই। যুক্তরাষ্ট্র একতরফা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে আরও বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব তুলনামূলকভাবে সীমিত। ফলে এটি উদীয়মান বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি হতে চলেছে।

অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত