আজাদুর রহমান চন্দন
গৃহযুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য শর্ত সাপেক্ষে একটি প্যাসেজ বা করিডর দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে। দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কোনো অনির্বাচিত সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। কারও কারও আশঙ্কা, এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রশ্নের মুখে এখন কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি।
বিশ্বের যেসব সংঘাতময় অঞ্চলে মানুষ খাদ্য, ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না, তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্বের যেসব জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর হয়েছে তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি তৃতীয় পক্ষ, বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। মূলত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত ৪৬/১৮২ এবং ৫৮/১১৪ নম্বর রেজল্যুশনে এ ধরনের মানবিক নীতির অনুমোদন দেওয়া আছে। কিন্তু রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জাতিসংঘের কোনো ফোরামে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে তথ্য নেই। তাহলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের লোকজন কেন বিষয়টি নিয়ে এত সরব? পেছন থেকে কলকাঠিটা নাড়ছে কে?
রাখাইনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের ধারণা দিয়েছিলেন। ওই আলোচনা সভায়ই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করা এবং মানবিক করিডর খোলার প্রস্তাব দেন। এরপর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে। এর কয়েক দিন পরই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন এবং কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম দাবি করে, জাতিসংঘ মহাসচিবের ওই সফরকালেই নাকি রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কিন সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডিং জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল পি. ভওয়েলের বাংলাদেশ সফরকেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর ৮ এপ্রিল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরেন।
রাখাইনের সঙ্গে করিডর তৈরির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের প্রবল আগ্রহ গোপন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বৈরথ, তার রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা। বিশেষ করে বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইদানীং অত্যধিক গুরুত্ব পাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ধীরে ধীরে নজর সরিয়ে এনেছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনায় ইন্দো-প্যাসিফিক হচ্ছে প্রধান অংশ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশ আছে এক ডজনের বেশি। আছে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আছে জাপান-কোরিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তি। ২০২১ সালে ঘোষিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে, ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা, সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি, যার ৫৮ শতাংশই আবার তরুণ। কর্মশক্তি এবং ভোক্তা—দুই হিসাবেই সংখ্যাটা বিশাল। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে, ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র। এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বাড়লে এখানকার সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ওপর চীনের একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
বঙ্গোপসাগরের পানি ঘোলা হওয়ার চিত্র ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এই অঞ্চলে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক মাইন্ডগেম। বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে কয়েকটি সুপার পাওয়ারের সর্বগ্রাসী যুদ্ধের রণাঙ্গন বানানোর চক্রান্ত চলছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এ অঞ্চলে চীন, ভারত, জাপান, রাশিয়ার স্বার্থও কম নয়। রাখাইনে চীনের ৯০০ কোটি ডলারের বিশাল কিয়াউকপিউ প্রজেক্ট যেমন আছে, তেমনি ভারতেরও আছে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট। ভারতের কলকাতা বন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের মাধ্যমে মিজোরামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প ভারতের ড্রিম প্রজেক্ট হিসেবে বিবেচিত। রাখাইন রাজ্যের যে অংশটুকু এখনো রাশিয়ার সহায়তায় চীনের দখলে আছে, সেই অংশ অর্থাৎ সিতওয়ে বন্দর এবং কিয়াউকপিউ বন্দর মুক্ত করতে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ আসন্ন। যৌথভাবে এই যুদ্ধ শুরু করতে পারে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ আরসা এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এদের ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য এখন বাংলাদেশকে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের। তারা মিয়ানমারের সব কটি বিদ্রোহী গ্রুপকে এক ছাতার নিচে এনে একটা শক্তিশালী আক্রমণ চালিয়ে সিতওয়ে এবং কিয়াউকপিউ বন্দর মুক্ত করতে চায়। এটা করতে পারলেই রাখাইনের পুরোটা মিয়ানমার জান্তামুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ আরাকান রাষ্ট্র হয়ে যাবে, যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। পুরো মিশনটির সাফল্য নির্ভর করছে কক্সবাজারের শিলখালীতে একটি বেজক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করতে পারার ওপর। রাখাইন দখলে নেওয়ার এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে যেভাবে জড়ানোর তথ্য বিদেশি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে, সেগুলো রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো।
দেশে দেশে মানবিক করিডর চালুর অভিজ্ঞতা এমনিতেই সুখকর নয়। অনেক জায়গায়ই তা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি—এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষের এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানিও ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাখাইন একটি অতি সংঘাতপূর্ণ এলাকা। সেখানে কিছু করতে গেলে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের লিখিত সম্মতি থাকতে হবে। মিয়ানমার সরকারের সম্মতি ছাড়া করিডর চালু করা হলে আন্তর্জাতিক আইনে তা বৈধতা পাবে না। আর আন্তর্জাতিক কাঠামো ও রীতিনীতির আওতায় প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রভাবশালী বিভিন্ন পক্ষ এমন করিডরের ধারণা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোনো অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার দাবি তুলতে পারে।
মানবিক করিডরের মধুর ও মুখরোচক নামের আড়ালে বাংলাদেশকে প্রক্সি যুদ্ধে জড়ালে লাভের গুড় পুরোটাই যাবে যুক্তরাষ্ট্রের পেটে। নিজের স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা কিংবা ভূখণ্ড খণ্ডবিখণ্ড হলো কি না, সে দিকে ফিরেও তাকাবে না; যেমন তাকাচ্ছে না ইউক্রেনের জনগণ ও হাতছাড়া হওয়া ভূখণ্ডের দিকে। মনে রাখতে হবে, ভারতের সেনাবাহিনীর দুটো ডিভিশন মিয়ানমারে অবস্থান করছে। চীন কিয়াউকপিউ বন্দরসহ তার বিআরআই রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। নীরব থাকবে না রাশিয়াও। কারণ, মিয়ানমারে সেও যৌথ প্রকল্পের অংশীদার। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থটা কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
আরও খবর পড়ুন:
গৃহযুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য শর্ত সাপেক্ষে একটি প্যাসেজ বা করিডর দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে। দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কোনো অনির্বাচিত সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। কারও কারও আশঙ্কা, এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রশ্নের মুখে এখন কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি।
বিশ্বের যেসব সংঘাতময় অঞ্চলে মানুষ খাদ্য, ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার-সংক্রান্ত আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না, তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্বের যেসব জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর হয়েছে তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি তৃতীয় পক্ষ, বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। মূলত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত ৪৬/১৮২ এবং ৫৮/১১৪ নম্বর রেজল্যুশনে এ ধরনের মানবিক নীতির অনুমোদন দেওয়া আছে। কিন্তু রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জাতিসংঘের কোনো ফোরামে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে তথ্য নেই। তাহলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের লোকজন কেন বিষয়টি নিয়ে এত সরব? পেছন থেকে কলকাঠিটা নাড়ছে কে?
রাখাইনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের ধারণা দিয়েছিলেন। ওই আলোচনা সভায়ই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করা এবং মানবিক করিডর খোলার প্রস্তাব দেন। এরপর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে। এর কয়েক দিন পরই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন এবং কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম দাবি করে, জাতিসংঘ মহাসচিবের ওই সফরকালেই নাকি রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মার্কিন সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডিং জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল পি. ভওয়েলের বাংলাদেশ সফরকেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর ৮ এপ্রিল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরেন।
রাখাইনের সঙ্গে করিডর তৈরির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের প্রবল আগ্রহ গোপন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বৈরথ, তার রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা। বিশেষ করে বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইদানীং অত্যধিক গুরুত্ব পাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ধীরে ধীরে নজর সরিয়ে এনেছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনায় ইন্দো-প্যাসিফিক হচ্ছে প্রধান অংশ। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশ আছে এক ডজনের বেশি। আছে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আছে জাপান-কোরিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তি। ২০২১ সালে ঘোষিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে, ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা, সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি, যার ৫৮ শতাংশই আবার তরুণ। কর্মশক্তি এবং ভোক্তা—দুই হিসাবেই সংখ্যাটা বিশাল। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপির পরিমাণ বৈশ্বিক জিডিপির ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে, ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র। এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বাড়লে এখানকার সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ওপর চীনের একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
বঙ্গোপসাগরের পানি ঘোলা হওয়ার চিত্র ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এই অঞ্চলে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক মাইন্ডগেম। বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে কয়েকটি সুপার পাওয়ারের সর্বগ্রাসী যুদ্ধের রণাঙ্গন বানানোর চক্রান্ত চলছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এ অঞ্চলে চীন, ভারত, জাপান, রাশিয়ার স্বার্থও কম নয়। রাখাইনে চীনের ৯০০ কোটি ডলারের বিশাল কিয়াউকপিউ প্রজেক্ট যেমন আছে, তেমনি ভারতেরও আছে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট প্রজেক্ট। ভারতের কলকাতা বন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরের মাধ্যমে মিজোরামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প ভারতের ড্রিম প্রজেক্ট হিসেবে বিবেচিত। রাখাইন রাজ্যের যে অংশটুকু এখনো রাশিয়ার সহায়তায় চীনের দখলে আছে, সেই অংশ অর্থাৎ সিতওয়ে বন্দর এবং কিয়াউকপিউ বন্দর মুক্ত করতে এক সর্বাত্মক যুদ্ধ আসন্ন। যৌথভাবে এই যুদ্ধ শুরু করতে পারে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ আরসা এবং চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এদের ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য এখন বাংলাদেশকে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের। তারা মিয়ানমারের সব কটি বিদ্রোহী গ্রুপকে এক ছাতার নিচে এনে একটা শক্তিশালী আক্রমণ চালিয়ে সিতওয়ে এবং কিয়াউকপিউ বন্দর মুক্ত করতে চায়। এটা করতে পারলেই রাখাইনের পুরোটা মিয়ানমার জান্তামুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ আরাকান রাষ্ট্র হয়ে যাবে, যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। পুরো মিশনটির সাফল্য নির্ভর করছে কক্সবাজারের শিলখালীতে একটি বেজক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করতে পারার ওপর। রাখাইন দখলে নেওয়ার এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে যেভাবে জড়ানোর তথ্য বিদেশি সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে, সেগুলো রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো।
দেশে দেশে মানবিক করিডর চালুর অভিজ্ঞতা এমনিতেই সুখকর নয়। অনেক জায়গায়ই তা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি—এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষের এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানিও ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাখাইন একটি অতি সংঘাতপূর্ণ এলাকা। সেখানে কিছু করতে গেলে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের লিখিত সম্মতি থাকতে হবে। মিয়ানমার সরকারের সম্মতি ছাড়া করিডর চালু করা হলে আন্তর্জাতিক আইনে তা বৈধতা পাবে না। আর আন্তর্জাতিক কাঠামো ও রীতিনীতির আওতায় প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রভাবশালী বিভিন্ন পক্ষ এমন করিডরের ধারণা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোনো অঞ্চলের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার দাবি তুলতে পারে।
মানবিক করিডরের মধুর ও মুখরোচক নামের আড়ালে বাংলাদেশকে প্রক্সি যুদ্ধে জড়ালে লাভের গুড় পুরোটাই যাবে যুক্তরাষ্ট্রের পেটে। নিজের স্বার্থ হাসিল হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের দুর্দশা কিংবা ভূখণ্ড খণ্ডবিখণ্ড হলো কি না, সে দিকে ফিরেও তাকাবে না; যেমন তাকাচ্ছে না ইউক্রেনের জনগণ ও হাতছাড়া হওয়া ভূখণ্ডের দিকে। মনে রাখতে হবে, ভারতের সেনাবাহিনীর দুটো ডিভিশন মিয়ানমারে অবস্থান করছে। চীন কিয়াউকপিউ বন্দরসহ তার বিআরআই রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। নীরব থাকবে না রাশিয়াও। কারণ, মিয়ানমারে সেও যৌথ প্রকল্পের অংশীদার। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থটা কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
আরও খবর পড়ুন:
‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’ নামে আরও একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে, যার চেয়ারম্যান হয়েছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রধান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। মহাসচিব হিসেবে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, যিনি দুই বছর আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
৮ ঘণ্টা আগেবর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি রাষ্ট্র—ভারত, বাংলাদেশ ও চীন। এই ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের ভেতরে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, উন্নয়ন, আধিপত্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।
৮ ঘণ্টা আগেগ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। আর আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত গ্যাসনির্ভর। গ্যাসও চাহিদার তুলনায় কম। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ালে নগরজীবনে সাময়িক স্বস্তি মিললেও চরম সংকট তৈরি হয় শিল্প খাতে।
৮ ঘণ্টা আগেপৃথিবীর ঘূর্ণন চক্রের সঙ্গে সঙ্গে সবই ঘোরে, কালের চক্রও। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে আবির্ভাব যেমন ঘটছে বা আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতির জীব, তেমনি এ গ্রহের বুক থেকে তাদের কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন বিলুপ্তি। একসময় পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াত যে ডাইনোসর..
১ দিন আগে