Ajker Patrika

কত নম্বর ঢেউ চলছে বুঝবেন কীভাবে?

আজাদুল আদনান, ঢাকা
Thumbnail image

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণের তীব্রতা কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। কমা–বাড়ার এই নিয়মকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন বিশেষজ্ঞেরা। মাঝেমধ্যেই বিশেষজ্ঞদের বলতে শোনা যায়—এবার দ্বিতীয় ঢেউ শেষের পথে কিংবা তৃতীয় ঢেউ এই শুরু হলো বলে। কথা হলো—এই ঢেউটি তাঁরা কীভাবে শনাক্ত করেন?

গত বছরের মার্চে দেশে মহামারি করোনার প্রকোপ শুরু হয়। সে হিসেবে সেটিই হলো প্রথম ঢেউয়ের শুরুর বিন্দু। প্রায় দেড় বছরে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের তাণ্ডব থামাতে বিভিন্ন সময়ে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এতে করে সংক্রমণের মাত্রা কখনো কমেছে আবার কখনো বেড়েছে। শুরুর দুই মাসে সংক্রমণের হার ৫–১০ শতাংশের মধ্যেই ছিল। এই হারও সময়ের সঙ্গে কমে এলে সবাই একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আবার ‘দ্বিতীয় ঢেউ আসছে’ বলে গুঞ্জন শুরু হলো। এই গুঞ্জনকে সত্যি প্রমাণ করে চলতি বছরের মার্চে সংক্রমণ বাড়তে থাকল। তারপর কিছুটা কমে এখন আবার তা বেড়ে ৩১ শতাংশের কাছাকাছি।

তাহলে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের কততম ঢেউ চলছে বলা যায়? প্রথমটি তো নিশ্চিত। দ্বিতীয়টি শুরু হয়েছে আগেই তারপর সংক্রমণ কমে আবার বাড়ছে। তাহলে কি তৃতীয় ঢেউ চলছে এখন দেশে। উত্তরটি পেতে হলে মহামারি চলাকালে কোন পরিস্থিতিকে নতুন একটি ঢেউ বলা হবে তা স্পষ্ট হতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণের হার যদি ৫ শতাংশের নিচে নামে তাহলে একটি ঢেউ শেষ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর পুনরায় যদি শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী হয়, তাহলে সেটিকে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে ধরে নিতে হবে।

মহামারির এই ঢেউয়ের হিসাব অবশ্য নতুন নয়। ১৮৮৯ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত চলা ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় থেকেই ঢেউয়ের ধারণাটি তৈরি হয়। প্রথমে তাণ্ডব চালানোর পর সংক্রমণের মাত্রা একেবারে নিম্নমুখী হয়েছিল। সেখান থেকে পুনরায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হলে সেটিকে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তবে ঢেউয়ের ধারণটি স্পষ্ট হয় ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুর সময়ে।

এই ওয়েভ বা ঢেউ ধারণাটি ব্যাপকভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়। ১৯১৮ সালের মার্চে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লেও শুরুতে তা অত ভয়ানক ছিল না। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল, আবার সেরেও উঠছিল। কিন্তু ওই বছরের শেষ নাগাদ শীতের সময় ভাইরাসটি প্রাণঘাতী রূপ নিল। সে সময়ে একে ঢেউ হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা না হলেও স্প্যানিশ ফ্লু সম্পর্কিত ইতিহাসে একে দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবেই বরাবর উল্লেখ করা হচ্ছে। ১৯১৮ থেকে ১৯২০, কেউ কেউ বলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই মহামারিতে বিশ্বের ২–৫ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। এ সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক–বেসামরিক মিলিয়ে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। সে যা–ই হোক, করোনা মহামারি আসার আগে থেকেই মহামারির বিভিন্ন ধাপ বোঝাতে এই ওয়েভ বা ঢেউয়ের কথা বারবার এসেছে। আর করোনার সময় এই ঢেউ গোনাটাই যেন মানুষের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনা এ ক্ষেত্রে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে ভাইরাসটি উৎপত্তির পর সর্বপ্রথম ইউরোপে আঘাত হানে। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় রাশিয়া, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলো। পর্যায়ক্রমে ভাইরাসটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং সবশেষে দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়ানক রূপ নেয়। বিশ্বের একেক দেশে একেক সময় ভাইরাসটির প্রকোপ বেড়েছে, কমেছে। যেমন একেবারে শুরুর দিকে ইতালির সংক্রমণ ও মৃত্যুহার সবাইকে চমকে দিয়েছিল। তারপর স্পেনের পরিস্থিতিও ভয় ছড়িয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তো সবার মেরুদণ্ড বরাবর এক শিরশিরে অনুভূতি দিয়েছে। এসব দেশের কোনোটিতে করোনা সংক্রমণ একবার ব্যাপক বৃদ্ধির পর তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা গেছে। কোনোটিতে বারবার ফিরে এসেছে করোনার ভয়াবহতা। ফলে কোন দেশে কতবার করোনা পরিস্থিতি নাজুক হলো, তার ওপর নির্ভর করছে, ওই দেশে করোনার কততম ঢেউ চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দীর্ঘদিন লকডাউন ও কারফিউয়ের পর ইউরোপের দেশগুলোতে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিকের দিকে গিয়েছিল। কিন্তু অবাধ চলাফেরায় আবারও নতুন ঢেউ শুরুর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একই পথে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। যেখানে তৃতীয় ঢেউ আসার পথে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে চলছে চতুর্থ ঢেউ। সংক্রমণের চূড়ায় থাকা বাংলাদেশও তৃতীয় ঢেউয়ের দ্বারপ্রান্তে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বে–নজির আহমেদের মতে, পৃথিবীতে মহামারি পুরোনো হলেও ঢেউয়ের হিসাবটি নতুনই বলা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের বেশি, এটি যদি কমাতে পারি তাহলে আমরা বলতে পারতাম আমাদের দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হয়ে গেছে। ঢেউয়ের বিষয়টি আসলে বৈজ্ঞানিক কোনো পরিচিতি নয়। সংক্রমণের অবস্থাটা সাধারণ মানুষকে বোঝাতেই কথাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

ঢেউয়ের স্থায়ীত্বের ব্যাপারে বে–নজির আহমেদ বলেন, করোনা নিয়ে আমাদের দুটি অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটি হলো—সার্স, অন্যটি মার্সকভ। সার্স অনেক দেশে ছড়িয়েছে, তবে স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মাস। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ও কোরিয়ায় মার্সকভ শনাক্ত হয়েছিল। যার স্থায়িত্ব ছিল কয়েক বছর। তবে এগুলো এখন নেই। বর্তমানে থাকা করোনার ধরনটি সবচেয়ে মারাত্মক বলেও জানান তিনি।

তবে ঢেউয়ের বিষয়টি শুধু সাধারণ মানুষকে মহামারি পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য বললে ভুল থেকে যাবে। কারণ, লেখচিত্র বা গ্রাফে সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেখাটি ঊর্ধ্বমুখী থাকলে মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিকল্পনা এক রকম থাকবে এবং নিম্নমুখী থাকলে সে পরিকল্পনা আলাদা হবে। কিছুদিন আগে ইউনিসেফ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে জর্জিয়ায় করোনার তিনটি ঢেউয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে করোনা সংক্রমণের প্রবণতা যেমন বিচার করা হয়েছে, তেমনি কোন ঢেউ নিয়ন্ত্রণে কী কাজে লাগল, তাও বিশ্লেষণ কর হয়েছে। একই সঙ্গে পরবর্তী ঢেউ থামাতে করণীয় নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে নিবন্ধটির উপসংহারে। গবেষণা নিবন্ধটিতে অবশ্য প্রথম ঢেউয়ের সমাপ্তি বিন্দু হিসেবে সংক্রমণ হার ৬ শতাংশের নিচে দেখানো হয়েছে।

আর বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার–এ প্রকাশ করা হয় এ সম্পর্কিত আরেকটি প্রতিবেদন, যেখানে মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ঢেউ বিশ্লেষণের কথা বলা হয়েছে বেশ জোরের সঙ্গে। এতে শুধু চলমান করোনা মহামারি নয়, স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ের বিভিন্ন ঢেউগুলোর দিকেও তাকানোর কথা বলা হয়েছে। ফলে এটা নিশ্চিত যে, মহামারিকালে এই ঢেউ বিশ্লেষণ জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি বোঝার জন্যই ভীষণভাবে জরুরি। বিদ্যমান বাস্তবতা যেমন, তেমনি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত