Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /মিয়ানমারের বিরল খনিজে নজর যুক্তরাষ্ট্রের, বিদ্রোহীদের পক্ষে টানছে ট্রাম্প প্রশাসন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৫, ১২: ৩১
মিয়ানমারে বিরল খনিজের খনি। ছবি: ডয়েচে ভেলে
মিয়ানমারে বিরল খনিজের খনি। ছবি: ডয়েচে ভেলে

মিয়ানমারের বিরল খনিজ সম্পদের দিকে চোখ পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মিয়ানমারের বিরল খনিজে চীনের কর্তৃত্ব সরিয়ে নিতে এবার ট্রাম্প প্রশাসন হাত মেলাচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। এমনকি দেশটির ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলোতে আসছে শিথিলতা, হচ্ছে প্রত্যাহারও। চারটি সূত্র বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছে।

সূত্রদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের বিরল খনিজে কর্তৃত্ব নিতে খনি অঞ্চলগুলোতে থাকা জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তি করতে হতে পারে ট্রাম্প প্রশাসনকে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি ওয়াশিংটন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরবরাহ সংক্রান্ত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

মিয়ানমারের বিরল খনিজ হাতে পেতে যেসব প্রস্তাব ট্রাম্প প্রশাসনের সামনে এসেছে তার মধ্যে একটি হলো, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপ দ্য কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো। অন্য একটি প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, জান্তাকে উপেক্ষা করে সরাসরি কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে কাজ করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর থেকে দেশটির সামরিক নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার পথ এড়িয়ে চলছে ওয়াশিংটন। এখন এসব প্রস্তাব ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরেছেন একজন মার্কিন ব্যবসায়িক লবিস্ট, অং সান সু চির সাবেক এক উপদেষ্টা, কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে পরোক্ষ সংলাপে যুক্ত কয়েকজন এবং কিছু বাইরের বিশেষজ্ঞ।

চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বিরল খনিজের মজুতকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র এই খনিজ আমদানির ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে ৯০ শতাংশ বিরল খনিজ সরবরাহের ক্ষমতা চীনের হাতে।

বিরল খনিজ আলোচনা নিয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনোভাবে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে তা হবে দেশটির নীতিতে এক বড় ধরনের মোড়। কারণ, মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো সহিংসতাকে ওয়াশিংটন ‘গণহত্যা’ ও ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

তবে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ার কথা জানা গেছে। গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন মিয়ানমার জান্তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এটি মিয়ানমার সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক নীতিতে কোনো বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না।

সূত্রের বরাতে রয়টার্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রস্তাবিত পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে আরও আছে, মিয়ানমারের বিরল খনিজ ভারতে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা, জান্তা সরকার ও তাদের মিত্রদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা, মিয়ানমারের ওপর ট্রাম্প ঘোষিত ৪০ শতাংশ শুল্ক হ্রাসের কথা বিবেচনা করা এবং এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করা।

গত ১৭ জুলাই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের কার্যালয়ে একটি বৈঠকে মিয়ানমার প্রসঙ্গে কিছু প্রস্তাব আলোচনায় আসে বলে জানিয়েছেন ভ্যান্সের কার্যালয়ের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র। ওই বৈঠকে ছিলেন এক সময়কার মিয়ানমারে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের প্রধান অ্যাডাম কাস্তিলো। তিনি বর্তমানে দেশটিতে একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এ ছাড়া ভ্যান্সের এশিয়া বিষয়ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত উপদেষ্টারাও বৈঠকে অংশ নেন। যদিও ভ্যান্স নিজে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না।

রয়টার্সকে অ্যাডাম কাস্তিলো বলেন, মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে চীনের কৌশল অনুসরণ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও কাচিন বিদ্রোহীদের (কেআইএ) মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে ওয়াশিংটনকে অনুরোধ করেছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার এবং কাচিন বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পায়নি রয়টার্স।

কাস্তিলোর হোয়াইট হাউস সফর সম্পর্কে ভ্যান্সের কার্যালয় মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও, পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত একজন ব্যক্তি জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেকের পর থেকেই তাঁর প্রশাসন মিয়ানমার নিয়ে নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করছে। এর মধ্যে জান্তার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে বাণিজ্য ও শুল্ক ইস্যুতে সমঝোতার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

হোয়াইট হাউসও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

মিয়ানমার নিয়ে হোয়াইট হাউসে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং অনুসন্ধানমূলক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্র। তারা বলেন, আলোচনাগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো কৌশলগত পরিবর্তনের দিকে যেতে নাও পারে, কারণ ট্রাম্প প্রশাসন বিদেশি সংঘাতে হস্তক্ষেপ এবং মিয়ানমারের জটিল সংকট নিয়ে সাধারণত সতর্ক অবস্থান নিয়ে চলে।

১৭ জুলাইয়ের ওই বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকটি মার্কিন ব্যবসায়িক মহলের সম্মানার্থে করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিয়ানমারের সঙ্গে ৫৭৯ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি সামলানোর চেষ্টার অংশ ছিল এ বৈঠক।

মিয়ানমারের কাচিন অঞ্চলের খনিগুলো থেকে বিরল খনিজ উত্তোলন করে চীনে রপ্তানি করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই খনিগুলোকে চীনের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’ বলে অভিহিত করেন অ্যাডাম কাস্তিলো। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে দ্য কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) চীনের শোষণে ক্লান্ত এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।

কাস্তিলো বলেন, তিনি বারবার ওয়াশিংটনে কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন যুক্তরাষ্ট্র কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করে, যাতে কোয়াড জোটের অংশীদারদের, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণে সহযোগিতা এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারী বিরল খনিজ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। কোয়াড হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের একটি কৌশলগত জোট।

এ বিষয়ে ভারতের খনি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব মেলেনি।

ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের সঙ্গে বিরল খনিজ সংক্রান্ত কোনো পরিকল্পনা করতে চায় কি না এ বিষয়ে তিনি জানেন না। তবে যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে এটি বাস্তবায়নে কয়েক বছর লেগে যাবে, কারণ বিরল খনিজ প্রক্রিয়াজাত করতে নতুন এক অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ এবং অং সান সু চির সাবেক উপদেষ্টা শন টারনেল বলেন, তার বিরল খনিজ সংক্রান্ত প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ছিল ট্রাম্প প্রশাসন যেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সমর্থন অব্যাহত রাখে, সে আহ্বান জানানো। চলতি বছরের শুরুতে ওয়াশিংটন সফরের সময় টারনেল জানান, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং কংগ্রেসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং মিয়ানমারের বিরোধী পক্ষের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবগুলোর একটি ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র কেআইএর মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে বিরল খনিজে প্রবেশাধিকার পেতে পারে। এই গোষ্ঠীগুলো চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চায়।

গত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাচিন বিদ্রোহীদের, বিশেষ করে বিরল খনিজ ইস্যুতে, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে একাধিক আলোচনাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই আলোচনার সঙ্গে যুক্ত একজন সূত্র। তবে এই আলোচনা এখনো পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মিয়ানমারে এরই মধ্যে বিরল খনিজ খনি এলাকা থেকে জান্তা ও তাদের মিত্রদের হটিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বর্তমানে এসব খনি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কেআইএর হাতে।

এক বিরল খনিজ শিল্পের সূত্র জানিয়েছেন, প্রায় তিন মাস আগে কাচিনদের হাতে চিপউয়ে-পাংওয়া খনিজ বেল্টের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কাচিনদের খনিজ খনিশিল্প সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা চেয়ে যোগাযোগ করেন।

তবে সূত্রটি এটাও যোগ করেছেন, নতুন করে বড় ধরনের বিরল খনিজ সরবরাহ চেইন তৈরি করা সম্ভব নাও হতে পারে, কারণ এর জন্য খনিজগুলোকে দূরবর্তী ও দুর্গম কাচিন রাজ্য থেকে বের করে ভারতে নিয়ে যেতে হবে, যেটা অত্যন্ত কঠিন।

কাচিন রাজ্য বিশেষজ্ঞ সুইডিশ লেখক বারটিল লিন্টনার বলেন, “চীনের নাকের ডগা থেকে বিরল খনিজ নিয়ে যাওয়ার চিন্তা ‘পুরোপুরি পাগলামি’। ” কারণ, অঞ্চলটি পর্বতবেষ্টিত, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল।

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি এসব খনি থেকে বিরল খনিজ ভারতে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে শুধু একটি রাস্তাই ব্যবহার করা সম্ভব। আর চীন নিশ্চয়ই হস্তক্ষেপ করবে এবং সেটা বন্ধ করে দেবে।’

অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক একঘরে অবস্থার পর জান্তা সরকার এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী বলেই মনে হচ্ছে। চলতি মাসে ট্রাম্প যখন মিয়ানমার থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দেন, তিনি সেটি জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের উদ্দেশে স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে জানান।

জবাবে মিন অং হ্লাইং ট্রাম্পের ‘দৃঢ় নেতৃত্বের’ প্রশংসা করে শুল্ক হ্রাস ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে তিনি জানান, প্রয়োজনে ওয়াশিংটনে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠাতে প্রস্তুত তিনি।

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেছেন, জান্তা প্রধানের ওই চিঠির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই।

অনুবাদ করেছেন ফারহানা জিয়াসমিন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত