অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
‘বাসুধৈব কুটুম্বকম’—বিশ্ব একটি পরিবার, এই মহৎ বার্তা দিয়েই ভারত নিজ দেশে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের সামনে নিজ দেশের দর্শন তুলে ধরেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একটি জাতিকে নির্মূল করার যুদ্ধে মদদ দিয়ে, যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমন করে, এমনকি শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণকারী এক রাষ্ট্রকে কূটনৈতিকভাবে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে—ভারত ঠিক কী বার্তা দিচ্ছে বিশ্বের কাছে?
গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণ গোলার্ধে নৈতিক নেতৃত্বের দাবিদার ভারত আজ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের নীরব (এবং কার্যকর) অংশীদারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে দেশটির সঙ্গে সহযোগিতা-মৈত্রী বাড়িয়ে এই অংশীদারত্ব এগিয়ে নিচ্ছে ভারত।
স্বাধীন হওয়ার পর থেকে—মূলত কংগ্রেস সরকারগুলোর আমলে—ভারত কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকলেও কৌশলগত কারণে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকারের আমলেও এমন অবস্থানই ছিল। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি নিজেও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষেও ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আর কোনো রাখঢাক করছে না। পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ার কারণেই ভোটের রাজনীতিতে সব সময় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে ভারত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যেভাবে রাজনীতির মেরুকরণ করেছে, মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা এবং সরকারি পদক্ষেপ যেভাবে ভারতকে ধর্মীয় বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে সেটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নেতারা বক্তৃতা করলেও ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত। ইসরায়েলের প্রতি ভারতের অবস্থান তখনই অনেকখানি স্পষ্ট হয়। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে ইসরায়েল কনস্যুলেট খোলে।
পুরো স্নায়ুযুদ্ধ কালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে ছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার পেছনে ভারতেরও অবদান আছে। আবার ওই সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম রূপকার ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দুই ব্লকের সঙ্গে আপাত দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেওয়ার কারণেই সম্ভবত সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলেছে ভারত।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর নিজেদের গুটিয়ে রাখেনি নয়াদিল্লি। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে।
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চায় ভারত। এ সময় তো বটেই, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও ভারতকে অস্ত্র দেয় ইসরায়েল। অবশ্য ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চাওয়ার আরেকটি কারণও ছিল—১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতায় পরিণত হয় ভারত। ২০১৯ সালেই ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে যৌথ কর্মসূচি নেয় ভারত ও ইসরায়েল।
চীনও ইসরায়েলের অস্ত্রের বড় ক্রেতা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়ায় সেটি আর এগোতে পারেনি। ২০০১ সালে জুলাইয়ে চীনের সঙ্গে চারটি ফ্যালকন রাডার সিস্টেম চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। ফলে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের মতো ক্রেতা লুফে নিয়েছে তেল আবিব। সমরাস্ত্র বেচাকেনা পর্যবেক্ষকদের হিসাবে, ভারত এখন ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। যেখানে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের বেশি অস্ত্রের বাণিজ্য হয় এই দুই দেশে।
কিন্তু গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সম্পর্ক বিস্ময়কর হারে বেড়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে ১৮৫ মিলিয়নেরও বেশি। আজ ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। ড্রোন, নজরদারি যন্ত্র, নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা প্রযুক্তি আসছে ভারতে।
এসব অস্ত্র ‘ব্যাটল-টেস্টেড।’ অর্থাৎ, ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরে বাস্তব যুদ্ধের ময়দানে এসব অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষিত। যে অস্ত্র ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর প্রয়োগ করে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়, সেই অস্ত্র কিনে ভারত পরোক্ষভাবে বৈধতা দিচ্ছে দখলদারিত্ব, জাতিগত নিধন ও গণবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যেতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার লেখক-সাংবাদিক অ্যান্টনি লোয়েনস্টেইনের বই ‘দ্য প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি’ থেকে।
গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন—যাদের বড় একটি অংশই নারী ও শিশু। হাসপাতালগুলো ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, ত্রাণবাহী যানবাহনে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে, ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার প্রধান ক্রেইগ মকহিবার এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ‘পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও সুসংগঠিত গণহত্যা’ হিসেবে। তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘এটি পাঠ্যবইয়ে উঠে আসার মতো গণহত্যা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের মতো ভারতও এতে সম্পূর্ণভাবে জড়িত।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর যখন বিশ্ব অপেক্ষা করছিল প্রকৃত তথ্যের জন্য, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন বিশ্বের প্রথম নেতাদের একজন, যিনি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তিনি ইসরায়েলের গাজায় বেসামরিক লোকদের নির্বিচারে হত্যার নিন্দা তো করেনইনি, উল্টো ভারতে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলন দমন করে চলেছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলোতে মানবিক মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিরও অনুমতি দেওয়া হয়নি। সহানুভূতির প্রকাশকেই অপরাধ বানিয়ে তোলা হয়েছে। যে ভারত একসময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ইয়াসির আরাফাতকে স্বাগত জানিয়েছিল, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছিল, সেই ভারতই আজ একটি বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র।
ভারতজুড়ে অনেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দিল্লি থেকে কেরালা—শিল্পীরা গাজা নিয়ে ছবি আঁকছেন, আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে চিঠি দিচ্ছেন, শিক্ষকেরা আয়োজন করছেন ‘টিচ-ইন’, মুসলমানরা প্রার্থনার আয়োজন করছেন। কিন্তু এসব প্রতিবাদও দমন করা হচ্ছে। ডিজিটাল নজরদারি চলছে, গোদি মিডিয়া তাদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। শান্তিপূর্ণ কর্মীদের বিরুদ্ধে লাগানো হচ্ছে ইউএপিএ-এর মতো কঠোর আইনের মামলা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো এখানেও তাদের নৈতিক অবস্থান ধরে রেখেছে। সিপিআই (এম) সরাসরি ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করে ইসরায়েলি বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছে এবং নাগরিকদের প্রতিবাদের অধিকার রক্ষার দাবি জানিয়েছে। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারত সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে যে কৌশলগত সখ্য গড়ে তুলছে, তা আমাদের ঔপনিবেশিক বিরোধী ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’ কৃষক আন্দোলনের ছত্রচ্ছায়া সংস্থা সংযুক্ত কিষান মোর্চাও ফিলিস্তিনি লড়াইয়ের সঙ্গে নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামের মিল টেনেছে।
ভারত কেবলই পৃথিবীর আর দশটা রাষ্ট্রের মতো নয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে মৈত্রী করে ভারত তারই ইতিহাস ও নীতিবোধকে কলঙ্কিত করছে। এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হিসেবে ভারত জানে দখলদারিত্বের ব্যথা কেমন। বিভাজনের রক্তাক্ত ইতিহাস ও সহিংসতার ক্ষত আজও গভীর। অথচ সেই অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় সহায়তা করা—এ এক নির্মম আত্মবিস্মৃতি।
ভারতের উচিত বিশ্বের সামনে সত্যিকার ‘ডিকলোনাইজেশন’-এর ডাক দেওয়া। কাশ্মীর বা শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বললে গাজায় গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
একটি মর্যাদাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির মানে হওয়া উচিত—গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করা, ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহযোগিতা স্থগিত করা, জাতিসংঘে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া, আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে (আইসিজে, আইসিসি) স্বাধীন তদন্তে সহায়তা করা, দেশের ভেতর ফিলিস্তিনপন্থী কণ্ঠগুলোকে সুরক্ষিত রাখা।
গাজায় যা ঘটছে, তা ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়। আজ নয়, ভবিষ্যতে এই সময়টিকে মনে রাখা হবে—কে কোথায় দাঁড়িয়েছিল, সেই হিসাব রচনা হবে। ভারত যদি সত্যিই নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে তাকে অস্ত্র নয়, মূল্যবোধের দিকেই ফিরে তাকাতে হবে। কারণ ফিলিস্তিনের প্রশ্ন শুধু একটি অঞ্চলের নয়। এটি আমাদের মানবতার আয়না—যেখানে দেখা যাবে আমরা সত্যিই কে।
তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর
‘বাসুধৈব কুটুম্বকম’—বিশ্ব একটি পরিবার, এই মহৎ বার্তা দিয়েই ভারত নিজ দেশে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের সামনে নিজ দেশের দর্শন তুলে ধরেছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। একটি জাতিকে নির্মূল করার যুদ্ধে মদদ দিয়ে, যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমন করে, এমনকি শিশুদের ওপর বোমাবর্ষণকারী এক রাষ্ট্রকে কূটনৈতিকভাবে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে—ভারত ঠিক কী বার্তা দিচ্ছে বিশ্বের কাছে?
গ্লোবাল সাউথ বা দক্ষিণ গোলার্ধে নৈতিক নেতৃত্বের দাবিদার ভারত আজ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের নীরব (এবং কার্যকর) অংশীদারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে দেশটির সঙ্গে সহযোগিতা-মৈত্রী বাড়িয়ে এই অংশীদারত্ব এগিয়ে নিচ্ছে ভারত।
স্বাধীন হওয়ার পর থেকে—মূলত কংগ্রেস সরকারগুলোর আমলে—ভারত কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকলেও কৌশলগত কারণে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছে। এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকারের আমলেও এমন অবস্থানই ছিল। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি নিজেও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষেও ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আর কোনো রাখঢাক করছে না। পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলিম হওয়ার কারণেই ভোটের রাজনীতিতে সব সময় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে ভারত। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যেভাবে রাজনীতির মেরুকরণ করেছে, মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা এবং সরকারি পদক্ষেপ যেভাবে ভারতকে ধর্মীয় বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে সেটি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে নেতারা বক্তৃতা করলেও ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে জাতিসংঘের পরিকল্পনার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল ভারত। ইসরায়েলের প্রতি ভারতের অবস্থান তখনই অনেকখানি স্পষ্ট হয়। ১৯৫০ সালে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে ইসরায়েল কনস্যুলেট খোলে।
পুরো স্নায়ুযুদ্ধ কালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে ছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার পেছনে ভারতেরও অবদান আছে। আবার ওই সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম রূপকার ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দুই ব্লকের সঙ্গে আপাত দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেওয়ার কারণেই সম্ভবত সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলেছে ভারত।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর নিজেদের গুটিয়ে রাখেনি নয়াদিল্লি। ১৯৯২ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০০২ সালে মহাকাশ গবেষণা সহযোগিতার জন্য ইসরায়েলি মহাকাশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে।
১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চায় ভারত। এ সময় তো বটেই, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও ভারতকে অস্ত্র দেয় ইসরায়েল। অবশ্য ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র চাওয়ার আরেকটি কারণও ছিল—১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতায় পরিণত হয় ভারত। ২০১৯ সালেই ২৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়তে যৌথ কর্মসূচি নেয় ভারত ও ইসরায়েল।
চীনও ইসরায়েলের অস্ত্রের বড় ক্রেতা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়ায় সেটি আর এগোতে পারেনি। ২০০১ সালে জুলাইয়ে চীনের সঙ্গে চারটি ফ্যালকন রাডার সিস্টেম চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। ফলে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের মতো ক্রেতা লুফে নিয়েছে তেল আবিব। সমরাস্ত্র বেচাকেনা পর্যবেক্ষকদের হিসাবে, ভারত এখন ইসরায়েলের অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা। যেখানে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলারের বেশি অস্ত্রের বাণিজ্য হয় এই দুই দেশে।
কিন্তু গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সম্পর্ক বিস্ময়কর হারে বেড়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার, সেখানে বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বছরে ১৮৫ মিলিয়নেরও বেশি। আজ ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। ড্রোন, নজরদারি যন্ত্র, নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা প্রযুক্তি আসছে ভারতে।
এসব অস্ত্র ‘ব্যাটল-টেস্টেড।’ অর্থাৎ, ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরে বাস্তব যুদ্ধের ময়দানে এসব অস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষিত। যে অস্ত্র ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর প্রয়োগ করে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়, সেই অস্ত্র কিনে ভারত পরোক্ষভাবে বৈধতা দিচ্ছে দখলদারিত্ব, জাতিগত নিধন ও গণবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানা যেতে পারে, অস্ট্রেলিয়ার লেখক-সাংবাদিক অ্যান্টনি লোয়েনস্টেইনের বই ‘দ্য প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি’ থেকে।
গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন—যাদের বড় একটি অংশই নারী ও শিশু। হাসপাতালগুলো ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, ত্রাণবাহী যানবাহনে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে, ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার প্রধান ক্রেইগ মকহিবার এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ‘পরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও সুসংগঠিত গণহত্যা’ হিসেবে। তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘এটি পাঠ্যবইয়ে উঠে আসার মতো গণহত্যা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের মতো ভারতও এতে সম্পূর্ণভাবে জড়িত।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর যখন বিশ্ব অপেক্ষা করছিল প্রকৃত তথ্যের জন্য, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন বিশ্বের প্রথম নেতাদের একজন, যিনি ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তিনি ইসরায়েলের গাজায় বেসামরিক লোকদের নির্বিচারে হত্যার নিন্দা তো করেনইনি, উল্টো ভারতে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলন দমন করে চলেছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলোতে মানবিক মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচিরও অনুমতি দেওয়া হয়নি। সহানুভূতির প্রকাশকেই অপরাধ বানিয়ে তোলা হয়েছে। যে ভারত একসময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ইয়াসির আরাফাতকে স্বাগত জানিয়েছিল, জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছিল, সেই ভারতই আজ একটি বর্ণবৈষম্যমূলক রাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র।
ভারতজুড়ে অনেকেই প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। দিল্লি থেকে কেরালা—শিল্পীরা গাজা নিয়ে ছবি আঁকছেন, আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে চিঠি দিচ্ছেন, শিক্ষকেরা আয়োজন করছেন ‘টিচ-ইন’, মুসলমানরা প্রার্থনার আয়োজন করছেন। কিন্তু এসব প্রতিবাদও দমন করা হচ্ছে। ডিজিটাল নজরদারি চলছে, গোদি মিডিয়া তাদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। শান্তিপূর্ণ কর্মীদের বিরুদ্ধে লাগানো হচ্ছে ইউএপিএ-এর মতো কঠোর আইনের মামলা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো এখানেও তাদের নৈতিক অবস্থান ধরে রেখেছে। সিপিআই (এম) সরাসরি ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করে ইসরায়েলি বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছে এবং নাগরিকদের প্রতিবাদের অধিকার রক্ষার দাবি জানিয়েছে। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারত সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে যে কৌশলগত সখ্য গড়ে তুলছে, তা আমাদের ঔপনিবেশিক বিরোধী ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’ কৃষক আন্দোলনের ছত্রচ্ছায়া সংস্থা সংযুক্ত কিষান মোর্চাও ফিলিস্তিনি লড়াইয়ের সঙ্গে নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামের মিল টেনেছে।
ভারত কেবলই পৃথিবীর আর দশটা রাষ্ট্রের মতো নয়। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে মৈত্রী করে ভারত তারই ইতিহাস ও নীতিবোধকে কলঙ্কিত করছে। এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হিসেবে ভারত জানে দখলদারিত্বের ব্যথা কেমন। বিভাজনের রক্তাক্ত ইতিহাস ও সহিংসতার ক্ষত আজও গভীর। অথচ সেই অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টায় সহায়তা করা—এ এক নির্মম আত্মবিস্মৃতি।
ভারতের উচিত বিশ্বের সামনে সত্যিকার ‘ডিকলোনাইজেশন’-এর ডাক দেওয়া। কাশ্মীর বা শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বললে গাজায় গণহত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
একটি মর্যাদাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির মানে হওয়া উচিত—গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করা, ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহযোগিতা স্থগিত করা, জাতিসংঘে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া, আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে (আইসিজে, আইসিসি) স্বাধীন তদন্তে সহায়তা করা, দেশের ভেতর ফিলিস্তিনপন্থী কণ্ঠগুলোকে সুরক্ষিত রাখা।
গাজায় যা ঘটছে, তা ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায়। আজ নয়, ভবিষ্যতে এই সময়টিকে মনে রাখা হবে—কে কোথায় দাঁড়িয়েছিল, সেই হিসাব রচনা হবে। ভারত যদি সত্যিই নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে তাকে অস্ত্র নয়, মূল্যবোধের দিকেই ফিরে তাকাতে হবে। কারণ ফিলিস্তিনের প্রশ্ন শুধু একটি অঞ্চলের নয়। এটি আমাদের মানবতার আয়না—যেখানে দেখা যাবে আমরা সত্যিই কে।
তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর
মিয়ানমারের বিরল খনিজ সম্পদের দিকে চোখ পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মিয়ানমারের বিরল খনিজে চীনের কর্তৃত্ব সরিয়ে নিতে এবার ট্রাম্প প্রশাসন হাত মেলাচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। এমনকি দেশটির ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলোতে আসছে শিথিলতা, হচ্ছে প্রত্যাহারও।
২ দিন আগেআফ্রিকার খনিজ-সমৃদ্ধ দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোকে ঘিরে শুরু হয়েছে ভূরাজনৈতিক নতুন মেরুকরণ। রুয়ান্ডার সঙ্গে ৩০ বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটাতে শান্তি চুক্তির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পেছনে রয়েছে মার্কিন শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ...
৩ দিন আগে১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই সকালে ছাদখোলা বিলাসবহুল গাড়িতে করে সস্ত্রীক বসনিয়া প্রবেশ করেন ফার্দিনান্দ। সারায়েভোর সড়কে গাড়ি পৌঁছালে তাঁদের দেখতে সড়কের দুপাশে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ।
৩ দিন আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার আগামী বছর অনুষ্ঠেয় বিধানসভা নির্বাচনে আসামে ফের ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছে। আর সেই নির্বাচনকে সামনে রেখেই সেখানে এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। আর গত বছরের আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তথাকথিত ‘অবৈধ...
৩ দিন আগে