Ajker Patrika

শশী থারুরের নিবন্ধ /ক্ষয়ের মুখে মার্কিন নেতৃত্ব, যেমন হবে পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের ৮০ বছর পেরিয়ে গেছে। বেইজিং, মস্কো ও ওয়াশিংটনে আয়োজিত বহুল আলোচিত বিজয়-উদ্যাপন মিছিলগুলো যেন বন্ধুত্ব আর ধারাবাহিকতার প্রতীকী চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু এই জাঁকজমকের আড়ালে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে যুদ্ধপরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা, যা একসময় বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এখন পশ্চাদ্গামী। তার জায়গায় গড়ে উঠছে নতুন এক প্রভাব ও বৈধতার লড়াই। যেখানে ক্রমেই নিজেদের ‘বৈশ্বিক নেতৃত্বের’ দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে চীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগকে সংজ্ঞায়িত করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এক ঐকমত্য, যার মূল ভিত্তি ছিল উদার গণতন্ত্র, বহুপাক্ষিকতা ও উন্মুক্ত বাজারনীতি। কয়েক দশক ধরে এই তথাকথিত ‘প্যাক্স আমেরিকানা’ ইউরোপ ও এশিয়ার মিত্র দেশগুলোকে দিয়েছে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি। একই সঙ্গে এগিয়ে নিয়েছে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকেও। তবে এই ব্যবস্থা কখনোই দ্বন্দ্বমুক্ত ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক ও আফগানিস্তানে আগ্রাসন ও দখলদারত্ব—প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত আগ্রাসী ভূমিকা তার নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট আরও উন্মোচন করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা।

তবে এই ব্যবস্থার আসল ভাঙন শুরু হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে। জাতীয়তাবাদের চরম হয়ে ওঠা, বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অবজ্ঞা এবং আক্রমণাত্মক বাণিজ্যনীতি—সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার প্রচলিত বৈশ্বিক নেতৃত্বের ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষা করার মতো কোনো ঐতিহ্য নয়, বরং এক বোঝা। কারণ, তাঁর মতে, এটি চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে আমেরিকার ক্ষতির বিনিময়ে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর অস্থির আচরণ কিংবা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে দেওয়া তীব্র ভাষার বক্তৃতা থেকে সরলীকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বিপজ্জনক হতে পারে। তবু যখন তিনি এক টুইটে ভারত ও রাশিয়াকে ‘চীনের গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া দেশ’ হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন যেন সেটিই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব বিমুখতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। যদিও পরে গাজা সংকট নিয়ে ‘শান্তিচুক্তি’র নাটকীয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি কিছুটা পিছু হটেছেন বলে মনে হয়।

এই চিন্তাগত বিভাজন গভীর প্রভাব ফেলেছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেগুলোকেই দুর্বল করে দিয়েছেন। এতে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার ধারণাগুলোর জন্য পথ খুলে যায়। আমেরিকার আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ থাকা বেইজিং এই সুযোগে নিজেকে বহুপাক্ষিকতা ও স্থিতিশীলতার রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা শুরু করে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং বারবার বলেছেন, ‘জাতিসংঘের কর্তৃত্ব রক্ষা’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন’ প্রচারের প্রয়োজনীয়তার কথা। এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক নীতির বিপরীতে চীনকে এক দায়িত্বশীল বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে।

আজকের দিনে সির এই বার্তা এক দশক আগের তুলনায় অনেক বেশি সাড়া ফেলছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারত ও ব্রাজিলের মতো গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর প্রতি তাঁর প্রশাসনের মুখোমুখি অবস্থান তাদের ওয়াশিংটন থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং বেইজিংয়ের দিকে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনে সি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি পরোক্ষ সমালোচনা করে ‘আধিপত্যবাদ ও শক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ’ এবং ‘সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতার’ আহ্বান জানান।

এই পুনর্গঠন কেবল প্রতীকী নয়। চীন এখন ১০০ টিরও বেশি দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, যাদের অনেকেই এসসিও সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এই যুগে, ট্রাম্পের শুল্কের হুমকি ও বাণিজ্যযুদ্ধে মত্ত আমেরিকার তুলনায় চীনের স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি—বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে—আরও আকর্ষণীয় বিকল্প হয়ে উঠছে। যদিও চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক নীতি অনেকাংশে অস্বচ্ছ ও রাষ্ট্রনির্ভর, তবু তা এখন ওয়াশিংটনের অস্থির নীতি, বাণিজ্যযুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার তুলনায় কম বিপর্যয়কর বলে মনে হচ্ছে।

এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক। ট্রাম্পের নীতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সফট পাওয়ারকেই দুর্বল করেনি, বরং বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ক্ষুণ্ন করেছে। ইউএসএআইডি, পাবলিক ডিপ্লোমেসি তথা জনকূটনীতি বিভাগ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাঁদা প্রদান এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার—এসব পদক্ষেপ দেশটির সেই কূটনৈতিক কাঠামোকেই ভেঙে দিয়েছে, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনে প্রভাব বিস্তার করত। এই আত্মঘাতী পশ্চাদপসরণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাহসী করে তুলেছে এবং মিত্রদের অস্থির করে তুলেছে এই বিষয়ে যে—শূন্যতা চীন পূরণ করতে উদ্গ্রীব।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক কাঠামো ভেঙে পড়লে তা শুধু স্থিতিশীলতার জন্য নয়, কূটনৈতিক অগ্রগতির জন্যও বিপজ্জনক হবে। যদিও কিছু বিশ্লেষক সর্বনাশা ভবিষ্যদ্বাণী করা থেকে বিরত থাকছেন, তবু অনেকেই একমত যে ট্রাম্পের নীতিগুলো পৃথিবীকে এক বিভক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক নতুন যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

নতুন এই যুগকে আর আগের মতো মতাদর্শভিত্তিক জোটে ভাগ করা যায় না; বরং সেটি বাস্তববাদী সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নতুন বোঝাপড়া—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত নীতির ঝুঁকি, অন্যদিকে চীনের অংশীদার হওয়ার লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করছে। অনেক দেশের কাছে বিষয়টি কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করার নয়, বরং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বহুমেরু বিশ্বে কৌশলগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়।

তবে চীনের উত্থানও চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের আগ্রাসী ভূমিকা, মানবাধিকার রেকর্ড, ভারতের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা, পাকিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ এবং দুর্লভ খনিজ সম্পদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা অনেকের উদ্বেগের কারণ। তবুও বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগের আকর্ষণ এসব উদ্বেগকে অনেকাংশে আড়াল করে দিচ্ছে। ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়নের কাঠামো ভেঙে দিচ্ছেন, তখন বেইজিংয়ের বয়ান আরও প্রভাবশালী হচ্ছে। সবাই যে সেটি গ্রহণ করছে তা নয়, কিন্তু শূন্যস্থানটি চীনের বয়ানই পূরণ করছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা কখনোই অটল বা অপরিবর্তনীয় ছিল না। এটি ছিল সময়ের দাবি অনুযায়ী তৈরি একটি কাঠামো—স্নায়ুযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উদার গণতন্ত্রের অঙ্গীকারে গড়া। আজ সেই অঙ্গীকারই টলমলে। বিশ্ব এখন আর বিংশ শতাব্দীর মতো দুই মেরুভিত্তিক জামানার উত্তেজনায় ফিরছে না, বরং প্রবেশ করছে আরও পরিবর্তনশীল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একপর্যায়ে। যেখানে ক্ষমতা বিভিন্ন কেন্দ্রে বণ্টিত, অংশীদারত্বগুলো স্বার্থভিত্তিক, আর বৈধতা নিয়ে চলছে টানাটানি।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে রয়েছে দুটি পথ। তারা চাইলে আত্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটতে পারে—যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাব বৃদ্ধি করবে এবং মিত্রদের দূরে সরিয়ে দেবে। অথবা তারা আবারও বিশ্বমঞ্চে সক্রিয় হতে পারে, আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং বহুমেরু বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের নেতৃত্বকে মানিয়ে নিতে পারে। পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অবশ্যই বড় মূল্য চোকাতে হবে, কিন্তু পিছু হটার খরচ তার চেয়েও বড় হতে পারে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত