Ajker Patrika

ভারত কি পাকিস্তানকে ‘পানিতে মারতে’ চায়, আসলে তা সম্ভব?

হুসাইন আহমদ
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২২: ৫৩
জম্মু ও কাশ্মীরে চেনাব নদীর ওপর বাগলিহার বাঁধ। ছবি: ICIMOD
জম্মু ও কাশ্মীরে চেনাব নদীর ওপর বাগলিহার বাঁধ। ছবি: ICIMOD

কাশ্মীরে পর্যটন স্পট পেহেলগামে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলায় দুই ডজনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হলো। এই ঘটনায় চিরবৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করছে ভারত। আর তাই পদক্ষেপও নিয়েছে নজিরবিহীন! তিন-তিনটি যুদ্ধ ও বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার পর যে পদক্ষেপটি ভারত নেয়নি, এবার তা-ই নিয়েছে। প্রতিশোধ নিতে প্রতিবেশী দেশটিকে ‘পানিতে মারার’ চিন্তা করছে। ছয় দশকের বেশি পুরোনো সিন্ধু পানি চুক্তি না মানার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের দাবি, পাকিস্তান সীমান্তের ওপারে সন্ত্রাসবাদ থেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য ও স্থায়ীভাবে’ বিরত না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি ‘স্থগিত’ থাকবে।

এ ঘটনা ইতিহাসে বড় বাঁকবদল হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ, ৬৪ বছর ধরে একাধিক যুদ্ধ, প্রায় সাংঘর্ষিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কোচ্ছেদের মধ্যেও এই চুক্তি অক্ষত ছিল। পানি বরাবরই বৈরিতার ঊর্ধ্বে ছিল। যৌথ পানি ব্যবস্থাপনা আক্রান্ত হতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু সেটাই এবার প্রশ্নের মুখে পড়ল। দুই দেশের যৌথ ব্যবস্থাপনায় থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যবস্থাপনা হুমকিতে পড়ল। ভারত-পাকিস্তান বৈরিতায় রাজনীতি গুরুত্ব পেলেও এবারের পদক্ষেপের প্রভাব রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে ব্যাপক বিধ্বংসী হতে পারে। পাকিস্তানের নদী, কৃষি, জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ার কথা। কারণ, এর ফলে যে শুধু তাৎক্ষণিকভাবে পানি বন্ধ হবে, তা-ই নয়; কোটি কোটি মানুষের জীবনপ্রবাহ চালু রাখা পানিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তীব্র।

সিন্ধু পানি চুক্তি কীভাবে কাজ করত

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় বহু বছরের আলোচনার ফসল হিসেবে ১৯৬০ সালে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই আন্তসীমান্ত পানি চুক্তিগুলোর অন্যতম। চুক্তি অনুসারে, সিন্ধু, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) নামের এর দুই শাখানদী পাকিস্তানের হয়। এদিকে ভারত পায় সিন্ধুর তিন শাখানদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাতলেজ) ও ইরাবতী (রাভি)। পুরো পানির ৮০ শতাংশ হিস্যা পাকিস্তানের এবং ভারতের মাত্র ২০ শতাংশ।

চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই পানি ব্যবহার করবে কিন্তু কোনোভাবেই পানির প্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। ভারত এই নদীগুলোকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সীমিত সেচ করতে পারলেও পাকিস্তানের প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমনভাবে প্রবাহ থামানো বা পানি জমা করতে পারবে না। এই বিধিনিষেধগুলো কারিগরি ও আইনি দিক থেকে নির্দিষ্ট ও প্রয়োগযোগ্য।

চুক্তি অনুযায়ী, তথ্য বিনিময়, প্রকল্প পর্যালোচনা ও নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করতে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করা হয়েছে। কোনো বিরোধ হলে তা প্রথমে কমিশনে যায়, তারপর নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে এবং সর্বশেষে যায় আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে, যেখানে বিশ্বব্যাংক ভূমিকা রাখে। এই চুক্তি অমেয়াদি এবং এটি একতরফাভাবে বাতিল করার সুযোগ নেই। শুধু পারস্পরিক সমঝোতায় চুক্তি পরিবর্তনযোগ্য।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জলবিদ্যুতের বাস্তবতা

প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারত কি তাহলে এখনই পাকিস্তানের পানি বন্ধ করতে পারবে। এর উত্তর হলো, তাৎক্ষণিকভাবে নয়। বিশেষ করে মে-সেপ্টেম্বরে উচ্চপ্রবাহের মৌসুমে তো একেবারেই অসম্ভব। তখন বরফ গলে নদীগুলোয় কয়েক বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, ভারতের বিদ্যমান বাঁধের মাধ্যমে সেই প্রবাহ ঠেকানো সম্ভব নয়। কারণ, এই বাঁধগুলোর সংরক্ষণক্ষমতা সীমিত।

তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে ভারতের হাতে সুযোগ থাকবে। ভবিষ্যতে ভারত চুক্তির বাইরের পদক্ষেপ নিয়ে যদি নতুন বাঁধের বড় প্রকল্প হাতে নেয়, তাহলেও তা দীর্ঘ সময়, বিপুল অর্থ ও রাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে থাকবে। আর পাকিস্তান বহু আগেই বলে দিয়েছে, পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীতে বড় বাঁধ নির্মাণ যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের কথা বিবেচনায় নিলে ভারত নিজেই চীনের মতো উজান দেশের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, একতরফা কোনো পদক্ষেপ অতটা সহজ নয়।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের সম্ভাব্য ক্ষতি

ভারতের পানি থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হলেও চুক্তির সুরক্ষা হারানো পাকিস্তানের জন্য বিপজ্জনক। পাকিস্তানের সেচব্যবস্থা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ। সেটা এই তিন নদীর নির্দিষ্ট সময়ের পানিপ্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। এই সময়ে প্রবাহ সামান্য পরিবর্তন হলেও চাষাবাদ ব্যাহত হবে; ফসলের ফলন কমে যেতে পারে এবং খরচ বেড়ে যাবে।

সিন্ধু অববাহিকা ইতিমধ্যেই সংকুচিত হচ্ছে, অনিশ্চয়তা প্রবাহকে আরও ক্ষীণ করবে। এ ছাড়া পানি ভাগাভাগি নিয়ে প্রদেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে। বিশেষ করে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিরোধ লাগবেই। পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে। পানির প্রবাহ কমে গেলে বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়বে। এই পরিস্থিতি একেবারে কল্পনাপ্রসূত নয়; কারণ, পাকিস্তান এর মধ্যেই পানিস্বল্পতায় ভুগছে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬০ সালের পর এবারই প্রথম চুক্তি ‘স্থগিত’ করার ঘোষণা দিল ভারত। এটি স্থায়ী নাকি কৌশলগত চাপ, তা সময়ই বলবে। চুক্তিটি নিখুঁত নয়, কিন্তু অপরিহার্য। কারণ, চুক্তিতে ত্রুটি থাকলেও এতে নদীগুলোর প্রবাহ চলমান থাকে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে পড়লেও আলোচনা জারি থাকে। এখন এই কাঠামো ভেঙে পড়লে প্রতিটি ছোট প্রকল্প থেকে ভরসা উঠে যাবে। প্রতি বর্ষা, প্রতি জলাধার, প্রতি খরা হবে উত্তেজনার সম্ভাব্য কারণ।

এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন যখন খরা ও বন্যা বাড়াচ্ছে, তখন আরও অনিশ্চয়তা আনা বিপজ্জনক। পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলো শুধু যৌথ সম্পদ নয়, এগুলো পাকিস্তানের জীবনধারার কেন্দ্রবিন্দু। এই মুহূর্তে এর কোনো বিকল্প নেই। এই নদীগুলো জীবন, জীবিকা ও প্রকৃতি রক্ষা করে। এসবকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে বলি হতে দিতে পারে না পাকিস্তান। উদারতা থেকে নয়, বাস্তব প্রয়োজন থেকে এই প্রবাহ চলতে হবে। কারণ, একে থামানোর অর্থ উভয় দেশের জন্যই অপরিমেয় ক্ষতি।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সিন্ধু ও তার শাখানদীগুলো হাজার বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে সভ্যতা। সেগুলোই আজ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে—দুই পারমাণবিক দেশ কি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে? এই লড়াইয়ে বিচক্ষণতার জয় হবে নাকি উপমহাদেশ প্রবেশ করবে অনিশ্চিত এক যুগে, যেখানে পানি হয়ে উঠবে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু, তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শ্বশুরকে জামাতার ফোন: ‘আপনার মেয়েকে মাইরা ফেলছি, লাশ নিয়ে যান’

টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ দুদক: আইনজীবী

স্ত্রীকে হত্যার পর লাশ সেপটিক ট্যাংকে ফেলে গেলেন ইমামতি করতে

ঢাবির সিন্ডিকেটে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত অনুমোদন

ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি বাতিল করল পাকিস্তান, এর প্রভাব কী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত