Ajker Patrika

শুল্কযুদ্ধে কার ক্ষতি বেশি—চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্রের

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ২২: ০৫
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ দেশে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এর জবাবে চীন আগামী ১০ এপ্রিল থেকে পাল্টা ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।

চীনের স্টেট কাউন্সিল ট্যারিফ কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, ট্রাম্পের ‘হুমকির’ বিরুদ্ধে এটি তাদের পাল্টা ব্যবস্থা। কমিশনের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তারা চীনের বৈধ অধিকারকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করছে এবং এটি একতরফা। এর মধ্যে কোনো বাণিজ্যনীতি নেই। যা আছে, তা শুধু ভয় দেখানো আর ধমকানোর কৌশল।’

চীনের এই শুল্কের জবাবে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘চীন ভুল পথে হাঁটছে। তারা আতঙ্কিত, কিন্তু এর জন্য পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা আরও বড় ভুল!’

কিন্তু পাল্টাপাল্টি এই শুল্কযুদ্ধে কার ক্ষতি বেশি—চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্রের? প্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। চলুন দেখি, এই দুই রাজার যুদ্ধে কার প্রাণ যায়!

মার্কিন-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক

এর আগে চীনের পাল্টা শুল্ক শুধু জ্বালানি ও কৃষিপণ্যের মতো নির্দিষ্ট খাতগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন চীনে রপ্তানি করা সব মার্কিন পণ্যেই এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে অনেক বেশি পণ্য আমদানি করে, যেখানে রপ্তানি তুলনামূলকভাবে কম। ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীনে মার্কিন রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে ৪৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনেছে। এর ফলে ২০২৪ সালে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি বড় লক্ষ্যবস্তু।

কিংস কলেজ লন্ডনের চায়নিজ অ্যান্ড ইস্ট এশিয়ান বিজনেসের সিনিয়র লেকচারার ড. জিন সান দ্য ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ‘চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কারণে চীনের পাল্টা শুল্কের প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম হবে। কিন্তু মার্কিন শুল্ক চীনের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ, এটি অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি এবং বিস্তৃত খাতকে প্রভাবিত করবে।’

এ ছাড়া গত কয়েক বছরে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতিমধ্যেই সংকুচিত হয়ে গেছে। বর্তমানে এই দুই দেশের বাণিজ্য বিশ্বব্যাপী মোট বাণিজ্যের ৫ শতাংশের কম।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্টের জিওপলিটিকস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির অধ্যাপক সাইমন ইভেনেট বলেন, ‘গত দশকের মাঝামাঝি থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। আমরা এখন এ দুই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার পরবর্তী পর্যায় দেখছি।’

চীনে মার্কিন রপ্তানি

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির (ওইসি) ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, চীনে রপ্তানি করা মার্কিন পণ্যের প্রায় অর্ধেকই পাঁচটি প্রধান ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ রপ্তানি পণ্য হলো জ্বালানি। যেমন ক্রুড অয়েল, পেট্রোলিয়াম, প্রোপেন ও লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস। ২০২৩ সালে এগুলোর মোট মূল্য ছিল ২৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে মেশিনারি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করলেও চীনও মার্কিন প্রযুক্তিপণ্য কিনে থাকে। ২০২৩ সালে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারের মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ এবং ১২ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রনিক পণ্য কিনেছে।

দুই দেশের এই পাল্টাপাল্টি শুল্কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও গ্যাস টারবাইন। এ ছাড়া ট্রাম্প বিদেশি গাড়ি ও যন্ত্রাংশে শুল্ক বসালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে মাত্র ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের গাড়ি রপ্তানি করে। এখন সেখানেও ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।

পরিবহন খাতের আরেকটি বড় অংশ হলো অ্যাভিয়েশন, যেখানে বিলিয়ন ডলারের পণ্য ঝুঁকিতে পড়বে।

পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের সিনিয়র ফেলো ড. মেরি লাভলি বলেন, ‘আমরা একটি নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়েছিলাম, কিন্তু এখন উভয় পক্ষের শুল্ক সেই অবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি বোয়িং, অ্যাপল ও ক্যাটারপিলারের মতো কোম্পানিগুলোর রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পও চীনে বড় রপ্তানিকারক। ২০২৩ সালে চীন ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ভ্যাকসিন ও প্যাকেজড মেডিসিন এবং ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের মেডিকেল যন্ত্রপাতি কিনেছে।

মার্কিন কৃষকদের জন্য বড় ঝুঁকি

ড. মেরি লাভলির মতে, চীনের শুল্কের সবচেয়ে বড় আঘাত পড়বে মার্কিন কৃষি খাতে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সবজি (২০ বিলিয়ন ডলার) ও সয়াবিনের (১৫ বিলিয়ন ডলার) সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এ ছাড়া মার্কিন মাংস ও পশু পণ্যের রপ্তানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ড. জিন সান সতর্ক করে বলেন, ‘কৃষিপণ্য মার্কিন রপ্তানির একটি বড় অংশ হওয়ায় চীনের এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের মূল রাজনৈতিক ভোটারদের ক্ষতি করতে পারে। কারণ, যেসব অঞ্চলে কৃষক বেশি, তারাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক গোষ্ঠী। আর চীন এই গোষ্ঠীকে টার্গেট করে ট্রাম্পকে রাজনৈতিক চাপে ফেলতে চাইছে।’

চীনা পণ্যের অবস্থা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা চীনা পণ্যে মোট ৫৪ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মার্কিন ভোক্তারা সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরে চীনা পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই ৫৪ শতাংশ শুল্ক মার্কিন ভোক্তাদের বেশ ভালোই ভোগাবে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ইলেকট্রনিকস ও মেশিনারি খাতেই চীন থেকে ২০৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি ও ব্যাটারি—সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

এ ছাড়া ৩৬ বিলিয়ন ডলারের টেক্সটাইল পণ্যের আমদানিও সাধারণ ভোক্তাদের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হতে পারে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র অনেক পোশাক চীন থেকে আমদানি করছে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম মূল্যের কিছু চীনা পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছে। এখন চীন এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে পারবে। কিন্তু দামে সস্তা হলেও শেইন ও টেমুর মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোতেও শুল্ক আরোপ হবে এবং দাম বাড়বে।

মোটকথা, এই বাণিজ্যযুদ্ধ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সমস্যা। কিন্তু এর ফলে মার্কিন কৃষক, প্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। অন্যদিকে, মার্কিন ভোক্তাদেরও চীনা পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। এর ফলে চীনের রপ্তানিতেও ভাটা পড়তে পারে। অর্থাৎ এই বাণিজ্যযুদ্ধ দুই দেশের অর্থনীতিকেই দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাবিত করবে।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বেও ড. খলিলুর রহমান

মসজিদে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর ইমু সাব্বির

‘অতি গোপনীয়’ অভিযোগ নিয়ে দুদকে হাসনাত-সারজিস

নিবন্ধন পেল সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দল বিএমজেপি, প্রতীক রকেট

অনলাইনে পরিচয়, স্বামী-সন্তান রেখে দ্বিতীয় বিয়ে, পাঁচ মাস পর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত