Ajker Patrika

দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধ /মার্কিন ইগলের প্রস্থানে বাড়ছে রুশ ভালুকের ভয়, তুরস্কের ঘনিষ্ঠ ইউরোপ

অনলাইন ডেস্ক
তুরস্কের তৈরি একটি অ্যাটাক ড্রোন। ছবি: তুর্কি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি
তুরস্কের তৈরি একটি অ্যাটাক ড্রোন। ছবি: তুর্কি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি

যুক্তরাষ্ট্র চলে যাচ্ছে। রাশিয়ার হুমকি বাড়ছে। ইউক্রেন রক্ষণাত্মক অবস্থায়। নতুন করে প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল খরচের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও অস্ত্রের উৎপাদন এখনো যথেষ্ট নয়। তবে ইউরোপীয়রা, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আপনাদের পাশে আছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও ইউরোপের সম্ভাব্য ত্রাণকর্তা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ১১ এপ্রিল বলেছেন, এটা আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে যে তুরস্ক ছাড়া ইউরোপের নিরাপত্তা অচিন্তনীয়। এরদোয়ান প্রায়শই দাম্ভিক কথাবার্তা বলেন। তুরস্ককে গতিশীল আঞ্চলিক শক্তি ও ইউরোপকে দুর্বল-অচল হিসেবে তুলে ধরেন। তাই তাঁর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও চলে।

এ ছাড়া তুরস্কের অর্থনীতিও গভীর সংকটে। সামরিক শক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও গত বছর তুরস্ক প্রতিরক্ষা খাতে মাত্র ২৪ বিলিয়ন ডলার (জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ) খরচ করেছে, যা জার্মানির ব্যয়ের মাত্র এক-চতুর্থাংশ। তা সত্ত্বেও তুরস্কের এই শক্তিশালী নেতা খুব একটা ভুল বলছেন না। নিরাপত্তা সহযোগিতা, নতুন করে অস্ত্রসজ্জা ও ইউক্রেন—সব ক্ষেত্রেই ইউরোপের এখন তুরস্কের সাহায্য আগের চেয়ে বেশি দরকার।

প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্ক বিনিয়োগে তুলনামূলক অনেক ভালো ফল পাচ্ছে। দেশটির অস্ত্রশিল্প এখন খুবই সমৃদ্ধ হচ্ছে। সাঁজোয়া যান, অ্যাটাক ও সার্ভেল্যান্স ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ, ছোট অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুরস্কের অ্যাসেম্বলি লাইন থেকে দ্রুত তৈরি হচ্ছে। কিছু বিলম্ব হলেও তুরস্কের নিজস্ব ট্যাংক আলতাই ও স্টেলথ ফাইটার জেট ‘কান’ এই দশকের শেষ নাগাদ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ইউরোপজুড়ে তুরস্কের সঙ্গে ব্যবসার আগ্রহ বেড়েছে। তুরস্কের ড্রোন প্রস্তুতকারক সংস্থা বাইকার সম্প্রতি ইতালির প্রতিরক্ষা সংস্থা লিওনার্দোর সঙ্গে একটি যৌথ উদ্যোগে চুক্তি করেছে। এটি ইউরোপের ইউএভি (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল) বা মনুষ্যবিহীন ড্রোনের বাজারে বাইকারের বড় অংশ পেতে সাহায্য করবে।

আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। ইউরোপের গোলাবারুদের চাহিদার অন্তত কিছু অংশ মেটানোর জন্য তুরস্কের যথেষ্ট শিল্প ভিত্তি আছে। তুরস্কের সেনাবাহিনীর শক্তি ও অভিজ্ঞতা ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামো গড়তে দরকার। তা ন্যাটো জোটের ভেতরে হোক বা বাইরে। ইউক্রেন ছাড়া ইউরোপে তুরস্কের চেয়ে বড় সেনাবাহিনী আর কারও নেই। তুরস্কের সক্রিয় সেনাসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ।

ইউরোপ ইউক্রেনের বিষয়েও এরদোয়ানের সাহায্যের ওপর নির্ভর করছে। যুদ্ধবিরতি হলে সেখানে একটি বৃহত্তর শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক। রাশিয়াকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে তুরস্কের আগের রেকর্ড আছে, বিশেষ করে, সিরিয়া ও লিবিয়ায়। তাই এই প্রস্তাব ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তুরস্ক কৃষ্ণ সাগরের বিষয়ে আরও বেশি আগ্রহী। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা চায় না সেখানে রাশিয়া বা ন্যাটোর নৌবাহিনীর বড় উপস্থিতি থাকুক। এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, যেকোনো সামুদ্রিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে তুরস্ক নেতৃত্ব দিতে চায়।

তুরস্কের জন্য ইউরোপের সঙ্গে এই সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা ও ইউক্রেন—দুটোতেই লাভ আছে। তুর্কি কোম্পানিগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আগামী চার বছরে প্রতিরক্ষা খাতে যে শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশা করছে, তার সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইউক্রেনে সেনা পাঠানোও ব্যবসার জন্য ভালো হতে পারে। তুরস্ক এরই মধ্যে ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী। এরদোয়ান ঠিকই মনে করেন যে তুর্কি শান্তিরক্ষীরা সেখানে তুর্কি ঠিকাদারদের ব্যবসার পথ খুলে দেবে।

এরদোয়ানের অধীনে তুরস্ক ন্যাটো জোটে কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করেছে। দেশটি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের জোটে যোগদানে বিলম্ব ঘটিয়েছে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চলের জন্য ন্যাটোর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা আটকে দিয়েছে। সিরিয়ায় মার্কিন সমর্থিত কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা করেছে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তুরস্ক সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়েছে। একদিকে তারা ইউক্রেনকে ড্রোন ও যুদ্ধজাহাজ দিয়েছে, আবার অন্যদিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা বাড়িয়েছে। কিন্তু তিন মাসের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন-মাগা’ কতটা পার্থক্য আনতে পারে! তুরস্ক বদলায়নি। বদলেছে অন্য সবকিছু। হঠাৎ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তুরস্ককে ইউরোপের বেশি নির্ভরযোগ্য মিত্র মনে হচ্ছে।

তবে সমস্যা একটা আছে। গণতন্ত্রের মূল সূচক যেমন—নাগরিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—এসব ক্ষেত্রে তুরস্ক ইউরোপ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। বরং তুর্কমেনিস্তানের মতো দেশগুলোর কাছাকাছি নেমে গেছে। গত মার্চে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বিরোধী দলের নেতা ইস্তাম্বুলের মেয়র ও পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী একরেম ইমামোগলু এবং তাঁর কয়েক ডজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে এরদোয়ান সরকার। এর প্রতিবাদে তরুণ তুর্কিরা রাস্তায় নামলে তাদেরও শয়ে শয়ে গ্রেপ্তার করা হয়।

বন্ধুদের মধ্যে সামান্য দমন–পীড়ন কি আর খুব বেশি কিছু? ভাগ্যক্রমে এরদোয়ানের জন্য ইইউ তুরস্কের সঙ্গে নতুন নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ার ক্ষেত্রে এই সাম্প্রতিক দমন–পীড়ন নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। গত ১৯ মার্চ ইইউ বলেছিল, এই গ্রেপ্তারগুলো তুরস্কের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে ‘প্রশ্ন তৈরি করেছে।’ ইমামোগলুর গ্রেপ্তার প্রতিরক্ষা ও ইউক্রেন সম্পর্কিত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় বাধা নয়, বরং একটি সামান্য ‘বিরক্তিকর’ বিষয়। এর ব্যতিক্রম দেখা যায় ১৭ এপ্রিল, যখন খবর আসে, জার্মানি তুরস্কের কাছে ডজনখানেক ইউরোফাইটার জেট বিক্রি আটকে দেয়। এই চুক্তির পেছনে ব্রিটেন, ইতালি ও স্পেনের সমর্থন ছিল। তবে জার্মানির নতুন সরকার সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতেও পারে।

স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে ইইউ ও তুরস্ক বহু দশক ধরে একে অপরের কথা শোনেনি। এরদোয়ানসহ তুরস্কের নেতারা যুক্তি দিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য, কৃষ্ণ সাগর ও ককেশাস অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে তুরস্কের কৌশলগত ভূমিকা তাদের ইইউতে স্থান পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে ইউরোপ তুরস্কের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের রেকর্ড খুটিয়ে দেখার ওপর জোর দিয়েছে। এই ‘বধির লোকদের সংলাপের’ কারণে ইইউতে তুরস্কের যোগদানের আলোচনা—যা ২০০৫ সালে শুরু হওয়ার পরপরই থেমে যায়—কার্যত শুরু থেকেই ব্যর্থ হওয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল।

২০১৬ সালে সম্পর্ক অন্য দিকে মোড় নেয়। যখন ইউরোপে অভিবাসন–সংকট চরমে ছিল, তখন ইইউ তুরস্ককে শত শত কোটি ইউরো দিতে রাজি হয়। এর বিনিময়ে তুরস্ক লাখ লাখ সিরীয় ও আফগান শরণার্থীকে ইজিয়ান সাগরের ওপারে আটকে রাখে। আজ শরণার্থী নিয়ে উদ্বেগের পরিবর্তে রাশিয়া নিয়ে চিন্তা হাজির হয়েছে ইউরোপীয়দের মনে। ইউরোপ এখন প্রায় ‘এরদোয়ানের’ ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। তুরস্কের সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন এখনো গভীর হিমঘরে। নীতি–আদর্শ বাদ, স্বার্থই আসল। এটি ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রতিরক্ষার জন্য ভালো খবর—কিন্তু তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য নয়।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত