Ajker Patrika

যুদ্ধবিরতির পর ৮টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখে মোদি সরকার

দ্য ওয়্যার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: পিটিআই
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: পিটিআই

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর ১২ মে সন্ধ্যায় প্রথম জনসমক্ষে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি দাবি করেন, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির জন্য অনুরোধ করেছে। ভারতের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান বাঁচার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। শেষ পর্যন্ত ভারতের সামরিক বাহিনীর (ডিজিএমও) শরণাপন্ন হয়ে যুদ্ধ থামাতে অনুরোধ করে। ভারত সাময়িকভাবে সেই অনুরোধ মেনে নিয়ে প্রত্যাঘাত স্থগিত করে। ইসলামাবাদ এখন থেকে ‘ভদ্র’ আচরণ করবে, এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

একই সময়ে হোয়াইট হাউসে প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েছিলেন যে ‘যুদ্ধ থামাতে না চাইলে’ যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে সব বাণিজ্য বন্ধ করে দেবে। এরপরই দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

কিন্তু যুদ্ধবিরতি আপাতত কার্যকর থাকলেও প্রশ্ন রয়েছে—কেন এই হামলা, কেন এই সামরিক অভিযান ও যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন হলো? এসব নিয়ে মোদি সরকারের প্রতি আটটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছে—

১. কেন চালানো হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’?

গত ২২ এপ্রিল ভারত-নিয়ন্ত্রিত পেহেলগামে ২৬ জন নিরীহ মানুষকে তাঁদের পরিবারের সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এই নিষ্ঠুর হামলার পর ভারত প্রতিশোধ হিসেবে সামরিক অভিযানের পথ বেছে নেয়।

প্রশ্ন হলো, এই হামলা প্রতিরোধ করা যেত না?

সেদিন (২২ এপ্রিল) পেহেলগামের বৈসরান উপত্যকায় শত শত পর্যটক ছিলেন। এটি সুরক্ষিত ও টিকিট কেটে ঢোকার স্থান হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কোনো নিরাপত্তা বাহিনী ছিল না। চার বন্দুকধারী গুলি ছোড়ার আগে পর্যটকদের ধর্ম জিজ্ঞেস করেছিল—‘হিন্দু না মুসলিম?’ কোনো কোনো ব্যক্তিকে কালিমা পড়তেও বলেছিল। এরপর নির্দিষ্টভাবে হত্যা করা হয়। এর থেকে বোঝা যায়, হামলাকারীরা বেশ সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় কিলিং মিশনে নেমেছিল।

একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘ওরা জানত, এখানে কেউ সাহায্য করতে আসবে না। সরকার আমাদের এতিম করে রেখেছিল।’

এভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, সরকার পর্যটনস্থলে নিরাপত্তা জোরদার করলে হয়তো এই হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত। তখন ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রয়োজন হতো না।

২. কেন সাধারণ ভারতীয়রা পাকিস্তানি গোলার আঘাতে প্রাণ হারাল?

সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ২৬ জন। পরে পাকিস্তানের পাল্টা গোলাবর্ষণে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় নিহত হন, তাঁদের মধ্যে ছিল চার শিশু।

প্রশ্ন হলো, সরকার আগে থেকেই জানত পাকিস্তান পাল্টা আঘাত করবে। তাহলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হলো না কেন? বেসামরিক লোকের প্রাণহানির দায় কার?

৩. যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে?

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বকে জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। পরে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্বীকার করলেও ভারত তা এড়িয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করেন, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির অনুরোধ করেছে, ভারত তা মেনে নিয়েছে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কেন আগে এই ঘোষণা দিল? ভারতের মতো একটি সার্বভৌম দেশ কেন তৃতীয় পক্ষকে নিজের পক্ষ থেকে কথা বলার সুযোগ দিল?

৪. পেহেলগামের খুনিদের খোঁজ কত দূর?

‘অপারেশন সিঁদুর’ চালানো হয় এই হামলার প্রতিশোধে। কিন্তু ওই চার হামলাকারী কোথায়? এখনো তাদের ধরা যায়নি। তাহলে কেন যুদ্ধবিরতির আগে পাকিস্তানের কাছে তাদের হস্তান্তরের দাবি জানানো হলো না?

৫. ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি সফল?

মোদি বলেছেন, সন্ত্রাসী আস্তানা ধ্বংস ও বহু জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের সিদ্ধান্ত কতটা স্বাধীন ছিল? সংসদে কি এর ব্যাখ্যা দেবে সরকার?

৬. পুলওয়ামা তদন্তের অগ্রগতি কতদূর?

২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জওয়ান নিহত হন। আজও তার পূর্ণ তদন্ত হয়নি। তখন ২০০ কেজি বিস্ফোরক কীভাবে এখানে আনা হলো? সেই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য কেউ দায়ী হয়েছে কি?

৭. ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারত কি যুদ্ধবিমান হারিয়েছে?

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভারতের যুদ্ধবিমান হারানোর খবর বের হলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, ‘সঠিক সময়ে’ বিস্তারিত জানানো হবে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে’ তবে তিনি বিস্তারিত তথ্য দেননি।

প্রশ্ন হলো, ভারত কি স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে, নাকি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো শুধু সুখবর প্রচার করতে চায়?

৮. কাউকে কি জবাবদিহির আওতায় আনা হবে?

একসময় ভারতে মন্ত্রীরা তাঁদের দায়িত্বে ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহি করতেন, সেটা রেল দুর্ঘটনা হোক বা নিরাপত্তার ব্যর্থতা। ২০০৮ সালে (২৬/১১) মুম্বাই হামলার পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। এই ঘটনা দেখিয়েছিল, সরকারের ব্যর্থতার জন্য কেউ না কেউ জবাবদিহি করতেন। কিন্তু পাঠানকোট, উরি, পুলওয়ামা এবং এবারের পেহেলগাম হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি তাঁর সরকারের কাউকে দায়ী করবেন? হামলার প্রতিশোধ নেওয়াই কি যথেষ্ট? সরকারের লক্ষ্য কি হামলা ঠেকানো নয়? নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য কাউকে দায়ী না করলে এ ধরনের ঘটনা কি আবার ঘটবে না? আমাদের প্রশ্ন, সরকার কেন হামলা আগে থেকে ঠেকাতে পারছে না।

লেখক: হর্ষিতা কল্যাণ (ভারতীয় সাংবাদিক)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত