Ajker Patrika

রহস্যময় শব্দে বিপর্যস্ত যে গ্রামের মানুষ

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ০৩ মে ২০২৩, ১১: ১২
Thumbnail image

ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের ছোট্ট এক গ্রাম হমফিল্ড। এমনিতে গ্রামটি নিয়ে মাতামাতির তেমন কোনো কারণ ছিল না। তবে বছর কয়েক ধরে অপ্রত্যাশিত একটি কারণে নজর কাড়ছে গ্রামটি। এখানকার মানুষ রহস্যময় এক শব্দ শুনতে পান। এই শব্দের উৎস কী, সেটাও এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি।

মজার ব্যাপার, গ্রামের সবাই এই শব্দ শুনতে পায় না। আর যাঁরা শোনেন তাঁরা বলেন, এটা তাঁদের জীবনের ওপর বেশ খারাপ একটি প্রভাব ফেলছে। গুনগুন বা মৃদু গুঞ্জনের মতো এই শব্দ এতটাই পরিচিতি পেয়ে গেছে, এখন এর নামই হয়ে গেছে হমফিল্ড হাম। ২০১৯ সালে এর আবির্ভাবের পর থেকে একে নিয়ে ইউরোপের নামী সংবাদপত্রগুলোতেও মাতামাতি কম হয়নি।

তবে এখন পর্যন্ত আশ্চর্য এই শব্দের উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত চালিয়েও কোনো সুফল পায়নি। এমনকি তদন্তে একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়েও লাভ হয়নি।

গ্রামটির চারপাশ ঘিরে আছে কলকারখানাহমফিল্ডের যেসব বাসিন্দা শব্দটি শুনেছেন, তাঁরা একে তুলনা করেছেন ওয়াশিং মেশিন ঘোরার শব্দ কিংবা খুব ধীরেসুস্থে চলা ডিজেল ইঞ্জিনের মৃদু শব্দের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, একে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর শব্দগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা না গেলেও এটি একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে।

শুধু তাই নয়, ক্রমাগত এমন একটা শব্দ, তা সেটা যতই মৃদু হোক না কেন, শুনতে থাকার ঝক্কি কম নয়। এটি গ্রামবাসীর ঘুম এমনকি মেজাজ-মর্জির ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ দাবি করেন, এটি অনেক সময় সহ্য করার পর্যায়ে থাকে না, এমনকি নার্ভাস ব্রেক ডাউনের পর্যায়ে চলে যায়।

‘আমার বাড়িটাকে ভালোবাসি আমি। তবে কোনো কোনো দিন আবার প্রচণ্ড ঘৃণার জন্ম নেয় এর প্রতি। তখন মনে হয় এখানে সুখী হওয়ার মতো কোনো জায়গাই আর নেই।’ হমফিল্ডের বাসিন্দা ইভন্নে কনার বলেন বিবিসিকে, ‘শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কানের পর্দায় এসে বাজে। কেমন একটা অনুরণনের মতো। অদ্ভুত একটা চাপ তৈরি করে।’ নিজের বাড়ির উঁচু সিলিংয়ের কিচেনে বসে কথা বলার সময়ও তিনি বলছিলেন শব্দটা তাঁর চারপাশে পাক খাচ্ছে, যেমন এটির কবল থেকে নিস্তার পান না বেশির ভাগ দিন-রাতে।

গ্রামবাসীরা বলছেন, এটি তাঁদের ঘুম এমনকি মেজাজ-মর্জির ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে‘এর কারণে রাতে ঘুমানো কঠিন হয়ে পড়ে।’ বলেন স্থানীয় বাসিন্দা জোয়ে মিলার, ‘এখান থেকে সরে যাওয়ার কথাও ভেবেছি, কিন্তু আমাদের কোনো দোষ নেই, যেটায় তার জন্য কেন এটা করতে হবে আমাদের।’

ধারণা করা হয়, লো ফ্রিকোয়েন্সি বা কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের এই শব্দ ১০ হার্জ থেকে ২০০ হার্জ পর্যন্ত। ইয়ার কিংবা হেডফোনের সাহায্য নিয়েও এর থেকে নিস্তার মেলে না। রাতে যখন নিশ্চুপ হয়ে যায় চারপাশ, তখন বেড়ে যায় শব্দের তীব্রতা।

কনার, মিলারসহ অন্য যারা রহস্যময় এই শব্দ শোনার কথা বলেন, তাঁরা জানান, ২০১৯ সাল থেকেই নিয়মিত এই উপদ্রবের শিকার হচ্ছেন। স্থানীয় কাউন্সিলের কাছে এর উৎস আবিষ্কারের জন্য বারবার আবেদন করে এলেও এখন পর্যন্ত কেউই বলতে পারেননি কোথা থেকে আসছে এই শব্দ। তদন্তের সময় গ্রাম কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, সম্ভাব্য তিনটি উৎস শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত জানানো হয়, কারণটা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

‘আমরা তদন্তে নিজেদের পুরোটা সামর্থ্য ঢেলে দিয়েছিলাম। সম্ভাব্য প্রতিটি বিষয়েরই খোঁজ নিয়েছিলাম। কারণ আমরা এখানকার বাসিন্দাদের কথা ভাবি। জানি কিছু বাসিন্দার ওপর শব্দটা কেমন প্রভাব বিস্তার করছে।’ ইয়র্কশায়ার লাইভকে বলেন কাউন্সিলর জেনি লিন।

এখন পর্যন্ত কেউই বলতে পারেনি কোনখান থেকে আসছে এই শব্দব্যর্থ তদন্ত হমফিল্ডের অনেক বাসিন্দাকে প্রচণ্ড হতাশ করে। এর অর্থ তাঁদের এই অনবরত হওয়া মৃদু শব্দকে সঙ্গী করে এখানে থাকতে হবে, নতুবা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, মৃদু তরঙ্গের এই গুনগুন কিংবা গুঞ্জনের মতো শব্দের উৎস খুঁজে বের করাটা সত্যিই মুশকিল। তারপর আবার গ্রামটির সবাই এই শব্দ শুনতে না পাওয়া পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

হমফিল্ড গ্রামটির অবস্থান উপত্যকার নিচের দিকে। একে চারপাশ থেকে ঘিরে আছে নানা শিল্পকারখানা, একটি সময় পর্যন্ত এগুলোকেই শব্দের জন্য দায়ী করতেন হমফিল্ডের বাসিন্দারা। তবে তদন্তে হমফিল্ডের শোনা সেই আশ্চর্য শব্দের সঙ্গে কারখানাগুলোকে জড়ানোর মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

শ্রুতিবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ পিটার রজারস বিবিসিকে বলেন, বিষয়টি খুব জটিল। ‘বিখ্যাত’ এই গুঞ্জন শিল্পকারখানার কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডে হতে পারে, যেটা কেবল নির্দিষ্ট কিছু মানুষ শুনতে পান। সাধারণ, মামুলি কোনো বিষয়ও এর জন্য দায়ী হতে পারে, যেমন পাইপের মধ্য দিয়ে পানির প্রবাহ, ট্রান্সফরমার কিংবা টেলিগ্রাফ পোল থেকে তৈরি মৃদু আওয়াজ।

‘সমস্যাটা হলো, এটা কোথা থেকে আসছে সেটি খুঁজে বের করা। এটা অনেকটা সেই খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে পাওয়ার মতোই।’ বলেন রজারস। 

সূত্র: বিবিসি, অডিটি সেন্ট্রাল

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত