Ajker Patrika

প্রবীণ-জীবন সুন্দর হতে পারে

হাসান আলী
প্রবীণ-জীবন সুন্দর হতে পারে

ছেলেবেলায় আমার দাদি বলতেন, ‘ত্রিশে বিদ্যা, চল্লিশে ধন, না হলে ঠনঠন।’ প্রবীণেরা তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, নির্দিষ্ট একটা বয়সে পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়। তা না হলে জীবন নানা ধরনের জটিলতায় পড়ে। স্বস্তিময় জীবনযাপন করা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকালে ঠিকমতো যত্ন-আত্তি, ভালোবাসা ছাড়া শিশু বড় হতে শুরু করলে শৈশব-কৈশোরে এর প্রভাব পড়ে। শৈশব-কৈশোরে অবহেলা-অযত্নে বড় হলে যৌবনে এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রশ্নবিদ্ধ যৌবন অতিক্রম করে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে সীমাহীন সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। মর্যাদাপূর্ণ, স্বস্তিদায়ক প্রবীণ-জীবনের জন্য মাতৃগর্ভে শিশুর আগমন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মা-বাবার সুস্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে সন্তান সুস্থভাবে জন্মলাভ করতে পারবে কি না। এই সুস্থভাবে জন্মলাভ করা সন্তান মা-বাবার সেবাযত্নে, স্নেহমমতায় বড় হবে, এটা সবাই চায়। নানা কারণে অনেক সময়ই শিশু আপনজনের স্নেহমমতা ছাড়াই বড় হতে থাকে।

শারীরিকভাবে বড় হয়ে ওঠা শিশু মানসিক যাতনায় ভোগে। আমরা আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিতে পারছি না। কোনো কোনো শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার আবার কোনো কোনো শিশু অতিপুষ্টির শিকার। এভাবেই ভারসাম্যহীন শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে আগামী দিনের প্রজন্ম গড়ে উঠছে। একদিকে বিত্তহীন কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা স্বাস্থ্য-শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে, আরেক দিকে অতিসতর্কতার নীতি নিয়ে শিশুর ওপর শিক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত। শিশু বয়সেই যেন সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে। সব পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে যেন তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারে, চলছে তার আয়োজন। সমাজে আমাদের শিশুরা এভাবেই বিভাজন আর বিভক্তি নিয়ে বড় হচ্ছে। শিশুর অবচেতন মনেই জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, রাগ, জেদ, ক্ষোভ ইত্যাদি। পারিবারিক-সামাজিক সংকট শিশুমনে ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি করে। এই ব্যথা-বেদনাকে প্রশমিত করার জন্য আমাদের মনোযোগ খুবই কম। লেখাপড়ায় ক্ষতি হবে তাই খেলাধুলা, গান-বাজনা, লেখালেখিতে মা-বাবা তেমন উৎসাহ বোধ করেন না। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেয়ে অর্থবিত্তে ক্ষমতাবান মানুষ হওয়ার প্রেরণাই প্রধান। কী করে ধনসম্পদ এবং মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ বেশি করে করা যাবে, সেই চিন্তায় বিভোর। মানুষের মধ্যে সুখের ভাবনা তৈরি হয় বস্তুগত সুখ দিয়ে। শরীরকে সুখী করতে পৃথিবীর তাবৎ বস্তুর ব্যবহার পরম কাম্য হয়ে ওঠে। এই প্রতিযোগিতায় জয়-পরাজয় থাকে। পরাজিতদের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়। জয়ীদের হাসি-উচ্ছ্বাস সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ঘৃণার আগুন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

অশান্তির ডানা ঝাপটে ওঠে। সৃষ্টি হয় গভীর শূন্যতা। এই শূন্যতা যুব-মনে অনেক সময় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। স্বার্থ হাসিলের জন্য সম্পর্ক ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলি। দিবস পালনসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক মজবুত করার মহড়া চলে।

কিন্তু সম্পর্কের শূন্যতা পূরণ হয় না। চেনা ছেলেমেয়েরা ক্রমেই অচেনা হতে থাকে। আস্তে আস্তে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। হঠাৎ করে সংবাদ শিরোনাম হয়ে তাক লাগিয়ে দেয় কিংবা বুকভাঙা হাহাকার তীব্র হয়ে ওঠে। শুধুই বিচ্ছিন্নতা! এই বিচ্ছিন্নতা শুধু আপনজন থেকে। অচেনা, অদেখা মানুষ ক্রমেই আপন হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অনেকেই এই অচেনা-অদেখাদের হাতে নিজের নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত তুলে দেয়। অনেকেই মনে করতে পারে না, শেষ কবে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বসে দুপুর কিংবা রাতের খাবার সেরেছেন। যৌবনে থাকা মানুষ অভিযোগ, নালিশ, সুপারিশ, প্রতিযোগিতা, সেরা হওয়ার ভাবনা ইত্যাদিতে বেশি করে যুক্ত হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ নবীন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন এমনকি ছেলেমেয়েকে পর্যন্ত সময় দিতে পারছেন না। শুধু নিজেকে কতটা ওপরে তোলা যায়, সেই তাড়না তাড়িয়ে বেড়ায়।

এভাবেই নবীন চোখের পলকে প্রবীণ-জীবনে প্রবেশ করেন। কর্মযজ্ঞে ৩০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। ষাটে পা দিয়ে বুঝতে পেরেছেন শরীরটা আর কথা শুনতে চায় না। কেমন জানি বেয়াড়া হয়ে গেছে। রাত জেগে সফর করেছেন, দিনভর কাজ করেছেন। কখন দিন শেষ হয়েছে বুঝতে পারেননি। ছেলেমেয়ে, পরিবারের সদস্যদের বড় হওয়া দেখে অবাক হয়েছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার যন্ত্রণা শুধুই কাতর করে তুলছে। চেনাজানা মানুষ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। টেলিফোনটা আর আগের মতো বেজে ওঠে না। পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। অবহেলা, অবজ্ঞা, ক্রমেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনের নতুন চেহারা দেখে হয়তো একটু ভড়কে গেছেন। নিজের শরীরে রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে। সমাজে লোকজন বলতে শুরু করছে, ‘আর কত? এবার পরকালের কথা ভাবেন। কোন দিন ডাক পড়বে তার ঠিক নেই।’ চেনাজানা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মৃত্যুর সংবাদ আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। নিজের ডাক পড়ার সম্ভাবনা ভাবিয়ে তুলবে। নিজের অর্জিত সম্পদের ওপর নিকটতমদের নজর পড়েছে। আপনার সম্পদ আপনার কাছে নিরাপদ নয় বলে স্বজনেরা ভাবছেন। অথবা কোনো কারণে আপনি সম্পদ অর্জন করতে পারেননি কিংবা সম্পদ হারিয়েছেন। যাহোক, আপনি বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন। যৌবনে যদি আপনি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে সহযোগিতা করার সময় না পেয়ে থাকেন, তবে কেন তাঁদের সহযোগিতা আশা করবেন? আপনার ব্যস্ত জীবনে পরিবারে সবার সঙ্গে খাবার গ্রহণের রেওয়াজ চালু করতে পারেননি। প্রবীণ বয়সে আপনি একা খাবার গ্রহণের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। মানুষ বনজঙ্গল কেটে সাফ করে তারপর প্রকৃতি রক্ষার নামে বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার টবে ফুল-ফলের গাছ লাগিয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণে সচেষ্ট হয়। যৌবনে শরীরের যথাযথ যত্ন নিলেন না। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন না। মাদক, তামাক গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন। বার্ধক্যে এসে শরীর বিদ্রোহ করে উঠতে পারে। শরীরকে নাস্তানাবুদ করে ফেলতে পারে। যৌবনে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল করেননি। মনে করেছেন এগুলো কোনো ব্যাপার না। মনের চাওয়া-পাওয়াকে অবহেলা করেছেন। অথবা পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কিংবা চাহিদাগুলোকে তেমন একটা পাত্তা দেননি। আপনার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক ভূমিকা না-ও থাকতে পারে। মা-বাবা, স্বজনদের ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আপনার ভূমিকা সহযোগিতামূলক ছিল? নিজের সন্তান অসুস্থ হলে যতখানি গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসেন, প্রবীণ মা-বাবাকে কি একই গুরুত্ব দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন? আপনি কি নিজের হাতে প্রবীণ মা-বাবার সেবাযত্ন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছেন? আপনার যৌবনে আপনি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি সঠিক বিচার করেছেন? সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বুকে তুলে নিয়েছেন? সাহায্যপ্রার্থীদের আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন? সামাজিক কাজকর্মকে দায়িত্ব-কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন? যদি আপনি এসব কাজ করে না থাকেন, তবে কীভাবে আপনি পরিবার-সমাজের কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করেন? প্রবীণের প্রতি অমর্যাদা, অসম্মান, অবহেলা নিরসনে কোনো ধরনের ভূমিকা রেখেছেন? প্রবীণের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন? যেনতেন করে শৈশব-কৈশোর-যৌবন পার করে বার্ধক্যে এসে ‘বিলাপ’ করে অভিশাপ দিলে কোনো লাভ হবে? নিজের বার্ধক্যকে স্বস্তিময়, আনন্দদায়ক করতে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় প্রবীণ-জীবনের বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আপনাকে হতবিহ্বল করে দিতে পারে।

মানুষ জন্মের পর থেকে প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত নিজেকে চাকরি কিংবা ব্যবসার উপযুক্ত করার সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে। পরবর্তী ৩০ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করে থাকেন।

৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। একজন প্রবীণের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আর ৩০ বছর হতে পারে। সেই ৩০ বছর কাটানোর প্রস্তুতি কী? 

লেখক: সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত