Ajker Patrika

কালোটাকা সাদা করার উপকারিতা!

আব্দুর রাজ্জাক
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮: ০৪
কালোটাকা সাদা করার উপকারিতা!

আপনারা একটু চোখ-কান খোলা রাখলে দেখবেন, কালোটাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় জমি ও সম্পত্তি কেনার জন্য। ফলে আমাদের দেশের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ তাঁদের জমিজমা, সম্পদ ওই কালোটাকার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন, একটু বেশি দাম পেয়ে।

ছোটবেলায় একজন মুরব্বির কাছ থেকে শুনেছিলাম, বাসি দুধের ত্রিবিধ উপকারিতা। প্রথম উপকারিতা, যাঁরা বাসি দুধ পান করেন, তাঁদের ঘরে চোর ঢোকে না। দ্বিতীয় উপকারিতা, তাঁকে কুকুরে কামড়ায় না। তৃতীয়ত, তাঁর মাথায় তেল দিতে হয় না। উপকারিতা তিনটি একটু বিশ্লেষণ করলে মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন।

প্রথমত, বাসি দুধ পানকারী ব্যক্তির ঘরে চোর ঢোকে না। কারণ, ওই ব্যক্তি কাশি রোগে আক্রান্ত থাকে। সারা রাত ধরে ওই ব্যক্তি কাশতে থাকে, তাই ঘরে চোর ঢোকে না। দ্বিতীয়ত, তাঁকে কুকুরে কামড়ায় না। কারণ, ওই ব্যক্তি লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন! তৃতীয়ত, ওই ব্যক্তির মাথায় কোনো চুল থাকে না। যার কারণে ওই ব্যক্তির মাথায়ও তেল দিতে হয় না। বাসি দুধ পান করলে এ রকম উপকারিতা, অর্থাৎ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যক্তিজীবনে—এ রকম প্রবাদই শুনেছিলাম মুরব্বিদের কাছ থেকে। 

এখন আসা যাক মূল আলোচনায়। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি করে ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা। যাদের ক্ষমতা আছে, তারাই দুর্নীতি করতে পারে। এই ক্ষমতা কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী, ব্যাংকের অর্থ লুটকারী শিল্পপতিসহ সমাজের প্রভাবশালী মানুষের আছে। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে অনেকেই কালোটাকার মালিক হয়েছেন।

আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের শ্রম, মেধা, দেশের সম্পদ যারা ছলেবলে কোনোভাবে কুক্ষিগত করেছে, তাদের ‘রেন্ট সিকার’ বলে। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের গবেষণা অনুযায়ী, এই রেন্ট সিকারদের সংখ্যা ৪৩ লাখ। রেন্ট সিকারদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের হাতে কালোটাকা আছে। বাজেটে এই কালোটাকার জন্য ১০ শতাংশ ট্যাক্স দেওয়ার নিয়ম করে আইনগত একটা বৈধতা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। রাষ্ট্র এ ধরনের একটি অনৈতিক কাজকে বৈধতা দিল! যুক্তিটা হলো, কালোটাকাকে মূলধারায় নিয়ে আসা। এখান থেকে সরকার ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স পাবে। এখন গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই খাত থেকে সরকার খুব অল্প অঙ্কের টাকার রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে।

যদি কেউ এই সুবিধা নিয়ে কালোটাকা সাদা করে থাকে, তাহলে যে কাজটি হলো—যে পরিমাণ টাকা বৈধ হবে, তার তিন-চার গুণ টাকার সম্পদ এই সামান্য অঙ্কের বৈধ টাকা দিয়ে কিনে নেবে। কারণ, আমাদের দেশে যখন সম্পদ রেজিস্ট্রি করা হয়, তখন অনেক কম মূল্য দেখানো হয়। এভাবে এই সব কালোটাকার মালিক কম রেজিস্ট্রি মূল্য দেখিয়ে বেশি দামের সম্পদ আয়ত্ত করে নেবে। ফলে সাধারণ গরিব মানুষের সম্পদ ধীরে ধীরে এ ধরনের কালোটাকার মালিকদের কাছে চলে যাবে।

সেদিন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি একটু হাস্যরসের সঙ্গে বলছিলেন, এখন নাকি কেউ যদি ঘুষ দাবি করে, যে ঘুষ স্পিড মানি হিসেবে প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে ১০ শতাংশ বেশি টাকা দাবি করে, এই ঘুষের টাকা সাদা করার জন্য!

বিএনপির সময় এ ধরনের কালোটাকা সাদা করার একটি বিধান ছিল তিন বছরের। মূল অর্থনীতির ধারায় এসব কালোটাকা খুব একটা কাজে আসেনি। এসব কালোটাকা শুধু গুটিকয়েক লোকের হাতে অনেক সম্পদ তুলে দেয়।

প্রধানমন্ত্রী যেখানে একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করছেন, সেই অবস্থায় এ ধরনের একটি ব্যবস্থা প্রচলিত রাখা, বিপরীত ধারার নীতি নয় কি? এখানে যে কথা বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত অর্থ আর অবৈধ অর্থ এক নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত অর্থ ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে বৈধ করা যাবে। এখন এই অপ্রদর্শিত অর্থ ও অবৈধ অর্থের কোনোক্রমেই বাছবিচার করা যাবে না, সব একাকার হয়ে যাবে। এই ফাঁকে অবৈধ অর্থও বৈধ হয়ে গেল!

আপনারা একটু চোখ-কান খোলা রাখলে দেখবেন, এই কালোটাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় জমি ও সম্পত্তি কেনার জন্য। ফলে আমাদের দেশের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ তাঁদের জমিজমা, সম্পদ ওই কালোটাকার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন, একটু বেশি দাম পেয়ে। আমাদের সম্পদ গুটিকয়েক লোকের কাছে চলে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। দেশে নতুন নতুন জমিদার হবে, তাঁদের তাঁবেদার হবে দেশের ৯০ ভাগ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এটা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ পর্যায়ক্রমে তাদের সম্পদ হারাবে এবং দীর্ঘমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হবে সমাজে। বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে বিদেশে যাঁরা অর্থ পাচার করেছেন, সেই অর্থ ফেরত আনা যাবে। আমাদের জানামতে, কোনো সহৃদয় ব্যক্তি এখন পর্যন্ত ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে কোনো অর্থ ফেরত আনেননি। এখানে আরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, যদি কেউ অর্থ বিদেশে পাচার করে থাকেন, তিনি যদি ৭ শতাংশ ট্যাক্স দেন, তাহলে তাঁর অর্থ বৈধ হবে, কিন্তু সেই অর্থ দেশে আনার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না, সেটাও পরিষ্কার করতে হবে। এখানে স্পষ্ট করে বলতে চাই, অবৈধ টাকা, কালোটাকা, বিদেশে মানি লন্ডারিং করা টাকা শক্ত আইন করে, শাস্তির ব্যবস্থা করে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। এ রকম প্রণোদনা দিয়ে একটি অবৈধ প্রক্রিয়ায় উপার্জিত অর্থ মূলধারায় নিয়ে এলে সার্বিক অর্থনীতির কোনো উপকারে আসবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, বাসি দুধের যে রকম উপকারিতার কথা আগে আলোচনা করলাম, কালোটাকা বৈধ করার উপকারিতাও ওই একই রকম হবে বৈকি।

আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জোরপূর্বক অপুর স্বীকারোক্তি নিয়েছেন বিএনপির ইশরাক, এনসিপির ব্যবস্থা করা সংবাদ সম্মেলনে দাবি স্ত্রীর

ভোটের হাওয়ায় জোটের অঙ্ক

‘মিরপুরের উইকেটের পাশে পুঁইশাক বের হচ্ছে, এত বছর হয়নি কেন’

ভোররাতে হাঁসের মাংস খেতে ৩০০ ফুটে যান আসিফ মাহমুদ, না পেয়ে যান ওয়েস্টিনে

আন্দোলনকারীদের মারধর, থমথমে শেবাচিম হাসপাতাল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত