Ajker Patrika

ভোটের হাওয়ায় জোটের অঙ্ক

  • সনদ, সংস্কার আলোচনার নেপথ্যে ভোটের প্রস্তুতি।
  • ভোট নিয়ে সংশয় নাকচ দুই উপদেষ্টার।
  • দুই কক্ষ ও পিআরের সম্ভাবনায় সতর্ক দলগুলো।
  • বিদ্রোহী প্রার্থী চায় না শরিকরা।
রেজা করিম, তানিম আহমেদ ও সাখাওয়াত ফাহাদ, ঢাকা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে ভোটের তফসিল দেওয়ার কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী হাওয়া জোরেশোরে বইতে শুরু করায় দলগুলো এখন সম্ভাব্য জোটের জন্য আসন ভাগাভাগির আলোচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের দলের একজন নেতা ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না’ এমন আওয়াজ তুললেও সরকারের দুজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ভোট না হওয়ার বিষয়টি জোরের সঙ্গে নাকচ করে দিয়েছেন।

সংস্কার, জুলাই সনদ তৈরি, বাস্তবায়নসহ নানা বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনার পাশাপাশি প্রায় সব রাজনৈতিক দল নেপথ্যে ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ভোটের সময় ক্রমেই এগিয়ে আসায় তারা নিজ নিজ কৌশল নির্ধারণে সক্রিয়। পাশাপাশি নেতারা ব্যস্ত নিজ নিজ মনোনয়ন নিশ্চিত করার চেষ্টায়। এবার জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ নামে দুটি আলাদা কক্ষ প্রবর্তনের সম্ভাবনা জোরালো। অন্তত উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোট হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক মতৈক্য হয়েছে। এমন নতুন রাজনৈতিক আবহে দলগুলোকে এবারকার নির্বাচনী কৌশলও একটু রয়েসয়ে ঠিক করতে হচ্ছে।

ভেতরকার তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ দল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জোট ভিত্তিতে ভোটে যাওয়ার লক্ষ্যে আসন ভাগাভাগির আলোচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে। মাঠে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনী তৎপরতার ওপরই নজর সবার।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনীর প্রস্তাবে জোটের ভোটেও দলীয় প্রার্থীকে নিজ দলের মার্কায় লড়তে হবে, এমন বিধান যুক্ত করেছে। এ বিষয়টি জোটভিত্তিক কৌশল প্রণয়নের ওপর প্রভাব ফেলবে। নির্বাচনের সময় অথবা আসনভেদে বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কী কৌশল নেবে, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ।

বিএনপি আসন সমঝোতার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ‍নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচনের কথা বলছে। ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোকে নিয়ে একই চিন্তা করছে জামায়াতে ইসলামী। আর তরুণদের দল এনসিপির বড় একটি অংশ বিএনপি ও জামায়াত—উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে।

সম্ভাব্য জোটের শরিকেরা সংসদে নিজেদের অবস্থান যতটা সম্ভব শক্ত করতে সক্রিয় থাকবে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে ভোটের জোটগুলো স্পষ্ট রূপ পেতে পারে। বড় দলের কাছে সম্ভাব্য শরিকদের অনেকের দাবি, শুধু আসন ছাড়লেই হবে না, বিদ্রোহী প্রার্থীরা যাতে বাগড়া দিতে না পারেন, সেই নিশ্চয়তাও চাই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘যারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে, তাদের সবার মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের যে ৩১ দফা দেওয়া হয়েছে, তাতেই আগামী দিনের নির্বাচনী রূপরেখা আছে। বিএনপি সমমনাদের সঙ্গে নিয়েই নির্বাচন করবে।’

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা ৪০ থেকে ৫০টি আসনে ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে এরই মধ্যে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লেবার পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম, এনডিএম, জন অধিকার, পিপলস পার্টি, ন্যাপ ভাসানী ও আমজনতা দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী অবশ্য আজকের পত্রিকা'কে গতকাল বলেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে তারপর নির্বাচনী জোট নিয়ে আলোচনা করব।’

বিএনপির ভেতরকার তথ্য অনুযায়ী, তারা জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনী জোটের কথা ভাবছে না। এ বিষয়ে বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘যারা একাত্তর মানে না, স্বাধীনতাবিরোধী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা মানে না, তাদের সঙ্গে বিএনপি জোটবদ্ধ হবে না, একসঙ্গে চলবে না।’

তবে জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিএনপি ভোটের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে কথা বলবে, এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন দুই দলের নেতারাই।

এবারের ভোটে নিজেদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ঘরানার ইসলামপন্থী দলগুলোর ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার কথা বলে আসছে। ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম মিলে মোর্চা গঠনের চেষ্টা চলছে। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ায় মোর্চা গঠনে দেরি হচ্ছে।

জামায়াত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বললেও সবার আগে প্রায় ২৯০টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রয়োজনে ১০০টির বেশি আসন শরিকদের ছাড় দিতে রাজি তারা। তফসিল ঘোষণার পরেই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কৌশল নিয়েছে দলটি।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘ভোট তো আগে হতে হবে। ভোটের যদি পরিবেশ তৈরি হয়, তখন আমরা জোটের প্রক্রিয়া শুরু করব।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, জোট গঠনের প্রাথমিক আলোচনা চলছে।

অন্যদিকে এনসিপি নেতাদের দাবি, জোট গঠনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা তাঁরা এখনো শুরু করেননি। তবে কর্মসূচিগত মিলের জায়গা থেকে জোট হওয়ার মতো অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে সে সম্ভাবনা নাকচ করছেন না তাঁরা। ‘দেশের স্বার্থ ও বাস্তব পরিস্থিতি’ও বিবেচনায় নেবেন তাঁরা।

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জোট বা আসনকেন্দ্রিক কোনো আলোচনা এখন পর্যন্ত আমরা করি নাই। আমরা এখন আসলে নির্বাচনের প্রস্তুতির চেয়েও জুলাই সনদ কার্যকর করার বিষয়টাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা এবং বাংলাদেশ জাসদ মিলে বৃহত্তর বাম জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাসদ মার্ক্সবাদী সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা সব সময় বামপন্থী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চাই এবং তা করছিও।’ এর অংশ হিসেবে বাম দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা জানান মাসুদ রানা। তবে বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট করার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন তিনি।

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হওয়া নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার বলেছেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের একক ঘোষণায়’ নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব নয়। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করে বলেন, ‘নির্বাচন অবশ্যই হবে এবং সুষ্ঠু হবে।’

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত মঙ্গলবার রাতে বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা সরকারের অঙ্গীকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ‘ঠিকানা’র সঙ্গে টক শোতে এ কথা বলেন আসিফ মাহমুদ।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অঙ্গীকার অনুযায়ী সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরিসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারির পর এ সরকারে থাকার ইচ্ছা (উপদেষ্টাদের) কারও মধ্যে তিনি দেখেননি।

মঙ্গলবার ঢাকায় দলের যুব সংগঠনের সম্মেলনে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, সংস্কার ও জুলাই (জাতীয়) সনদ না হওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।

নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সংশয়ের দোলাচলের মধ্যে তাঁর এ কথা নানা গুঞ্জনের জন্ম দেয়। ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুই উপদেষ্টার সুস্পষ্ট বক্তব্য অন্তত এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

জি এম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার

ভারতকে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

প্লট–ফ্ল্যাট বরাদ্দে সচিব, এমপি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ যাঁদের কোটা বাতিল

জর্ডান-মিসরকে নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে চান নেতানিয়াহু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত