Ajker Patrika

দ্বিজাতি তত্ত্বের অবসান

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা 
দ্বিজাতি তত্ত্বের অবসান

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি যে অভিভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এটাই ছিল নীতিনির্দেশক বিবৃতি। কী বলেছিলেন তিনি এই অভিভাষণে?

ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কিন্তু আর কোনো দিন দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে ওকালতি করেননি। তিনি অতীতের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব ভুলে নয়া রাষ্ট্র ও নয়া জাতি গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, সমস্যা শুধু হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে পাঠান, পাঞ্জাবি, শিয়া, সুন্নি; হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, ক্ষত্রিয়; আছে বাঙালি, মাদ্রাজি—এর কোনো কিছুই আলাদাভাবে থাকবে না। তিনি হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সকলের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন এবং ধর্মের ভিত্তিতে অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসানই যে কল্যাণজনক, গ্রেট ব্রিটেনের ইতিহাস থেকে তার উদাহরণ দিয়েছিলেন।

জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘আমরা যদি এটাকে আমাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারি, তাহলে শুধু ধর্মের কারণে হিন্দুরা শুধু হিন্দু থাকবে না, মুসলিমরা শুধু মুসলমান থাকবে না। ধর্ম হবে তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা, কিন্তু রাজনৈতিক অর্থে তারা সবাই হবে রাষ্ট্রের নাগরিক।’

একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনের কথাই যে জিন্নাহ এখানে বলছেন, সে কথা বোঝা কঠিন নয়। কেন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর জিন্নাহ একবারও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রসঙ্গ টানলেন না তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতিতে, সে কথা গবেষকদের ভাবা দরকার।

একটু খেই ধরিয়ে দেওয়া যায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা জিন্নাহ গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই। অখণ্ডিত ভারতের মুসলিমপ্রধান উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলগুলোকে নিয়ে মুসলিম আবাসভূমি গড়ে তোলার ব্যাপারটি একসময় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই আবাসভূমির যথার্থতা প্রমাণের জন্যই দ্বিজাতিতত্ত্বের উপস্থাপন করেছিলেন তিনি।

আর যদি মনে হয়ে থাকে, জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বকে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নয়, তাহলে বুঝতে হবে শেষজীবনে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তি উপলব্ধি করেছিলেন।

গবেষক ও প্রবন্ধকার আবদুল হক লিখেছেন, ‘জিন্নাহ সাহেবকে অথরিটি ধরলে অখণ্ডিত ভারতের “সব মুসলমান” মিলে এক জাতি এবং “সব হিন্দু” মিলে অন্য জাতি এ কথার, অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্বের মেয়াদ মোটামুটি ১৯৪০ সালের সূচনা থেকে ১৯৪৭ সালের ১১ই আগস্ট অবধি। কোনো সত্য যদি প্রকৃত সত্য হয়, তবে তা এত স্বল্প কাল স্থায়ী হয় না। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে জিন্নাহ সাহেব একটা কথা বলেছিলেন এবং ১৯৪৭ সালের ১১ই আগস্ট তারিখে অন্য আরেকটি কথা বলেছিলেন। এই দুটোই ঠিক হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্ব একটা সাময়িক মতবাদমাত্র, দ্বিতীয়োক্ত তারিখে তিনি তা বর্জনের কথা বলেছিলেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত