Ajker Patrika

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক

সরকারের ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা দলগুলোর

  • ২ দিনে ১৭টি দলের সঙ্গে মতবিনিময় প্রধান উপদেষ্টার।
  • উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা
  • সংকট তৈরি হলে প্রধান উপদেষ্টা ডাকেন। ঘন ঘন আলোচনা হলে সমস্যা তৈরি হতো না: ফখরুল
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৬: ১০
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক বছর হতে চললেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের পর বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনের ভঙ্গুর চিত্র আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও মতবিনিময় করলেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছে দলগুলো। বৈঠকসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনা এবং এইচএসসি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে সচিবালয় ও মাইলস্টোন স্কুলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরিসহ নিকট অতীতে আরও কিছু ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে মতবিনিময়ে ডাকতে হয় দলগুলোকে। গত দুই দিনে ১৭টি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময়ে প্রথম দিন গত মঙ্গলবার ডাকা হয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলনকে। আর গতকাল বুধবার ডাকা হয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), ১২ দলীয় জোট, বাসদ, সিপিবি ও গণফোরামকে। এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চাওয়া।

বৈঠক সূত্র বলছে, উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে ফ্যাসিবাদী শক্তি যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তারা বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে, এ বিষয়টি সবাইকে সতর্ক থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলার কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় সরকারের কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। আইনশৃঙ্খলাসহ সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার জন্য সমালোচনার পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দলগুলোর পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয় সরকারকে।

দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ, কেবল বেকায়দায় পড়লেই তাঁদের যমুনায় ডাকা হয়। মাসে অন্তত একবার হলেও সর্বদলীয় বৈঠক আয়োজন করতে প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানান তাঁরা।

গত মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে গতকাল বুধবার বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকার ও দলগুলোর মধ্যে ঘন ঘন মতবিনিময়ের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সংকট তৈরি হলে প্রধান উপদেষ্টা ডাকেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা হলে সমস্যা তৈরি হতো না।’

একটি সূত্রের দাবি মঙ্গলবারের বৈঠকে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেছেন খোদ প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা মোকাবিলায় প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। সংস্থাগুলোর আগাম তথ্য পেলে এড়ানো যেত। সচিবালয়ে গেট পর্যন্ত লোক চলে যাওয়ার আগে খবর পাওয়া যায়নি। বাহিনীগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না।

দুই উপদেষ্টার অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জামায়াতের নেতারা। তাঁরা বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উপদেষ্টারা কীভাবে গেলেন? কী গোয়েন্দা তথ্য ছিল? উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলের সহায়তায় উদ্ধার সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

বৈঠকের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুলে দুজন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিবকে শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। একই দিনে সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জে সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির আবার উত্থানের একটা নমুনা দেখার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমরা আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলে এসেছি।’

তবে দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সরকারের পদক্ষেপে কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা ছিল মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, ‘এটা অভিজ্ঞতার অভাব। এ সরকারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো তাদের অনভিজ্ঞ লোকই বেশি, অভিজ্ঞরা কম আছে। কারও কারও ইগো সমস্যা আছে। সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা, পরামর্শ করা—এ বিষয়ে তারা একটু পিছিয়ে।’

বৈঠক প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি এখন সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। দেশে পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা চলছে এবং গোয়েন্দা ও প্রশাসনিক কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি।

গতকাল বুধবার বৈঠক শেষে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সংস্কার ও সঠিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে সংশয়ের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। তাঁকে বলেছি, আপনি যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে না পারেন, আবার ভালো নির্বাচনও নিশ্চিত করা সম্ভব না মনে করেন, তাহলে পদত্যাগ করে চলে আসুন। সংস্কার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আগ্রহী সকল পক্ষ মিলে আপনার নেতৃত্বে আমরা একটা নির্বাচনী অ্যালায়েন্স করি।’

এদিকে নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে দলগুলোর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়। দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ওই পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এদিকে গতকাল সকালে মতবিনিময় শুরুর পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ১০ মিনিটের জন্য প্রতীকী ওয়াকআউট করে সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ। তবে বেলা ১১টা ২৫ মিনিটের দিকে তারা আবার সংলাপে যোগ দেন।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আপনারা তো সবকিছু পারলেন না। সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে বলে দিন। তারা যদি সে পথে হাঁটে, আমরা সবাই মিলে যদি হাঁটতে পারি, তাহলে সংকট দূর করতে পারব।’

প্রিন্স অভিযোগ করে বলেন, কোনো কোনো দলের প্রতি আপনার মায়া-মমতা বেশি থাকে এবং আপনার দল হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে সংকট কাটবে না।

এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটা অংশ এনসিপি নামে একটা সংগঠন তৈরি করেছে। এই এনসিপি যেখানেই মিটিং করতে যায়, সেখানেই তারা পুলিশ প্রহরা, মিলিটারি প্রহরা, র‍্যাবের প্রহরায় বিভিন্ন জায়গাতে বিভিন্ন রকম সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করার জন্য সুযোগ পাচ্ছে। তো এটা সরকারের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে একটা বৈষম্য সৃষ্টি করার সমান।

লন্ডন বৈঠকের পর দেশে ফিরেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনের ব্যাপারে উচিত ছিল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করা। সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তত খারাপ হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, গোলাপগঞ্জে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দৃষ্টান্তমূলক ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ হয়তো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইবে, তবে যদি প্রশাসন সঠিকভাবে কাজ করে, তবে কেউই অপব্যবহার করতে পারবে না।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো আসছে, পে কমিশন গঠন

ব্যাংকে চোখ বেঁধে গ্রাহককে হাতুড়িপেটা, পায়ের নখ তোলার চেষ্টা

‘সোজা কথা, যারে ভালো লাগবে তারে কোপামু’

শুল্ক ছাড়া যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ পেল ভারত

সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে পারে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া—শক্তিতে কে বেশি এগিয়ে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত