Ajker Patrika

সোহরাওয়ার্দী-আইয়ুবের দ্বন্দ্ব কেন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২১, ১৮: ০৪
সোহরাওয়ার্দী-আইয়ুবের দ্বন্দ্ব কেন

স্বাধীন হওয়ার পরপরই টের পাওয়া গেল যে পূর্ব বাংলা পাঞ্জাব-শাসিত পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হতে চলেছে। সে জন্যই দাবি উঠেছে স্বায়ত্তশাসনের এবং ওই দাবিকে যৌক্তিক দিক দিয়ে জোরদার করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে আদি লাহোর প্রস্তাবের। বলা হয়ে থাকে, মুসলিম লীগের নেতাদের স্বার্থান্বেষী ও স্বেচ্ছাচারী আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থীরাই উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তৎপরতাটা সোহরাওয়ার্দীপন্থীদের তুলনায় হাশিমপন্থীদের দিক থেকেই ছিল অধিক উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, সোহরাওয়ার্দী নিজে পূর্ববঙ্গকে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন; দ্বিতীয়ত, তিনি সেখানে গিয়ে জিন্নাহ-আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন এবং আশা করছিলেন পূর্ববঙ্গে তার একটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে যে তরুণেরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শামসুল হক, যাঁকে দলের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়; এবং মতাদর্শিকভাবে শামসুল হক ছিলেন আবুল হাশিমের রব্বানিয়াত দর্শনের অনুসারী। নতুন দলের ঘোষণাপত্রটি শামসুল হকই লিখে থাকবেন। কারণ তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে পাকিস্তান খেলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হবে এবং আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা ও প্রভুত্বের অধিকারী হবে। এটি রব্বানিয়াত দর্শনেরই কথা। তবে ‘মূল দাবি’ হিসেবে শামসুল হক যে লাহোর প্রস্তাবের কথা বলেছেন, সেটা আরও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর মতে, লাহোর প্রস্তাব ‘সর্বকালের সর্ব যুগের সর্ব দেশের যুগপ্রবর্তক ঘটনাবলির ন্যায় একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে।’ মনে হচ্ছে উদ্যোগীদের দৃষ্টিতে লাহোর প্রস্তাব ছিল একটি মহাবৈপ্লবিক ঘটনা। তবে, তাঁদের মতে, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের অপারগতার দরুন ওই বিপ্লবের লক্ষ্যগুলো অর্জন করা যেহেতু সম্ভব হয়নি, তাই মুসলিম লীগকে ‘স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকারের জনগণের মুসলিম লীগ হিসেবে গড়ে তোলা আবশ্যক।’ অর্থাৎ কিনা লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন চাই। নতুন সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী, এর আগে যিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন এবং মনেপ্রাণে যিনি লাহোর প্রস্তাবের ‘দুই পাকিস্তান’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। যে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, সেটির আহ্বান করা হয়েছিল ভাসানীর নামেই; যার প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) ও অন্য কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এক বিবৃতিতে জানান যে, ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের দ্বারা আগামী ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন নামে যে সভা আহূত হইয়াছে, তাহার সহিত মুসলিম লীগের কোন সম্পর্ক নাই। বস্তুত ইহা দলগত স্বার্থ ও ক্ষমতা লাভের জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা মুসলমান সংহতি নষ্ট করিয়া পাকিস্তানের স্থায়িত্ব ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আহূত হইয়াছে।’

নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মতো ‘প্রাদেশিক’ ছিল না; ছিল লাহোর প্রস্তাবে যে ধারণা ব্যক্ত হয়েছিল, কল্পনার সেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি সংগঠন। মওলানা ভাসানী অবশ্য সোহরাওয়ার্দীকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। সেটা এই লক্ষ্যে যে পাকিস্তানজুড়ে সংগঠনের বিস্তার ঘটলে মুসলিম লীগের বিরোধী শক্তি হিসেবে এর শক্তি বৃদ্ধি পাবে। সোহরাওয়ার্দী তখন থাকতেন লাহোরে, ভাসানী শেখ মুজিবকে লাহোরে পাঠিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও সম্ভব হলে মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সেটা ১৯৪৯-এরই ঘটনা। এর পরে ১৯৫২-তে মুজিব আবার পশ্চিম পাকিস্তানে যান; একই উদ্দেশ্যে; সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে। সোহরাওয়ার্দী তখন তাঁকে জানান যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে পশ্চিমে-গঠিত জিন্নাহ-আওয়ামী মুসলিম লীগের অ্যাফিলিয়েশন নেওয়া দরকার। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘তিনি বললেন, একটা কনফারেন্স ডাকবো, তার আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এ্যাফিলিয়েশন নেওয়া দরকার।’ জবাবে শেখ মুজিব তখন তাঁকে যা বলেছিলেন সেটা এ রকমের:

আমি তাঁকে জানালাম, ‘আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত, আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মওলানা সাহেব আমাকে ১৯৪৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁরও কোনো আপত্তি থাকবে না যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন। অনেক আপত্তির পর তিনি মানতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে তাঁর সম্মতির কথা লিখে দিলেন।’

মুজিব লিখেছেন, ‘আমি আর এটাও অনুরোধ করলাম তাঁকে লিখে দিতে যে, উর্দু ও বাংলা দুটোকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ ও তথাকথিত প্রগতিশীলরা প্রোপাগান্ডা করছে তাঁর বিরুদ্ধে। [...] তিনি লিখে দিলেন।’

অন্যরা তেমনভাবে খেয়াল না করলেও শেখ মুজিব ঠিকই লক্ষ করছিলেন যে, ‘পূর্ব বাংলার সম্পদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায়, একদল পশ্চিমা তথাকথিত নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলছিল। তাদের একটা ধারণা ছিল, পূর্ব বাংলা শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকবে না। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে হবে।’

অর্থাৎ লাহোর প্রস্তাবের যে অঙ্গীকার–দুটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম পাকিস্তানের, সেটা সব দিক থেকেই অকার্যকর করে তোলা হচ্ছিল। এই উপলব্ধি থেকেই মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে প্রয়োজনে পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব সে সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ১৯৬৬-তে এসেই তাঁর মনে কোনো সংশয় থাকেনি যে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের সঙ্গে থাকা যাবে না, যে কথা তিনি তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বলেছিলেন এক গোপন বৈঠকে; ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরের দিকে।

লাহোর প্রস্তাবের রাজনৈতিক মর্মবস্তুতে অবশ্য আরেকটি জিনিস ছিল, সেটি হলো দ্বিজাতি তত্ত্ব। ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি অভিন্ন ও স্বতন্ত্র জাতি, এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়েই লাহোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে জাতীয় সত্তার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম। সেটা যে সত্য নয়, প্রধান ভিত্তি যে ভাষা, সেটা তো অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বের হয়ে এসেছিল বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়েই। সোহরাওয়ার্দী কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ওই মর্মবস্তুটিকে কখনোই খারিজ করে দেননি; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দ্বিজাতি তত্ত্বকে তিনি সত্য বলে জেনেছেন, যে জন্য পাকিস্তানকে ভাঙা নয়, তাকে রক্ষা করার কাজেই তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান যখন তাঁকে কারারুদ্ধ করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগ আনা হয়েছিল সেটি হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, ‘বিশেষ করে গত তিন বছর ধরে, তিনি ভেতরের ও বাইরের পাকিস্তানবিরোধীদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন।’ অভিযোগনামার জবাবে জেলখানা থেকেই সোহরাওয়ার্দী যে জোরালো চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে তিনি বলেছেন, এই অভিযোগ পড়ে তিনি যারপরনাই মর্মাহত হয়েছেন। কারণ তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ‘মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান হচ্ছে এক ও অবিভাজ্য;’ এবং এই বিশ্বাসের দ্বারা তাড়িত হয়েই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন এবং এখন বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমকে একসঙ্গে থাকতে হবে–এই বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়েই তিনি কাজ করে গেছেন।

এরপরও তাঁকে যে পাকিস্তানের ঐক্য-বিনষ্টকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং সেই অভিযোগে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেটা কেবল যে দুঃখজনক তা-ই নয়, এর দ্বারা তাঁর যে রাজনৈতিক ‘উপযোগিতা’ (utility) ছিল তা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তিনি বলছেন যে, তিনি কখনো পদের জন্য লালায়িত ছিলেন না; কিন্তু তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা (অবশ্যই এককেন্দ্রিক) রক্ষার জন্য কাজ করতে পারতেন। দুঃখের বিষয় আইয়ুব খান তাঁর সেই উপযোগিতাকে ধ্বংস করে ছেড়েছেন। পাকিস্তানকে তিনি এক জাতির দেশ বলেই মনে করতেন। এখানে আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না, উভয়েই পাকিস্তানকে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একত্র রাখতে চেয়েছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও এমন একটি অবিচ্ছেদ্য পাকিস্তানি জাতিই তৈরি করবেন বলেই ভেবেছিলেন। স্পষ্টতই আইয়ুব খানের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর দ্বন্দ্বটা ছিল ক্ষমতা নিয়ে; আইয়ুব সোহরাওয়ার্দীকে মুক্ত রেখে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না, কারণ তখন সোহরাওয়ার্দীই ছিলেন তাঁর ক্ষমতায় থাকার প্রতি প্রধান চ্যালেঞ্জ; বিশেষ করে এই জন্য যে, সোহরাওয়ার্দীর প্রতি আমেরিকানদের পক্ষপাতিত্ব আইয়ুবের তুলনায় কিছুটা বেশি ছিল বলেই সন্দেহ হচ্ছিল। আইয়ুব অবশ্য সোহরাওয়ার্দীকে বেশি দিন বন্দী করে রাখতে পারেননি, প্রবল জনপ্রতিবাদের মুখে ১৯৬২ সালের জানুয়ারির শেষ দিনে আটক করে আট মাস যেতে না যেতেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য আইয়ুব তাঁর নিজের রচিত সংবিধানটি ঘোষণা করার কাজটি সম্পন্ন করে নিয়েছিলেন; সে সংবিধানে সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট, দুটোই ছিল।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত