গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি।
সেলিম জাহান

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।
নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।
গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।
আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।
পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।
এই রকমের আরেকটি ধারণাকেও আমি বিমূর্তভাবে দেখিনি। ধারণাটি হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’। সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে ব্যক্তিগত বনাম গোষ্ঠীগত কল্যাণ নিয়ে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে—মূলত দার্শনিক মাত্রিকতা বনাম এর প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে। আমরা পরে এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে প্রতিটি সমাজ পৌঁছাতে চায়।
সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা ঠিক নয় যে কোনো একটি দেশ পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করতে পেরেছে। আমরা প্রায়ই সুইডেন, নরওয়ে কিংবা ডেনমার্কের উদাহরণ দিই সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে। সেসব দেশে অর্জন অনেক সামাজিক ন্যায্যতার ক্ষেত্রে, কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সেখানে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জিত হয়ে গেছে। বহুবার সেসব দেশে কার্যোপলক্ষে গিয়ে গৃহহীন মানুষের দেখা মিলেছে রাস্তায়, নেশাগ্রস্ত মানুষকে দেখেছি রেলস্টেশনে। তখনকার সুইডিশ সহপ্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লেভিনের সঙ্গে আলোচনায়ও এটা উঠে এসেছে। সুতরাং ওইসব দেশে বঞ্চিত মানুষ নেই, রাষ্ট্র সবার সবকিছু দেখছে এবং সামাজিক ন্যায্যতার দেশে মন্দ কিছু নেই—এমন ভাবাটা একটি আবেগপ্রসূত মনের ফল মাত্র।
তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতার ফারাকের দুটি উদাহরণ আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। ফলে সেসব দল বহু ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেসব দলের প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম মূল্যস্ফীতি নিয়ে। যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালার উপকরণ ব্যবহার করেও দেশের মূল্যস্ফীতির অশ্বের ঊর্ধ্বগতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেননা, মূল্যস্ফীতির বাস্তব কারণটা রয়েছে কাঠামোগত। সেখানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মিলবে না।
শেষের কথা হচ্ছে, যেকোনো আর্থসামাজিক বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাগবেই। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সেটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত বটে, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দ্বারা চালিত হতে হবে—সেটাই অভীষ্ট, তাতেই মঙ্গল।
লেখক: সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।
নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।
গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।
আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।
পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।
এই রকমের আরেকটি ধারণাকেও আমি বিমূর্তভাবে দেখিনি। ধারণাটি হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’। সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে ব্যক্তিগত বনাম গোষ্ঠীগত কল্যাণ নিয়ে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে—মূলত দার্শনিক মাত্রিকতা বনাম এর প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে। আমরা পরে এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে প্রতিটি সমাজ পৌঁছাতে চায়।
সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা ঠিক নয় যে কোনো একটি দেশ পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করতে পেরেছে। আমরা প্রায়ই সুইডেন, নরওয়ে কিংবা ডেনমার্কের উদাহরণ দিই সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে। সেসব দেশে অর্জন অনেক সামাজিক ন্যায্যতার ক্ষেত্রে, কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সেখানে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জিত হয়ে গেছে। বহুবার সেসব দেশে কার্যোপলক্ষে গিয়ে গৃহহীন মানুষের দেখা মিলেছে রাস্তায়, নেশাগ্রস্ত মানুষকে দেখেছি রেলস্টেশনে। তখনকার সুইডিশ সহপ্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লেভিনের সঙ্গে আলোচনায়ও এটা উঠে এসেছে। সুতরাং ওইসব দেশে বঞ্চিত মানুষ নেই, রাষ্ট্র সবার সবকিছু দেখছে এবং সামাজিক ন্যায্যতার দেশে মন্দ কিছু নেই—এমন ভাবাটা একটি আবেগপ্রসূত মনের ফল মাত্র।
তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতার ফারাকের দুটি উদাহরণ আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। ফলে সেসব দল বহু ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেসব দলের প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম মূল্যস্ফীতি নিয়ে। যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালার উপকরণ ব্যবহার করেও দেশের মূল্যস্ফীতির অশ্বের ঊর্ধ্বগতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেননা, মূল্যস্ফীতির বাস্তব কারণটা রয়েছে কাঠামোগত। সেখানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মিলবে না।
শেষের কথা হচ্ছে, যেকোনো আর্থসামাজিক বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাগবেই। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সেটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত বটে, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দ্বারা চালিত হতে হবে—সেটাই অভীষ্ট, তাতেই মঙ্গল।
লেখক: সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ
গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি।
সেলিম জাহান

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।
নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।
গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।
আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।
পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।
এই রকমের আরেকটি ধারণাকেও আমি বিমূর্তভাবে দেখিনি। ধারণাটি হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’। সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে ব্যক্তিগত বনাম গোষ্ঠীগত কল্যাণ নিয়ে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে—মূলত দার্শনিক মাত্রিকতা বনাম এর প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে। আমরা পরে এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে প্রতিটি সমাজ পৌঁছাতে চায়।
সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা ঠিক নয় যে কোনো একটি দেশ পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করতে পেরেছে। আমরা প্রায়ই সুইডেন, নরওয়ে কিংবা ডেনমার্কের উদাহরণ দিই সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে। সেসব দেশে অর্জন অনেক সামাজিক ন্যায্যতার ক্ষেত্রে, কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সেখানে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জিত হয়ে গেছে। বহুবার সেসব দেশে কার্যোপলক্ষে গিয়ে গৃহহীন মানুষের দেখা মিলেছে রাস্তায়, নেশাগ্রস্ত মানুষকে দেখেছি রেলস্টেশনে। তখনকার সুইডিশ সহপ্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লেভিনের সঙ্গে আলোচনায়ও এটা উঠে এসেছে। সুতরাং ওইসব দেশে বঞ্চিত মানুষ নেই, রাষ্ট্র সবার সবকিছু দেখছে এবং সামাজিক ন্যায্যতার দেশে মন্দ কিছু নেই—এমন ভাবাটা একটি আবেগপ্রসূত মনের ফল মাত্র।
তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতার ফারাকের দুটি উদাহরণ আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। ফলে সেসব দল বহু ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেসব দলের প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম মূল্যস্ফীতি নিয়ে। যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালার উপকরণ ব্যবহার করেও দেশের মূল্যস্ফীতির অশ্বের ঊর্ধ্বগতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেননা, মূল্যস্ফীতির বাস্তব কারণটা রয়েছে কাঠামোগত। সেখানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মিলবে না।
শেষের কথা হচ্ছে, যেকোনো আর্থসামাজিক বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাগবেই। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সেটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত বটে, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দ্বারা চালিত হতে হবে—সেটাই অভীষ্ট, তাতেই মঙ্গল।
লেখক: সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণ যে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তত্ত্ব দিয়ে বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। তবু অহরহ নানান তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে আমাদের জগতের বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলি। তাত্ত্বিক বহু ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমরা এমন ‘অন্ধ প্রেমে’ পড়ে যাই যে চারপাশের বাস্তবতাটুকু দেখতেই পাই না। এর ফলে, বহু ভ্রান্ত উপসংহারে গিয়ে আমরা পৌঁছাই।
নিজের কথাই বলি না কেন! ছাত্রজীবনে, শিক্ষকতার কালে, উচ্চশিক্ষার সময়ে তাত্ত্বিক ধারণা, বিতর্ক-আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। নিজেকে মননের জগতে একজন কেউকেটা বলে মনে হতো। তারুণ্যের অহম্ বোধ থেকে মনে হতো যে তত্ত্ব দিয়েই সব সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারব। নানান তাত্ত্বিকের মতামত, ধারণা আমার ঠোঁটস্থ ছিল। ফলে আমার চিন্তাচেতনায় দুটি সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক. নিজস্ব চিন্তাভাবনার বদলে আমি অন্যের ভাবনাচিন্তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। দুই. তত্ত্বের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ায় অনেক সময় আমি বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরে পড়ি।
উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক গবেষণা করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, তফাৎ রয়েছে পড়ার বইয়ের সঙ্গে জীবনের অভিজ্ঞতার। শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে দেখা গেল যে পাঠ্যপুস্তকের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলছে না। পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বইয়ের পাতায় থাকলেও বাস্তব বাজারে নেই। কল্যাণমূলক অর্থনীতির সুগভীর তত্ত্ব পুস্তকে থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার হদিস মেলে না। এইসব বোধ শিক্ষক হিসেবে আমার শিক্ষার বেসাতি সাজাতে সাহায্য করেছে এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা অর্থবহ শিক্ষাসংযোগ তৈরি করেছে। অর্থনীতির তত্ত্বের নানান কচকচিকে খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ করে সহজ ভাষায় আমি শ্রেণির দুর্বলতম শিক্ষার্থীর কাছেও পৌঁছে দিতে পেরেছি। শিক্ষক হিসেবে সেটুকুই আমার সার্থকতা।
গবেষণার জন্য বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গিয়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বৈষম্য, উন্নয়ন যে কী, তা আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারলাম। উপলব্ধি করলাম যে তাত্ত্বিক শিক্ষা কোনো বিশেষ বিষয়ের বিশ্লেষণের ও ব্যাখ্যার কিছু উপকরণের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, গবেষণা সেসব উপকরণের প্রয়োগ শেখায়। কিন্তু সেসব উপকরণ নিমিত্ত মাত্র, সেগুলো দিয়ে আমরা বাস্তব সমস্যার একটি অর্থবহ বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সেসব থেকে কিছু অর্থবহ উপসংহারে উপনীত হতে পারি। অন্য কথায়, বঞ্চনা, সমতা, বৈষম্যের ওপরে খুব জোরালো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার ছিল। দারিদ্র্য এবং অসমতা পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও তাদের গাণিতিক সূত্রও আমার আয়ত্তের মধ্যে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গবেষণা করতে গিয়ে এসব আর্থসামাজিক বিষয়ের বাস্তব স্বরূপ ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞানলাভ হলো। আমার এ জ্ঞানলাভের জন্য আমি প্রয়াত দুজন অর্থনীতিবিদের কাছে কৃতজ্ঞ—অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ও ড. মাহবুব হোসেন।
আশির দশকের কথা। গবেষণার কারণে ড. মাহবুব হোসেন ও আমি তখন ফরিদপুরে। নতুন এক প্রজাতির ধানের ফলন ভালো, খরচও কম। তবু কৃষকেরা এ ধান লাগাচ্ছেন না। কোনো তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে মাহবুব ভাই আর আমি চাষি ভাইদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কেন ওই ধানটা লাগাচ্ছেন না। একজন চাষি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘নতুন যে ধানের কথা কইতেছেন আপনেরা, তার সবই ভালো, কিন্তুক পাকনের কালে ওই ধানের শিষ চোহে দ্যাহা যায় না। শিষগুলান পাতার তলে ঢাইক্যা থাহে। কন্ স্যার, অ্যাতে কি নয়নসুখ হয়, না হেতে পরান ভরে?’ এ প্রশ্নের জবাব আমরা কেউ দিতে পারিনি। ব্যয় আর উৎপাদনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে এ বাস্তবতার ব্যাখ্যা করা যায়নি।
পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের দারিদ্র্যবিমোচন বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময় পৃথিবীর ১০০টি দেশের দারিদ্র্য ও অসমতা সম্পর্কে যে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি, কোনো তাত্ত্বিক শিক্ষাই তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মুখ্য লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাত্ত্বিক শিক্ষার সঙ্গে প্রায়োগিক বাস্তবতার সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছি। তাই দারিদ্র্য, বঞ্চনা, সমতা আমার কাছে আজ আর কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। দেশভেদে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও অসমতার স্বরূপ, তার ভিন্নতা এবং সুনির্দিষ্ট সমাধান সম্পর্কে কিছুটা হলেও জেনেছি। তাত্ত্বিক শুদ্ধতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি, বিমূর্ত কোনো ধারণা থেকে বিভ্রান্ত হইনি, উল্টাপাল্টা উদাহরণ নিয়ে বেপথু হইনি—না চিন্তায়, না কাজে।
এই রকমের আরেকটি ধারণাকেও আমি বিমূর্তভাবে দেখিনি। ধারণাটি হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায্যতা’। সামাজিক ন্যায্যতার নিরিখে ব্যক্তিগত বনাম গোষ্ঠীগত কল্যাণ নিয়ে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে—মূলত দার্শনিক মাত্রিকতা বনাম এর প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে। আমরা পরে এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা একটি আকাঙ্ক্ষা, একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে প্রতিটি সমাজ পৌঁছাতে চায়।
সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা ঠিক নয় যে কোনো একটি দেশ পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন করতে পেরেছে। আমরা প্রায়ই সুইডেন, নরওয়ে কিংবা ডেনমার্কের উদাহরণ দিই সামাজিক ন্যায্যতার ব্যাপারে। সেসব দেশে অর্জন অনেক সামাজিক ন্যায্যতার ক্ষেত্রে, কিন্তু এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সেখানে পূর্ণ সামাজিক ন্যায্যতা অর্জিত হয়ে গেছে। বহুবার সেসব দেশে কার্যোপলক্ষে গিয়ে গৃহহীন মানুষের দেখা মিলেছে রাস্তায়, নেশাগ্রস্ত মানুষকে দেখেছি রেলস্টেশনে। তখনকার সুইডিশ সহপ্রধানমন্ত্রী ইসাবেলা লেভিনের সঙ্গে আলোচনায়ও এটা উঠে এসেছে। সুতরাং ওইসব দেশে বঞ্চিত মানুষ নেই, রাষ্ট্র সবার সবকিছু দেখছে এবং সামাজিক ন্যায্যতার দেশে মন্দ কিছু নেই—এমন ভাবাটা একটি আবেগপ্রসূত মনের ফল মাত্র।
তাত্ত্বিক আলোচনা বনাম সমাজবাস্তবতার ফারাকের দুটি উদাহরণ আমাদের দেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। গণমুক্তির জন্য বহুকাল ধরেই কোনো কোনো রাজনৈতিক দল আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছে। পাঠচক্রের মাধ্যমে নানান তাত্ত্বিক আলোচনায় তারা প্রচুর সময় কাটিয়েছে, কিন্তু সেসব আলোচনা থেকে কোনো বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। ফলে সেসব দল বহু ক্ষেত্রেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং সেসব দলের প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দ্বিতীয় উদাহরণটি হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম মূল্যস্ফীতি নিয়ে। যথাযথ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতিমালার উপকরণ ব্যবহার করেও দেশের মূল্যস্ফীতির অশ্বের ঊর্ধ্বগতিকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। কেননা, মূল্যস্ফীতির বাস্তব কারণটা রয়েছে কাঠামোগত। সেখানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সমস্যার সমাধান মিলবে না।
শেষের কথা হচ্ছে, যেকোনো আর্থসামাজিক বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাগবেই। কিন্তু সমস্যা সমাধানে সেটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত বটে, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে তাত্ত্বিক শিক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দ্বারা চালিত হতে হবে—সেটাই অভীষ্ট, তাতেই মঙ্গল।
লেখক: সেলিম জাহান, অর্থনীতিবিদ

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৪ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৪ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৪ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৪ ঘণ্টা আগেসেলিম জাহান

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুসংবাদ। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও অর্থনীতিই হচ্ছে ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। মূল্যস্ফীতি থেকে কর্মহীনতা, সুযোগের অসমতা, উৎপাদন-উপকরণে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা, মৌলিক সামাজিক সেবার উন্নত মান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি হলো আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা। সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতারা এসব বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের জনালোচনায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোই একচেটিয়া প্রাধান্য পেয়ে আসছিল।
শুরুতে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই অঙ্গীকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গীকারে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপর্যুক্ত অঙ্গীকার এবং চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাসীন দলটিকে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়রেখায় সম্পন্ন এই রূপরেখা দেশের জনগণকে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেই সময়রেখা ধরে প্রতিবছর বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তের মাধ্যমে রূপরেখাটির লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতির একটি বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হবে। এতে করে অর্থনৈতিক দিক থেকে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাবে।
এই রূপরেখার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য এ রূপরেখায় কোন কোন বিষয়, সমস্যা এবং অন্তরায়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। আমার মতে, তিন ধরনের সমস্যা যেমন প্রবহমান, ঘনীভূত এবং আসন্ন সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিকট অতীতে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অর্জনের অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ে খোয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল—এই ১২ বছরে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যহার আবার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। গত তিন বছরে ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদের মধ্যে পড়েছে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্য ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। যেমন দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামে আয় অসমতায় স্থিতিশীল রয়েছে। তবে দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক সেবার নিম্নমান। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত পরিমাণগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেবার মানে কোনো গুণগত উন্নতি কিংবা পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞান কিংবা দক্ষতা অর্জন নয়, বরং সনদপ্রাপ্তিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কিন্তু উচ্চ মানসম্পন্ন সেবা প্রদান নয়। দুটি খাতেই উচ্চ মানসম্পন্ন সেবাগুলো সংরক্ষিত থাকে ধনিক শ্রেণির জন্য এবং এই জাতীয় বৈষম্যই বাংলাদেশের সমাজে অসমতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে একটা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে শ্লথগতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার অত্যন্ত কম। অতীতে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই এ ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি বোঝা যায়। বাংলাদেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ, যেখানে নেপালে তা ১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই রপ্তানি করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে এবং সেই নির্ভরতা এখনো প্রত্যক্ষ করের দিকে যায়নি।
বাংলাদেশের ঘনীভূত সমস্যাগুলোর তালিকা বেশ দীর্ঘ। কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। বর্তমানে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমস্যা হিসেবে ঘনীভূত হচ্ছে।
দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা সুবিশাল অর্থের কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা এখনো ফিরে আসেনি। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির সুবিধা নেই। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়নি এবং ৫৯ শতাংশ শিশুর জন্মসনদ নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ৬ বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে ২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ; যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজন বালিকার মধ্যে একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়নের ওপরে পড়বে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা শুধু অভাবনীয় একটি বাস্তবতাই নয়, বরং ঘনীভূত একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির আসন্ন সমস্যাগুলো দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরে থেকে উদ্ভূত। বহু বছরের ক্রমাগত হ্রাস এবং স্থবিরতার পরে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর প্রজনন হার বেড়ে গেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি এবং নগরায়ণের ওপরে এই বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। এই বৃদ্ধি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যেমন ইতিমধ্যে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ নিয়ে ঢাকা নগরী জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা তার ধারণক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। বায়ুদূষণ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো সামাজিক সেবাকাঠামো ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। মুক্ত মাঠ, পুকুর, জলাশয় হারিয়ে গিয়ে ঢাকা আজ একটি ইট-পাথরের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এসবই জনজীবনে আসন্ন এক সংকটের সৃষ্টি করবে। বৈশ্বিক অঙ্গনে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এই সংকটগুলো তার চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে এবং এগুলোকে তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক রূপরেখার মধ্যে সন্নিবেশ করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দিয়ে সরকার যদি সঠিক পথে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক পথযাত্রা গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে সমতা এবং বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করে দেশের সব মানুষের সুকল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে। যদি সে ব্যাপারে নবনির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে একটা বিশাল হৃত সুযোগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে।

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি সুসংবাদ। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষের কাছেও অর্থনীতিই হচ্ছে ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। মূল্যস্ফীতি থেকে কর্মহীনতা, সুযোগের অসমতা, উৎপাদন-উপকরণে প্রবেশাধিকারের প্রতিবন্ধকতা, মৌলিক সামাজিক সেবার উন্নত মান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি হলো আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা। সম্মেলনে রাজনৈতিক নেতারা এসব বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের জনালোচনায় রাজনৈতিক বিষয়গুলোই একচেটিয়া প্রাধান্য পেয়ে আসছিল।
শুরুতে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এই অঙ্গীকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্গীকারে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাবে, সেটাও চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উপর্যুক্ত অঙ্গীকার এবং চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তৃতীয়ত, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ক্ষমতাসীন দলটিকে বাংলাদেশের জন্য মধ্যমেয়াদি একটি অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়রেখায় সম্পন্ন এই রূপরেখা দেশের জনগণকে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে ধারণা দেবে। সেই সময়রেখা ধরে প্রতিবছর বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তের মাধ্যমে রূপরেখাটির লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতির একটি বস্তুনিষ্ঠ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হবে। এতে করে অর্থনৈতিক দিক থেকে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাবে।
এই রূপরেখার পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য এ রূপরেখায় কোন কোন বিষয়, সমস্যা এবং অন্তরায়গুলো বিবেচনায় আনা জরুরি। আমার মতে, তিন ধরনের সমস্যা যেমন প্রবহমান, ঘনীভূত এবং আসন্ন সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের প্রবহমান সমস্যাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিকট অতীতে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অর্জনের অনেকটাই সাম্প্রতিক সময়ে খোয়া গেছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল—এই ১২ বছরে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি ৪৯ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্যহার আবার ১৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে উঠে গেছে। আজকে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। গত তিন বছরে ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যের ফাঁদের মধ্যে পড়েছে। আরও ৬ কোটি ২০ লাখ লোক দারিদ্র্য ফাঁদে পড়ার হুমকিতে আছে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বাস্তবতা হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্য। যেমন দেশের উচ্চতম ২০ শতাংশ পরিবারে অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ২০, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই হার হচ্ছে হাজারে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে যদিও গ্রামে আয় অসমতায় স্থিতিশীল রয়েছে। তবে দেশের শহরাঞ্চলে তা বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক সেবার নিম্নমান। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত পরিমাণগত দিক থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেবার মানে কোনো গুণগত উন্নতি কিংবা পরিবর্তন হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞান কিংবা দক্ষতা অর্জন নয়, বরং সনদপ্রাপ্তিই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কিন্তু উচ্চ মানসম্পন্ন সেবা প্রদান নয়। দুটি খাতেই উচ্চ মানসম্পন্ন সেবাগুলো সংরক্ষিত থাকে ধনিক শ্রেণির জন্য এবং এই জাতীয় বৈষম্যই বাংলাদেশের সমাজে অসমতা ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে একটা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
তৃতীয় প্রবহমান সমস্যাটা হচ্ছে, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে শ্লথগতি। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার অত্যন্ত কম। অতীতে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভিয়েতনামের দিকে তাকালেই এ ব্যাপারে আমাদের ঘাটতি বোঝা যায়। বাংলাদেশে কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশ, যেখানে নেপালে তা ১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই রপ্তানি করের মতো অপ্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভর করেছে এবং সেই নির্ভরতা এখনো প্রত্যক্ষ করের দিকে যায়নি।
বাংলাদেশের ঘনীভূত সমস্যাগুলোর তালিকা বেশ দীর্ঘ। কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি, বিপুল বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, উল্লেখযোগ্য মানব-বঞ্চনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেড়ে বসেছে। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্প খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, দেশের অর্থনীতিতে প্রায় ১১ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়কালে পোশাকশিল্পের রপ্তানি তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান স্থবিরই থেকে গেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দেশের সার্বিক বেকারত্বের হারের দ্বিগুণ। বর্তমানে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমস্যা হিসেবে ঘনীভূত হচ্ছে।
দেশের আর্থিক খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে ৬ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা সুবিশাল অর্থের কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা এখনো ফিরে আসেনি। দারিদ্র্য-বহির্ভূত মানব-বঞ্চনা আরও তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ১১ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির সুবিধা নেই। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে ৪১ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়নি এবং ৫৯ শতাংশ শিশুর জন্মসনদ নেই। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ৫৭ শতাংশ শিশু দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। গত ৬ বছরে শিশুশ্রম বেড়ে গেছে ২০১৯ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের ৯ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৬ শতাংশ; যার মানে, ১৮ বছর অনূর্ধ্ব প্রতি দুজন বালিকার মধ্যে একজনকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়নের ওপরে পড়বে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সহিংসতা শুধু অভাবনীয় একটি বাস্তবতাই নয়, বরং ঘনীভূত একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির আসন্ন সমস্যাগুলো দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরে থেকে উদ্ভূত। বহু বছরের ক্রমাগত হ্রাস এবং স্থবিরতার পরে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নারীর প্রজনন হার বেড়ে গেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি এবং নগরায়ণের ওপরে এই বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। এই বৃদ্ধি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যেমন ইতিমধ্যে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ নিয়ে ঢাকা নগরী জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজধানী ঢাকা তার ধারণক্ষমতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে। বায়ুদূষণ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো সামাজিক সেবাকাঠামো ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। মুক্ত মাঠ, পুকুর, জলাশয় হারিয়ে গিয়ে ঢাকা আজ একটি ইট-পাথরের নগরীতে পরিণত হয়েছে। এসবই জনজীবনে আসন্ন এক সংকটের সৃষ্টি করবে। বৈশ্বিক অঙ্গনে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপের ফলে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব আসন্ন সংকটের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি এবং সেই বিপৎসংকুল পথযাত্রায় বিজ্ঞতা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে সেই বিপদ মোকাবিলা করে সব সংকট উতরে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এই সংকটগুলো তার চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে এবং এগুলোকে তার ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক রূপরেখার মধ্যে সন্নিবেশ করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাজ্ঞ নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দিয়ে সরকার যদি সঠিক পথে এগিয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক পথযাত্রা গড়ে তুলতে পারবে, যেখানে সমতা এবং বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র নিশ্চিত করে দেশের সব মানুষের সুকল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে। যদি সে ব্যাপারে নবনির্বাচিত সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে একটা বিশাল হৃত সুযোগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে।

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
২০ নভেম্বর ২০২৪
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৪ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৪ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৪ ঘণ্টা আগেরাহাত মিনহাজ

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে আলবদর ঘাতকেরা যে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেনি, তা অনেক আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এরপরও হয়তো এই সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য স্বপ্নে সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছেন। বাড়ির দরজা খুলে রেখেছেন, প্রার্থনা করেছেন, হয়তো মানত করেছেন, সদকা দিয়েছেন, পীর-ফকিরের মাজারে মাথা ঠুকেছেন। আশা—কোনো এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় সিরাজুদ্দীন ঘরে ফিরবেন। কিন্তু নাহ্, তিনি ফেরেননি!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্র অফিসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা করবে না। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সিরাজুদ্দীনের ধারণা ভুল ছিল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ইত্তেফাক ভবনে পাকিস্তানিরা দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সংবাদপত্রটির ক্যানটিন ব্যবস্থাপকের ভাতিজা। এ ছাড়া ২৬ মার্চ সকালে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দীনসহ অন্যরা। এরপর ২১ মে ১৯৭১ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারিতে সংবাদপত্রটি আবারও প্রকাশিত হয়। সেনা অধীনে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। যদিও তিনি বাধ্য হন।
দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রাণভোমরা ছিলেন সিরাজুদ্দীন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন আকস্মিকভাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রটির সবকিছু ছিলেন সিরাজুদ্দীন। তাই ১৯৭১ সালের ২১ মে থেকে নতুন করে প্রকাশের সময়ও সংবাদপত্রটির সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন এই সাংবাদিক। এ সময় বলবৎ ছিল ইয়াহিয়া খানের ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি। ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেন্সরশিপ হাউস এবং সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিক।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে অভূতপূর্ব সাংবাদিকতা করেছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ইংরেজি ও উর্দু সংবাদপত্রে কিছু সংকটের কথা প্রকাশিত হতো। বাঙালি জাতির মনোবল বাড়াতে এবং যুদ্ধ যে চলছে, সে বিষয়টি তুলে ধরতে সিরাজুদ্দীন এই সংবাদগুলো অনুবাদ করে ইত্তেফাকে প্রকাশ করতেন। লিখেছেন রাজনৈতিক ভাষ্য ও সম্পাদকীয়। যেগুলোর মধ্য দিয়ে কৌশলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এই সাংবাদিক; যা আধুনিক সংঘাতসংক্রান্ত সাংবাদিকতার বিশেষ পাঠ হতে পারে।
দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় সিরাজুদ্দীনের লেখা ‘এত দিনে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি ছাপা হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যে কালরাতে ঘাতকেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পরিবারের কাছ থেকে। ‘এত দিনে’ শিরোনামের সেই লেখায় ছিল বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বুকে যে ঘৃণ্য হামলা শুরু করেছিল, তাতে হায়েনাদের প্রধান সম্বল ছিল আমেরিকান এম-২৪ ট্যাংক। শুধু তা-ই নয়, বাঙালি জাতির ন্যায়সংগত মুক্তিসংগ্রামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চুপ ছিল। গণহত্যার প্রশ্নেও টুঁ শব্দ করেনি নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রশাসন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের পরাজয় যখন সন্নিকটে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সরব হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈত নীতি নিয়েই ছিল ‘এত দিনে’।
এই সম্পাদকীয়তে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘বিপন্ন মানবতার স্বার্থে যে সমস্যার আশু সমাধান যখন অপরিহার্য ছিল, তখনো বৃহৎ শক্তিসমূহকে ‘ঘরোয়া ব্যাপার’, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ ইত্যাদি বাগ্বিতণ্ডায় ধূম্রজাল তুলিয়া সমস্যার মানবিক দিকটি চাপা দিয়া পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো, আরো জটিল করিয়া তুলিতেই দেখা গিয়াছে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সমস্যা কী, প্রকৃত পরিস্থিতিই বা কী, তাহা যে তাহাদের অজানা ছিল তাহাও নয়।’ একেবারে যথাযথ বিশ্লেষণ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পতন ঠেকানো। যা করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
সম্পাদকীয়টিতে পরের দিকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তুলে ধরেছেন বাঙালির চাওয়া ও স্বপ্নের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বিন্দুমাত্র বুদ্ধি যাহার ঘটে আছে, তাহার পক্ষে জনগণের স্বার্থ ও জনগণের মানসিক অবস্থা আমলে না আনিয়া কোনো অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অথবা কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করাও সম্ভব নয়।’ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা। যদিও সেই বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ভিন্ন পথে হাঁটছিল। দেশ দুটির অবস্থান ছিল গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
সম্পাদকীয়টির শেষ দিকে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রশ্নেও বিশ্বের রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা সে মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিয়াছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গতকল্যকার বক্তব্যে অন্তত তাহার কোনই পরিচয় নাই। আর নাই বলিয়াই ঘটনা চলিয়াছে আপন নিয়মে।’ গতকালের বলতে এখানে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ সিনিয়রের আহ্বানকে বুঝিয়েছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় যেকোনো অবস্থায় একটা যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছাতে মরিয়া ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। কিন্তু যে আহ্বান বা প্রচেষ্টা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত।
এই সম্পাদকীয়তেও একজন দক্ষ সাংবাদিকের মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি যে একজন ‘রাজনৈতিক সাংবাদিক’ ছিলেন, ‘এত দিনে’ সম্পাদকীয়টিতে তারই প্রতিফলন ছিল।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে আলবদর ঘাতকেরা যে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেনি, তা অনেক আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। কিন্তু এরপরও হয়তো এই সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য স্বপ্নে সিরাজুদ্দীন হোসেনের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করেছেন। বাড়ির দরজা খুলে রেখেছেন, প্রার্থনা করেছেন, হয়তো মানত করেছেন, সদকা দিয়েছেন, পীর-ফকিরের মাজারে মাথা ঠুকেছেন। আশা—কোনো এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতায় সিরাজুদ্দীন ঘরে ফিরবেন। কিন্তু নাহ্, তিনি ফেরেননি!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনো অবস্থাতেই সংবাদপত্র অফিসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা করবে না। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সিরাজুদ্দীনের ধারণা ভুল ছিল। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ইত্তেফাক ভবনে পাকিস্তানিরা দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হন সংবাদপত্রটির ক্যানটিন ব্যবস্থাপকের ভাতিজা। এ ছাড়া ২৬ মার্চ সকালে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কোনোমতে প্রাণ নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দীনসহ অন্যরা। এরপর ২১ মে ১৯৭১ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারিতে সংবাদপত্রটি আবারও প্রকাশিত হয়। সেনা অধীনে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না সিরাজুদ্দীন হোসেন। যদিও তিনি বাধ্য হন।
দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রাণভোমরা ছিলেন সিরাজুদ্দীন। ১৯৬৯ সালের ১ জুন আকস্মিকভাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রটির সবকিছু ছিলেন সিরাজুদ্দীন। তাই ১৯৭১ সালের ২১ মে থেকে নতুন করে প্রকাশের সময়ও সংবাদপত্রটির সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন এই সাংবাদিক। এ সময় বলবৎ ছিল ইয়াহিয়া খানের ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি। ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের সেন্সরশিপ হাউস এবং সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিক।
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে অভূতপূর্ব সাংবাদিকতা করেছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ইংরেজি ও উর্দু সংবাদপত্রে কিছু সংকটের কথা প্রকাশিত হতো। বাঙালি জাতির মনোবল বাড়াতে এবং যুদ্ধ যে চলছে, সে বিষয়টি তুলে ধরতে সিরাজুদ্দীন এই সংবাদগুলো অনুবাদ করে ইত্তেফাকে প্রকাশ করতেন। লিখেছেন রাজনৈতিক ভাষ্য ও সম্পাদকীয়। যেগুলোর মধ্য দিয়ে কৌশলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সলতেটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এই সাংবাদিক; যা আধুনিক সংঘাতসংক্রান্ত সাংবাদিকতার বিশেষ পাঠ হতে পারে।
দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় সিরাজুদ্দীনের লেখা ‘এত দিনে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি ছাপা হয়েছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। যে কালরাতে ঘাতকেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল পরিবারের কাছ থেকে। ‘এত দিনে’ শিরোনামের সেই লেখায় ছিল বাংলাদেশ ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার বুকে যে ঘৃণ্য হামলা শুরু করেছিল, তাতে হায়েনাদের প্রধান সম্বল ছিল আমেরিকান এম-২৪ ট্যাংক। শুধু তা-ই নয়, বাঙালি জাতির ন্যায়সংগত মুক্তিসংগ্রামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিশ্চুপ ছিল। গণহত্যার প্রশ্নেও টুঁ শব্দ করেনি নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রশাসন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের পরাজয় যখন সন্নিকটে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা সরব হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈত নীতি নিয়েই ছিল ‘এত দিনে’।
এই সম্পাদকীয়তে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘বিপন্ন মানবতার স্বার্থে যে সমস্যার আশু সমাধান যখন অপরিহার্য ছিল, তখনো বৃহৎ শক্তিসমূহকে ‘ঘরোয়া ব্যাপার’, ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ ইত্যাদি বাগ্বিতণ্ডায় ধূম্রজাল তুলিয়া সমস্যার মানবিক দিকটি চাপা দিয়া পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো, আরো জটিল করিয়া তুলিতেই দেখা গিয়াছে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সমস্যা কী, প্রকৃত পরিস্থিতিই বা কী, তাহা যে তাহাদের অজানা ছিল তাহাও নয়।’ একেবারে যথাযথ বিশ্লেষণ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পতন ঠেকানো। যা করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
সম্পাদকীয়টিতে পরের দিকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তুলে ধরেছেন বাঙালির চাওয়া ও স্বপ্নের কথা। তিনি লিখেছেন, ‘বিন্দুমাত্র বুদ্ধি যাহার ঘটে আছে, তাহার পক্ষে জনগণের স্বার্থ ও জনগণের মানসিক অবস্থা আমলে না আনিয়া কোনো অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা অথবা কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করাও সম্ভব নয়।’ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা। যদিও সেই বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ভিন্ন পথে হাঁটছিল। দেশ দুটির অবস্থান ছিল গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত।
সম্পাদকীয়টির শেষ দিকে সিরাজুদ্দীন হোসেন লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের প্রশ্নেও বিশ্বের রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা সে মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিয়াছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গতকল্যকার বক্তব্যে অন্তত তাহার কোনই পরিচয় নাই। আর নাই বলিয়াই ঘটনা চলিয়াছে আপন নিয়মে।’ গতকালের বলতে এখানে ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ সিনিয়রের আহ্বানকে বুঝিয়েছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ সময় যেকোনো অবস্থায় একটা যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছাতে মরিয়া ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। কিন্তু যে আহ্বান বা প্রচেষ্টা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত।
এই সম্পাদকীয়তেও একজন দক্ষ সাংবাদিকের মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি যে একজন ‘রাজনৈতিক সাংবাদিক’ ছিলেন, ‘এত দিনে’ সম্পাদকীয়টিতে তারই প্রতিফলন ছিল।

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
২০ নভেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৪ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৪ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৪ ঘণ্টা আগেআন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস
হাসান আলী

বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ আমাদের দেশের অবহেলিত প্রবীণদের বঞ্চনা এবং তাঁদের অধিকার পাওয়া নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণ মানুষ বসবাস করছেন। এই সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান
নয়, এটি দুই কোটি জীবনের গল্প, ত্যাগের ইতিহাস, সংগ্রামের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দুই কোটি প্রবীণের একটি বড় অংশ আজও মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকে অনিশ্চয়তা, অবহেলা ও একাকিত্বের বোঝা তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ বলতে প্রথমে বুঝি, ভাত, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসা। কিন্তু বাস্তবে কতজন প্রবীণ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পান? কতজন প্রবীণ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পান? অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা শেষ বয়সে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন সন্তানের অবহেলায়, অর্থের অভাবে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা—এ কি মানুষের মৌলিক অধিকার হতে পারে?
প্রবীণের অধিকার শুধু খাদ্য বা চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, সম্মান পাওয়াও একটি মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আজ অনেক ঘরে প্রবীণেরা হয়ে উঠছেন ‘বোঝা’। সংসারের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সন্তানেরা তাঁদের মতামতের মূল্য দেন না। ছোট ছোট বিষয়েও উপেক্ষা করা হয় তাঁদের মতামত। অথচ একসময় এই মানুষেরা হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সংসারের তাকত বোঝা বহন করেছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’—বাক্যটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি। কিন্তু কত প্রবীণ আজ ভয় নিয়ে দিন কাটান—এই বুঝি বাড়ি তাঁকে থেকে বের করে দেওয়া হলো, এই বুঝি জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেল, এই বুঝি সন্তান মুখ ফিরিয়ে নিল! এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কোনো মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের জন্য কখনোই কাম্য হতে পারে না।
গ্রাম হোক কিংবা শহর—চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। কোথাও প্রবীণ মা-বাবা সারা দিন একাকিত্বে দিন কাটান, কোথাও বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এই মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগের ওপরেই গড়ে উঠেছে আজকের পরিবার ও সমাজের ভিত্তি।
মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবাধিকার মানে শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি নয়, এটি ঘরের ভেতরের আচরণও। প্রবীণকে সময় দেওয়া, তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা, অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো, একাকিত্বে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া—এসবই মানবাধিকারের জীবন্ত প্রকাশ।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণ ভাতা, বিনা মূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা, নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা—এসব নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক প্রবীণ এসব সুযোগ সম্পর্কে জানেন না, আবার অনেকে পেতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হন। শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
যেভাবে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া একমুহূর্তও চলতে পারি না, তেমনি প্রবীণদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলো উপেক্ষা করে কোনো সভ্য সমাজ টিকে থাকতে পারে না। প্রবীণেরা শুধু আমাদের অতীতের মানুষ নন,
তাঁরা আমাদের বর্তমানের অভিভাবক এবং ভবিষ্যতের জন্য এক জীবন্ত শিক্ষালয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস তখনই পালন করা সার্থক হবে, যখন আমরা আমাদের বাবা-মাকে ‘বোঝা’ নয়, ‘বটবৃক্ষ’ হিসেবে দেখব। প্রবীণের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে দয়া নয়; অধিকার হিসেবে মান্য করব এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবীণবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে পারব। কারণ, যে সমাজ তার প্রবীণদের সম্মান করতে জানে না, সে সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে মানবিক হতে পারে না। মানবাধিকারের আলো তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেই আলো দুই কোটি প্রবীণের চোখেও নিরাপদ আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠবে।

বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ আমাদের দেশের অবহেলিত প্রবীণদের বঞ্চনা এবং তাঁদের অধিকার পাওয়া নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি প্রবীণ মানুষ বসবাস করছেন। এই সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান
নয়, এটি দুই কোটি জীবনের গল্প, ত্যাগের ইতিহাস, সংগ্রামের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বিশাল ভান্ডার। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এই দুই কোটি প্রবীণের একটি বড় অংশ আজও মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অনেকে অনিশ্চয়তা, অবহেলা ও একাকিত্বের বোঝা তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ বলতে প্রথমে বুঝি, ভাত, কাপড়, বাসস্থান ও চিকিৎসা। কিন্তু বাস্তবে কতজন প্রবীণ নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পান? কতজন প্রবীণ নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পান? অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা শেষ বয়সে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন সন্তানের অবহেলায়, অর্থের অভাবে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা—এ কি মানুষের মৌলিক অধিকার হতে পারে?
প্রবীণের অধিকার শুধু খাদ্য বা চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, সম্মান পাওয়াও একটি মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আজ অনেক ঘরে প্রবীণেরা হয়ে উঠছেন ‘বোঝা’। সংসারের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সন্তানেরা তাঁদের মতামতের মূল্য দেন না। ছোট ছোট বিষয়েও উপেক্ষা করা হয় তাঁদের মতামত। অথচ একসময় এই মানুষেরা হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সংসারের তাকত বোঝা বহন করেছেন।
‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’—বাক্যটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি। কিন্তু কত প্রবীণ আজ ভয় নিয়ে দিন কাটান—এই বুঝি বাড়ি তাঁকে থেকে বের করে দেওয়া হলো, এই বুঝি জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেল, এই বুঝি সন্তান মুখ ফিরিয়ে নিল! এই ভয়, এই অনিশ্চয়তা কোনো মানুষের জীবনের শেষ অধ্যায়ের জন্য কখনোই কাম্য হতে পারে না।
গ্রাম হোক কিংবা শহর—চিত্র খুব একটা আলাদা নয়। কোথাও প্রবীণ মা-বাবা সারা দিন একাকিত্বে দিন কাটান, কোথাও বৃদ্ধ বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এই মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ শ্রম, ভালোবাসা ও ত্যাগের ওপরেই গড়ে উঠেছে আজকের পরিবার ও সমাজের ভিত্তি।
মানবাধিকার দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবাধিকার মানে শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি নয়, এটি ঘরের ভেতরের আচরণও। প্রবীণকে সময় দেওয়া, তাঁর কথা মন দিয়ে শোনা, অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়ানো, একাকিত্বে তাঁকে সঙ্গ দেওয়া—এসবই মানবাধিকারের জীবন্ত প্রকাশ।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণ ভাতা, বিনা মূল্যে কিংবা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা, নিরাপদ আশ্রয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা—এসব নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক প্রবীণ এসব সুযোগ সম্পর্কে জানেন না, আবার অনেকে পেতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হন। শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি।
যেভাবে আমরা নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া একমুহূর্তও চলতে পারি না, তেমনি প্রবীণদের দৈনন্দিন চাহিদাগুলো উপেক্ষা করে কোনো সভ্য সমাজ টিকে থাকতে পারে না। প্রবীণেরা শুধু আমাদের অতীতের মানুষ নন,
তাঁরা আমাদের বর্তমানের অভিভাবক এবং ভবিষ্যতের জন্য এক জীবন্ত শিক্ষালয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস তখনই পালন করা সার্থক হবে, যখন আমরা আমাদের বাবা-মাকে ‘বোঝা’ নয়, ‘বটবৃক্ষ’ হিসেবে দেখব। প্রবীণের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সম্মানকে দয়া নয়; অধিকার হিসেবে মান্য করব এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রবীণবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে পারব। কারণ, যে সমাজ তার প্রবীণদের সম্মান করতে জানে না, সে সমাজ কখনোই প্রকৃত অর্থে মানবিক হতে পারে না। মানবাধিকারের আলো তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন সেই আলো দুই কোটি প্রবীণের চোখেও নিরাপদ আশার আলো হয়ে জ্বলে উঠবে।

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
২০ নভেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৪ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৪ ঘণ্টা আগে
মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা
৪ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা ও মেয়েকে খুন করে স্কুলের পোশাক পরে তিনি বেরিয়ে গেছেন। এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিস নেই। এ ছাড়া আর কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কি না, পুলিশ তা নিয়ে তদন্ত করছে।
নিজ বাড়িতে মানুষ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। প্রতিকারের জন্য কারও কাছে গেলে কতটা উপকার পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় আছে। মানুষ তার করের টাকা যেসব কারণে দিয়ে থাকে, তার একটি তো নিরাপত্তা। সরকার এমন কোনো বার্তা দিতে পারছে না, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারে। নিজের বাড়িতেই মানুষ নিরাপদ নয়—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের এ এক বড় ব্যর্থতা।
মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এই জোড়া খুনের ঘটনা কয়েকটি বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাড়ির দারোয়ান এবং গৃহকর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। আমাদের দেশে যাচাই-বাছাই না করে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই কোনো অপরাধী কৌশলে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে গেলে তার পক্ষে সহজে অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়। লোক নিয়োগ করার সময় তাই খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সন্দেহ থেকে নয়, দায়িত্বের জায়গা থেকে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কাউকে নিয়োগ করার সময় তার পরিচয়পত্র দেখা এবং তার কপি সংরক্ষণ করা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত না হলেও নিয়োগের আগে পরিচিত কারও কাছ থেকে রেফারেন্স নেওয়ার চল থাকা দরকার। কর্মীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার পাশাপাশি এখন যেখানে তার বসবাস, সেই বাড়ির মালিক ও ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া জরুরি। বাড়িতে যাঁরা দারোয়ানের কাজ করেন, তাঁদের অনেকের চোখের সামনে সিসিটিভি থাকলেও তাঁরা সব সময় সেদিকে দৃষ্টি রাখেন না। একটানা মোবাইলের দিকে চোখ রাখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহকর্মী কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর কাছে মূল্যবান কোনো সামগ্রী থাকলে গৃহকর্তা সেটা আগেই দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মীকে জানিয়ে রাখবেন, এ রকম রীতি থাকা দরকার। গৃহকর্তার কাছ থেকে সে রকম তথ্য না পেয়ে থাকলে নিরাপত্তাকর্মীরা মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেবেন না।
বাড়িতে কে কখন ঢুকল, তা নিয়ে আগমন, প্রস্থান রেজিস্টার রাখা দরকার। প্রয়োজনে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে প্রতিবেশী ও পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি। নিছক অল্পকিছু অর্থ বা অলংকারের লোভে খুন করার এই মানসিকতা যে বিকারের জন্ম দেয়, তার প্রতিকার সন্ধানে নিবিষ্ট হওয়া জরুরি।

মোহাম্মদপুরে ৮ ডিসেম্বর সোমবার সকালে খুন হলেন মা ও মেয়ে। দীর্ঘদিন শাহজাহান রোডের আমেনাস ড্রিম নামের যে বাড়িতে তাঁরা বসবাস করছিলেন, সেই বাড়িতেই গৃহকর্মীর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন তাঁরা। ১৪ তলা ভবনের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, বোরকা পরে এই গৃহকর্মী ঢুকেছিলেন ফ্ল্যাটে, মা ও মেয়েকে খুন করে স্কুলের পোশাক পরে তিনি বেরিয়ে গেছেন। এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিস নেই। এ ছাড়া আর কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কি না, পুলিশ তা নিয়ে তদন্ত করছে।
নিজ বাড়িতে মানুষ নিরাপদ নয়। বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। প্রতিকারের জন্য কারও কাছে গেলে কতটা উপকার পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় আছে। মানুষ তার করের টাকা যেসব কারণে দিয়ে থাকে, তার একটি তো নিরাপত্তা। সরকার এমন কোনো বার্তা দিতে পারছে না, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারে। নিজের বাড়িতেই মানুষ নিরাপদ নয়—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের এ এক বড় ব্যর্থতা।
মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এই জোড়া খুনের ঘটনা কয়েকটি বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাড়ির দারোয়ান এবং গৃহকর্মীরাও হয়ে উঠতে পারেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। আমাদের দেশে যাচাই-বাছাই না করে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাই কোনো অপরাধী কৌশলে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে গেলে তার পক্ষে সহজে অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়। লোক নিয়োগ করার সময় তাই খুবই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সন্দেহ থেকে নয়, দায়িত্বের জায়গা থেকে এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কাউকে নিয়োগ করার সময় তার পরিচয়পত্র দেখা এবং তার কপি সংরক্ষণ করা অবশ্যকর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত না হলেও নিয়োগের আগে পরিচিত কারও কাছ থেকে রেফারেন্স নেওয়ার চল থাকা দরকার। কর্মীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার পাশাপাশি এখন যেখানে তার বসবাস, সেই বাড়ির মালিক ও ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া জরুরি। বাড়িতে যাঁরা দারোয়ানের কাজ করেন, তাঁদের অনেকের চোখের সামনে সিসিটিভি থাকলেও তাঁরা সব সময় সেদিকে দৃষ্টি রাখেন না। একটানা মোবাইলের দিকে চোখ রাখার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহকর্মী কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর কাছে মূল্যবান কোনো সামগ্রী থাকলে গৃহকর্তা সেটা আগেই দারোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মীকে জানিয়ে রাখবেন, এ রকম রীতি থাকা দরকার। গৃহকর্তার কাছ থেকে সে রকম তথ্য না পেয়ে থাকলে নিরাপত্তাকর্মীরা মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেবেন না।
বাড়িতে কে কখন ঢুকল, তা নিয়ে আগমন, প্রস্থান রেজিস্টার রাখা দরকার। প্রয়োজনে নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে প্রতিবেশী ও পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা জরুরি। নিছক অল্পকিছু অর্থ বা অলংকারের লোভে খুন করার এই মানসিকতা যে বিকারের জন্ম দেয়, তার প্রতিকার সন্ধানে নিবিষ্ট হওয়া জরুরি।

যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
২০ নভেম্বর ২০২৪
সম্প্রতি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তাঁরা সরকার গঠন করলে দেশের অর্থনীতিই হবে তাঁদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ দেশের নাগরিকদে
৪ ঘণ্টা আগে
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর ঘাতকেরা ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর, মধ্যরাতে। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদররা যে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল, সিরাজুদ্দীন ছিলেন তার প্রথম শিকার। এরপর তিনি আর ফেরেননি, মরদেহও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন কলমসৈনিককে
৪ ঘণ্টা আগে
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ২০২৫ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘আওয়ার এভরিডে অ্যাসেনশিয়ালস’; অর্থাৎ, ‘আমাদের প্রতিদিনের অত্যাবশ্যকীয়তা’ কথাটি শুনতে সহজ মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোর কথা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আজ
৪ ঘণ্টা আগে