বিশ্ববাসী জানে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আগ্রাসী বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নজিরবিহীনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
চিররঞ্জন সরকার
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা বাঁচাতে হয়। আর এই নতুন নোবেল-থিয়েটারের অন্যতম প্রধান চরিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প—যিনি মনে করেন, পৃথিবীতে শান্তি, সভ্যতা এবং সম্ভবত সূর্যের উদয়ও তাঁর জন্যই সম্ভব হয়!
ট্রাম্পের পুরস্কার-আকাঙ্ক্ষা মোটেও গোপন নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে তিনি দেখলেন—বারাক ওবামা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সহযোগিতা জোরদারের অসাধারণ প্রচেষ্টার’ জন্য। অথচ তখনো আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছেই, ইরাক থেকে ধোঁয়া উঠছে, লিবিয়ায় ন্যাটোর বোমা ঝরছে, আর ড্রোন হামলা পাকিস্তান থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। ট্রাম্পের চোখে এটি একেবারেই বেমানান—যেন কাউকে ফুটবল ম্যাচ শুরুর আগে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ ট্রফি দিয়ে দেওয়া।
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ‘তাদের রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সার্বিয়া, কসোভো এবং ভারত-পাকিস্তানের জন্য আমাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। আমার এটি চার বা পাঁচবার পাওয়া উচিত ছিল।’ পুরস্কারের প্রতি তাঁর এই হতাশা এতটাই তীব্র যে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে নিজের ভূমিকা নিয়ে মিথ্যা দাবি করেছেন। এমনকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্যে অস্বীকার করার পরও তিনি তাঁর দাবি থেকে সরেননি। গত ২০ জুন তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তিনি ছয়বার পুরস্কারের কথা উল্লেখ করে তাঁর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এবং বলেন, ‘এটা খুবই খারাপ। আমি এটির যোগ্য, কিন্তু তারা আমাকে এটি কখনোই দেবে না।’
ট্রাম্প ওবামাকে পুরস্কার দেওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে টুইট করেছিলেন, ‘ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই একটি উপহার পেয়েছিলেন এবং তিনি জানেন না কেন তিনি এটি পেয়েছেন...এই বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একমত।’ ট্রাম্পের মতে, রুশ-ইউক্রেনীয় সংঘাত সমাধান করতে না পারা তাঁকে নোবেল থেকে বঞ্চিত করেছে। পরে তিনি ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য ন্যাটোকে উৎসাহিত করেন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবেন।
বর্তমানে, ট্রাম্প মধ্যস্থতার কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অহমিকা তুষ্ট করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা। তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান দাবি করে যে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত অবসানে ট্রাম্পের ‘নির্ধারক কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের’ কারণে তারা ট্রাম্পকে মনোনীত করছে। পাকিস্তানের জন্য ট্রাম্পের এই নিয়মিত ঘোষণা জীবন রক্ষাকারী। কারণ, চিরশত্রু ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির জন্য বাধ্য হওয়াকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সমতুল্য মনে করে, যা ইমরান খানের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের পথ খুলে দিতে পারে। ট্রাম্পের অহমিকা তোষণে সর্বশেষ যোগ দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একজন বিচক্ষণ নেতা এবং তিনি মার্কিন সমর্থনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়া ইসরায়েল ইরানে তার অর্ধেক লক্ষ্যও অর্জন করতে পারত না। নেতানিয়াহু কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং ট্রাম্পের অহমিকাকে আরও উসকে দিতে তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। তিনি ট্রাম্পকে বলেন, ‘আমি কেবল ইসরায়েলিদের নয়, ইহুদি জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা প্রকাশ করতে চাই...আপনারা এর যোগ্য।’ ট্রাম্প খুশিতে উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে আসা, এটি খুবই অর্থবহ।’ এটি লক্ষণীয় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গণহত্যার পরোয়ানার মুখোমুখি হওয়া নেতানিয়াহু এমন একজনকে মনোনীত করছেন, যিনি তাঁকে সেই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন।
নরওয়ে আইসিসির রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাই নেতানিয়াহু তাদের দেশে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ জারি আছে। তাই ইসরায়েলের মনোনয়নের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু, নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে তোষামোদ করে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেছেন। সিএনএন মন্তব্য করেছে, ‘পুরস্কারটি ট্রাম্পের চূড়ান্ত স্থিরতা হয়ে উঠেছে, যা তিনি মনে করেন বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য প্রাপ্য।’ দেশগুলোও ট্রাম্পের এই দুর্বলতা বুঝতে পেরে তা কাজে লাগাচ্ছে।
ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদে একাধিক মনোনয়ন পেলেও কখনো নোবেল পাননি। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তারা আমাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেবে না। কারণ, তারা কেবল উদারপন্থীদেরই এটি দেয়।’ এই পুরস্কার নরওয়েজিয়ান সংসদের মনোনীত পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত হয়।
এ বছরের পুরস্কারের ঘোষণা হবে ১০ অক্টোবর। ট্রাম্পের নাম তাতে না থাকলেও, তিনি আশা ছাড়ছেন না—কারণ, লক্ষ্য এখন ২০২৬ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। এর জন্য তাঁর কূটনৈতিক অ্যাজেন্ডা স্পষ্ট: গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা। সমস্যা হলো, গাজায় শান্তি আনার ইচ্ছে নেতানিয়াহুর নেই; যুদ্ধই তাঁর রাজনৈতিক অক্সিজেন। যুদ্ধ থেমে গেলে তাঁর ক্ষমতার মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে—যেন কারও বিয়ে বাঁচছে কেবল ঝগড়ার ওপর ভর করে।
রাশিয়াও যুদ্ধ থামাতে রাজি নয়। কারণ, এতে তাদের দখলদারি অ্যাজেন্ডা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য ট্রাম্পের মন জয় করা মানে একপ্রকার নোবেল-নমিনেশন বিনিময়ে সামরিক সহায়তার অফার। এ রকম প্রকাশ্য মনোমুগ্ধতার ব্যবসা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এতটাই বিরল যে এর থেকে ভালো কৌতুক লিখতে হলে হয়তো চার্লি চ্যাপলিনকেও নতুন করে জীবিত হতে হবে। কিন্তু, যেহেতু কথা ট্রাম্পকে নিয়ে—তাই এ ক্ষেত্রে সবকিছুই সম্ভব!
বিশ্ববাসী জানে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আগ্রাসী বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নজিরবিহীনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষত, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতেও এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। পুরোনো মিত্রদের প্রতি তাঁর উদাসীনতা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত (যেমন জলবায়ু চুক্তি বা ইরানের পারমাণবিক চুক্তি) কূটনৈতিক অঙ্গনে একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশকে সরাসরি হুমকি দেওয়া এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগের ইঙ্গিত দেওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অনেক অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাটো জোটের মতো পুরোনো সামরিক জোটগুলোর প্রতি তাঁর নেতিবাচক মনোভাব অনেক সদস্যদেশের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতিগুলো গোটা বিশ্বে একধরনের ‘ট্রাম্প-আতঙ্ক’ ছড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে দেশগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। অথচ তিনিই এখন শান্তির দূত সেজে নোবেলের জন্য প্রাণপাত করছেন। এটাই হয়তো ইতিহাসের নির্মম রসিকতা।
কখনো যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো কিংবদন্তিদের হাতে গেছে, তা এখন অনেকটাই হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক তোষামোদ প্রতিযোগিতা। ভবিষ্যতে হয়তো একটি নতুন ক্যাটাগরি চালু হবে—‘সর্বাধিক আত্মপ্রচারমূলক শান্তি প্রচেষ্টা’—যেখানে ট্রাম্পের জেতা প্রায় নিশ্চিত। পুরস্কার হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো বলবেন, ‘দেখুন, অবশেষে নোবেলও বুঝতে পেরেছে আমি-ই শান্তির প্রতিমূর্তি—যে প্রতিমূর্তি প্রতিদিন সকালে আয়নায় আমাকেই হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়।’
আর সেই মুহূর্তে হয়তো বিশ্বজুড়ে টিভি দর্শকেরা একই সঙ্গে হেসেও ফেলবে, দীর্ঘশ্বাসও ফেলবে। কারণ, এই দৃশ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে নোবেল পুরস্কারের অতীত মর্যাদার ম্লান হয়ে যাওয়ার নির্মম সত্য।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা বাঁচাতে হয়। আর এই নতুন নোবেল-থিয়েটারের অন্যতম প্রধান চরিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প—যিনি মনে করেন, পৃথিবীতে শান্তি, সভ্যতা এবং সম্ভবত সূর্যের উদয়ও তাঁর জন্যই সম্ভব হয়!
ট্রাম্পের পুরস্কার-আকাঙ্ক্ষা মোটেও গোপন নয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় এসে তিনি দেখলেন—বারাক ওবামা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সহযোগিতা জোরদারের অসাধারণ প্রচেষ্টার’ জন্য। অথচ তখনো আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছেই, ইরাক থেকে ধোঁয়া উঠছে, লিবিয়ায় ন্যাটোর বোমা ঝরছে, আর ড্রোন হামলা পাকিস্তান থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছে। ট্রাম্পের চোখে এটি একেবারেই বেমানান—যেন কাউকে ফুটবল ম্যাচ শুরুর আগে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ ট্রফি দিয়ে দেওয়া।
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ‘তাদের রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সার্বিয়া, কসোভো এবং ভারত-পাকিস্তানের জন্য আমাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত ছিল। আমার এটি চার বা পাঁচবার পাওয়া উচিত ছিল।’ পুরস্কারের প্রতি তাঁর এই হতাশা এতটাই তীব্র যে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে নিজের ভূমিকা নিয়ে মিথ্যা দাবি করেছেন। এমনকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্যে অস্বীকার করার পরও তিনি তাঁর দাবি থেকে সরেননি। গত ২০ জুন তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তিনি ছয়বার পুরস্কারের কথা উল্লেখ করে তাঁর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন এবং বলেন, ‘এটা খুবই খারাপ। আমি এটির যোগ্য, কিন্তু তারা আমাকে এটি কখনোই দেবে না।’
ট্রাম্প ওবামাকে পুরস্কার দেওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে টুইট করেছিলেন, ‘ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই একটি উপহার পেয়েছিলেন এবং তিনি জানেন না কেন তিনি এটি পেয়েছেন...এই বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একমত।’ ট্রাম্পের মতে, রুশ-ইউক্রেনীয় সংঘাত সমাধান করতে না পারা তাঁকে নোবেল থেকে বঞ্চিত করেছে। পরে তিনি ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য ন্যাটোকে উৎসাহিত করেন এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবেন।
বর্তমানে, ট্রাম্প মধ্যস্থতার কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অহমিকা তুষ্ট করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা। তাঁর নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান দাবি করে যে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত অবসানে ট্রাম্পের ‘নির্ধারক কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের’ কারণে তারা ট্রাম্পকে মনোনীত করছে। পাকিস্তানের জন্য ট্রাম্পের এই নিয়মিত ঘোষণা জীবন রক্ষাকারী। কারণ, চিরশত্রু ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির জন্য বাধ্য হওয়াকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সমতুল্য মনে করে, যা ইমরান খানের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের পথ খুলে দিতে পারে। ট্রাম্পের অহমিকা তোষণে সর্বশেষ যোগ দিয়েছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একজন বিচক্ষণ নেতা এবং তিনি মার্কিন সমর্থনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়া ইসরায়েল ইরানে তার অর্ধেক লক্ষ্যও অর্জন করতে পারত না। নেতানিয়াহু কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং ট্রাম্পের অহমিকাকে আরও উসকে দিতে তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। তিনি ট্রাম্পকে বলেন, ‘আমি কেবল ইসরায়েলিদের নয়, ইহুদি জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা প্রকাশ করতে চাই...আপনারা এর যোগ্য।’ ট্রাম্প খুশিতে উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে আসা, এটি খুবই অর্থবহ।’ এটি লক্ষণীয় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গণহত্যার পরোয়ানার মুখোমুখি হওয়া নেতানিয়াহু এমন একজনকে মনোনীত করছেন, যিনি তাঁকে সেই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন।
নরওয়ে আইসিসির রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাই নেতানিয়াহু তাদের দেশে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ জারি আছে। তাই ইসরায়েলের মনোনয়নের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু, নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে তোষামোদ করে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেছেন। সিএনএন মন্তব্য করেছে, ‘পুরস্কারটি ট্রাম্পের চূড়ান্ত স্থিরতা হয়ে উঠেছে, যা তিনি মনে করেন বিশ্বজুড়ে সংঘাত নিরসনে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য প্রাপ্য।’ দেশগুলোও ট্রাম্পের এই দুর্বলতা বুঝতে পেরে তা কাজে লাগাচ্ছে।
ট্রাম্প তাঁর আগের মেয়াদে একাধিক মনোনয়ন পেলেও কখনো নোবেল পাননি। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তারা আমাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেবে না। কারণ, তারা কেবল উদারপন্থীদেরই এটি দেয়।’ এই পুরস্কার নরওয়েজিয়ান সংসদের মনোনীত পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির একটি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত হয়।
এ বছরের পুরস্কারের ঘোষণা হবে ১০ অক্টোবর। ট্রাম্পের নাম তাতে না থাকলেও, তিনি আশা ছাড়ছেন না—কারণ, লক্ষ্য এখন ২০২৬ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। এর জন্য তাঁর কূটনৈতিক অ্যাজেন্ডা স্পষ্ট: গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা। সমস্যা হলো, গাজায় শান্তি আনার ইচ্ছে নেতানিয়াহুর নেই; যুদ্ধই তাঁর রাজনৈতিক অক্সিজেন। যুদ্ধ থেমে গেলে তাঁর ক্ষমতার মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে—যেন কারও বিয়ে বাঁচছে কেবল ঝগড়ার ওপর ভর করে।
রাশিয়াও যুদ্ধ থামাতে রাজি নয়। কারণ, এতে তাদের দখলদারি অ্যাজেন্ডা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য ট্রাম্পের মন জয় করা মানে একপ্রকার নোবেল-নমিনেশন বিনিময়ে সামরিক সহায়তার অফার। এ রকম প্রকাশ্য মনোমুগ্ধতার ব্যবসা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এতটাই বিরল যে এর থেকে ভালো কৌতুক লিখতে হলে হয়তো চার্লি চ্যাপলিনকেও নতুন করে জীবিত হতে হবে। কিন্তু, যেহেতু কথা ট্রাম্পকে নিয়ে—তাই এ ক্ষেত্রে সবকিছুই সম্ভব!
বিশ্ববাসী জানে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আগ্রাসী বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নজিরবিহীনভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। বাণিজ্য শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষত, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু অর্থনীতিতেই নয়, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতিতেও এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। পুরোনো মিত্রদের প্রতি তাঁর উদাসীনতা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত (যেমন জলবায়ু চুক্তি বা ইরানের পারমাণবিক চুক্তি) কূটনৈতিক অঙ্গনে একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশকে সরাসরি হুমকি দেওয়া এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগের ইঙ্গিত দেওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অনেক অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ন্যাটো জোটের মতো পুরোনো সামরিক জোটগুলোর প্রতি তাঁর নেতিবাচক মনোভাব অনেক সদস্যদেশের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতিগুলো গোটা বিশ্বে একধরনের ‘ট্রাম্প-আতঙ্ক’ ছড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে দেশগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। অথচ তিনিই এখন শান্তির দূত সেজে নোবেলের জন্য প্রাণপাত করছেন। এটাই হয়তো ইতিহাসের নির্মম রসিকতা।
কখনো যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো কিংবদন্তিদের হাতে গেছে, তা এখন অনেকটাই হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক তোষামোদ প্রতিযোগিতা। ভবিষ্যতে হয়তো একটি নতুন ক্যাটাগরি চালু হবে—‘সর্বাধিক আত্মপ্রচারমূলক শান্তি প্রচেষ্টা’—যেখানে ট্রাম্পের জেতা প্রায় নিশ্চিত। পুরস্কার হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি হয়তো বলবেন, ‘দেখুন, অবশেষে নোবেলও বুঝতে পেরেছে আমি-ই শান্তির প্রতিমূর্তি—যে প্রতিমূর্তি প্রতিদিন সকালে আয়নায় আমাকেই হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়।’
আর সেই মুহূর্তে হয়তো বিশ্বজুড়ে টিভি দর্শকেরা একই সঙ্গে হেসেও ফেলবে, দীর্ঘশ্বাসও ফেলবে। কারণ, এই দৃশ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে নোবেল পুরস্কারের অতীত মর্যাদার ম্লান হয়ে যাওয়ার নির্মম সত্য।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
৩ ঘণ্টা আগেপ্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১ দিন আগেদেশে নারী জাগরণ অভূতপূর্ব। এটা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। বীরকন্যা প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া থেকে জাহানারা ইমামে এর উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে নারীর অধীনে। এরশাদের পতনের পর সরাসরি সামরিক শাসনের অবসান হলে খালেদা জিয়া দেশ শাসনে আসেন।
১ দিন আগে