Ajker Patrika

বন্দোবস্ত, বয়ান ও বৈষম্যবিরোধী ব্যবস্থার অবস্থা

আব্দুর রাজ্জাক 
বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলেও মানুষ মনে করত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে। ফাইল ছবি
বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলেও মানুষ মনে করত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে। ফাইল ছবি

গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’। এটা বিশেষ করে শোনা গিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মুখে—পুরোনো বন্দোবস্ত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বন্দোবস্তে পদার্পণ করতে হবে। এর অর্থ দাঁড়ায়—পুরোনো ব্যবস্থা খারাপ, নতুন ভালো ব্যবস্থা করতে হবে।

এই বন্দোবস্তের কথা আগেও আমরা শুনেছি। ইতিহাস পড়ার সময় লর্ড কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা সবার জানা। তারপর দেশভাগের পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রজাস্বত্ব আইন করে কৃষকদের মাঝে জমির বণ্টন ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া, গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে, কোনো কোনো সম্পত্তি বা জমির মালিকেরা যদি এলাকায় না থাকেন, তাঁরা এক-দুই বছরের জন্য বা কোনো বর্গাচাষির কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দোবস্ত দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে চলে আসেন।

এভাবেই ‘বন্দোবস্ত’ কথাটা খাতা-কলমে ছিল, খুব একটা বেশি উচ্চারিত হতো না। চব্বিশের গণ-আন্দোলনে বন্দোবস্ত কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে লাগল—পুরোনো বন্দোবস্তের অনেক কিছুই খারাপ, বিশেষ করে সেই বন্দোবস্তে মেধার কোনো যোগ্যতা নেই, সেই বন্দোবস্ত হলো কোটা প্রথা। এই কোটা প্রথার কারণে বিশেষ একশ্রেণির গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের এই শ্রমঘন সমাজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেও সরকারি ভালো কোনো পদে তুলনামূলক যোগ্য ব্যক্তিরা সুযোগ পান না। অপরপক্ষে দেখা যায়, কোনো নির্দিষ্ট এলাকার কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষ কম মেধাসম্পন্ন হওয়ার পরেও সরকারি বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। মূলত এটাই ছিল পুরোনো বন্দোবস্তের ক্ষতিকারক দিক। এই ক্ষতিকারক দিকটি যুবসমাজ ভালোভাবেই সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সময় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ছাড়া প্রায় সবাই পুরোনো এই বন্দোবস্তকে লাল কার্ড দেখিয়েছিল। আন্দোলনকারীরা সবার মনে এই কথা বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে পুরোনো বন্দোবস্তে সরকারি দলের লোকেরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন দানা বেঁদে উঠল। পুরোনো বন্দোবস্ত শেষ হলো। পুরোনো বন্দোবস্তে যারা ব্যবস্থাপনায় ছিল, সেই সরকার বিদায় নিল অপমানজনকভাবে।

সাধারণ মানুষ মনে করেছিল পুরোনো বন্দোবস্তের কবর হয়েছে। নতুন বন্দোবস্ত হবে এমনভাবে, যেখানে মেধার প্রাধান্য থাকবে, যোগ্যতম লোক উপযুক্ত জায়গায় যাবে, একেবারে গণতান্ত্রিক উপায়ে সবকিছু পরিচালিত হবে, আপামর জনগোষ্ঠী তাদের কাজের ন্যায্যতা পাবে, সর্বক্ষেত্রেই একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজ করবে। এক বছর পরে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে—পুরোনো বন্দোবস্তের চেয়ে বর্তমানের বন্দোবস্ত অর্থাৎ নতুন বন্দোবস্ত ভালো না খারাপ? যদি আমরা সাদা চোখে দেখি, খুব একটা পরিবর্তন যে হয়েছে, সে কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না।

আরেকটি কথা গত এক বছরে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। সেটা হলো ‘বয়ান’। এই বয়ান শব্দটা চব্বিশের আন্দোলনের আগে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে শুনতে পেতাম—এখন বয়ান করবেন অমুক হজরত মাওলানা সাহেব। আর বিভিন্ন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হতো—অমুক হাদিসে অমুক জায়গায় অমুক গ্রন্থে এই বয়ান আছে, তারপর সেসব বয়ান উদ্ধৃতি করা হতো। অন্য কোনো ক্ষেত্রে বয়ান শব্দটি খুব একটা উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

চব্বিশের আন্দোলনের পর থেকেই বয়ান কথাটা বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে—পুরোনো বয়ান বাদ, পুরোনো বয়ান চলবে না। এই পুরোনো বয়ানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা—একাত্তরের কথা একতরফাভাবে একক গোষ্ঠী দ্বারা প্রচারিত হতো। গণতন্ত্র ছিল কথায়, কাজে থাকুক বা না থাকুক। যুবসমাজের এই পুরোনো বয়ান ভালো লাগেনি। তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল নতুন বয়ান হবে গণতন্ত্রের সমান অধিকারের, বাক্‌স্বাধীনতার। নতুন বয়ান হবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয় মূল্যবোধ ও বিদেশি প্রভুদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ গড়ার অঙ্গীকারের বয়ান। নতুন বয়ানে অবশ্যই শোনা গিয়েছিল, আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আমাদের সবকিছুতে নাক গলায়। আরও উচ্চারিত হচ্ছিল স্বদেশের স্বকীয়তার কথা, স্বাবলম্বিতার কথা। এখন এই বয়ানের সঙ্গে আগের বয়ান মিলিয়ে যদি দেখি, তাহলে পার্থক্য চোখে বাধার কথা। চব্বিশের আন্দোলনে তরুণ ছাত্রছাত্রী ও দেশের সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়েছিল নতুন বয়ান শুনতে, পুরোনো বয়ান আর ভালো লাগে না সেই ভেবে। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করার সময় এসেছে। অবশ্যই পুরোনো বয়ানের যেসব ভুলত্রুটি আছে, সেগুলো শুদ্ধ করে নতুন সাচ্চা ও খাঁটি বয়ান করতে হবে।

তারপর যে কথাটি সবার মনে বিশেষ দাগ কেটেছিল, সেটা হলো ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’। এই বৈষম্যবিরোধীদের পক্ষে এ দেশের সব শ্রেণির মানুষেরই সম্মতি ছিল। তরুণসমাজকে সবাই বিশ্বাস করেছিল। ভেবেছিল আমরা সবাই মিলে বৈষম্য দূর করতে পারব। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছিল বৈষম্যবিরোধী সমাজ। সেখানেও ব্যাখ্যা ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার। পরবর্তীকালে সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল সামাজিক ন্যায়বিচার। এ কথাটির মধ্যেও একটু বৈষম্যবিরোধী স্পর্শ আছে। অর্থাৎ এ দেশের আপামর সাধারণ মানুষ সব সময়ই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল আছে এবং থাকবে।

তবে ছাত্ররা যে বৈষম্যবিরোধী কথা বলেছিল, সেটা ছিল শুধু চাকরির কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। এই কথাটা পরিষ্কারভাবে তখন বলা হয়নি। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষেরা মনে করেছিল সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাস্তবে বৈষম্য দূরীকরণের তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। শুধু সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে যে কোটা পদ্ধতি ছিল, সেটার অবসান কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়েছে বা হবে বলে আশ্বাস পাওয়া গেছে।

শ্রমবাজারে বৈষম্য রয়ে গেছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট। কোনো কোনো পক্ষ কর্মক্ষেত্রে ও সমাজে নারীর সমান অধিকারকে মানতে কুণ্ঠাবোধ করছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে এটা ঘটছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাহলে বৈষম্য দূর হলো কোথায়?

বন্দোবস্ত, বয়ান ও বৈষম্য বিরোধ—এগুলো আসলে মুখে মুখে, কাগজে-কলমে রয়ে গেল, বাস্তবতা পেল না। যেহেতু এই আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল ছাত্রদের তরফ থেকে, কথাগুলো প্রথমে তারাই উচ্চারণ করেছিল, তাই সমাজসচেতন মানুষেরা ধরে নিয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রেও নতুন বন্দোবস্ত চালু হবে, আন্দোলন শেষে নেতৃত্বের মাঝ থেকে সব শিক্ষার্থীকে আহ্বান জানানো হবে—পুরোনো বন্দোবস্তের দিন শেষ, তোমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাও, যথাযথ মানসম্মত শিক্ষার ওপর মন দাও, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক মানের বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ কর, যেন পৃথিবীর যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায়, সেই রকম বন্দোবস্ত আরম্ভ করো।

সবার প্রত্যাশা ছিল পুরোনো বয়ান আর হবে না, যে বয়ান শিক্ষাকে পেছনের দিকে নিয়ে যায়, বাস্তবমুখী শিক্ষা দেয় না। বয়ান হবে বাস্তবমুখী, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। হলের সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে, গ্রাম ও শহরের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের কারণে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই বৈষম্য দূর করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হবে—এটাই সবাই আশা করেছিল। কোনো কোনো শিক্ষা একেবারেই নিম্নমানের—বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই, সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে, মানুষকে কর্মমুখী করে না—সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলেও মানুষ মনে করত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে।

সরকারি অফিসগুলোতে আগে যেভাবে ঘুষ-দুর্নীতি হতো—ভূমি অফিস হোক কিংবা কাস্টমস, ইনকাম ট্যাক্স, সিটি করপোরেশন, ঠিকাদারি ব্যবসা—কোনো ক্ষেত্রেই কমেনি বরং বেড়েছে। তাহলে পূর্বের বয়ান ও বন্দোবস্তের সঙ্গে বর্তমানের বয়ান ও বন্দোবস্তের পার্থক্যটা কোথায়?

সবকিছু যেন একই তিমিরে, একই অবস্থায় রয়ে গেল। যা পুরোনো ছিল, তা-ই নতুন করে চলতে লাগল। মাঝখান থেকে হাজারখানেক মানুষের অকাল বিদায় হলো, নিষ্পাপ প্রাণগুলো ঝরে গেল আমাদের সামনে।

তবু মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। আশা করছি, অদূর ভবিষ্যতে পুরোনোর পরিবর্তে নতুন বন্দোবস্তের বৈষম্যহীন নির্বাচন হবে, যেখানে সব মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক একটি সরকারকে ক্ষমতাধর মসনদে বসাবে। সেই সরকার বৈষম্য দূর করে সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করবে—সেই আশায় বুক বেঁধে থাকলাম।

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘বিচারপতি খায়রুলকে হাতকড়া পরানো মানে পুরো বিচার বিভাগকে হাতকড়া পরানো’

কোথাও ঘুরতে ইচ্ছা করলে আমাকে জানাবে—ছাত্রীকে খুবি অধ্যাপক

মোবাইলে সর্বত্র ইন্টারনেট সংযোগ দেবে স্টারলিংকের ডাইরেক্ট-টু-সেল

আগামী সপ্তাহের মধ্যে ৫ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু: গভর্নর

মৌচাকে হাসপাতালের পার্কিংয়ে প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার দুই মরদেহের পরিচয় মিলেছে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত