Ajker Patrika

হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা...

রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০–১৫ অক্টোবর ২০২৫)
রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০–১৫ অক্টোবর ২০২৫)

হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা,

আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে। জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।

যারা এখনও আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি, আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম তিন গোয়েন্দা।

আমি বাঙালি। থাকি চাচা-চাচীর কাছে।

দুই বন্ধুর একজনের নাম মুসা আমান—ব্যায়ামবীর, আমেরিকান নিগ্রো। অন্যজন আইরিশ আমেরিকান, রবিন মিলফোর্ড—বইয়ের পোকা।

একই ক্লাসে পড়ি আমরা।

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহা-লক্কড়ের জঞ্জালের নিচে পুরানো এক মোবাইল হোম-এ আমাদের হেডকোয়ার্টার।

নতুন আরেকটা রহস্যের সমাধান করতে চলেছি।

এসো না, চলে এসো আমাদের দলে।

আজও যারা এই তিন গোয়েন্দার পরিচয় জানে না, তাদের জন্য বলছি, ওপরের কথাগুলো আসলে কিশোর পাশার নয়, রকিব হাসানের। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা তিনি। কিশোর, মুসা আর রবিন চরিত্র দিয়ে যিনি অসংখ্য রহস্যের সমাধান করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন সত্যিকারের কিশোর-কিশোরীদের, যারা একটা সময় তিন গোয়েন্দায় মজে থাকতাম দিনরাত। ভাষার মাধুর্য, জানার প্রবল আগ্রহ, প্রশ্ন করার সাহস ও উত্তর খোঁজার তাড়া তো তিনিই শিখিয়েছেন। কত যে কিশোর মন লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বিচ থেকে ঘুরে এসেছে, তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কেউ ভাগ্যবান, সত্যিই ঘুরতে গিয়েছেন রকি বিচে। কল্পনার জগৎকে রোমাঞ্চে ভরিয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা। এসব তো সম্ভব হয়েছে রকিব হাসানের কারণেই। তা কি অস্বীকার করা যায়?

রকিব হাসান পৃথিবীর সব মোহমায়া ত্যাগ করেছেন ১৫ অক্টোবর। কিন্তু তাঁর উপস্থিতি পাঠক হৃদয়ে প্রাণোচ্ছল থাকবে আজীবন। এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা, সেই ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি কিশোর, মুসা, রবিনের জনপ্রিয়তা জিইয়ে রেখেছেন স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে। শুধু তা-ই না, আমরা যখন স্কুলের বইয়ের ভেতর লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়তাম, তখন ধরা পড়ে গেলে অভিভাবকেরা বই কেড়ে নিতেন, আর নিজেরাই এর পাঠক-ভক্ত হয়ে যেতেন।

রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজ আর এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’-এর ছায়া অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার বেশ কিছু গল্প লিখেছেন রকিব হাসান। কিন্তু তাতে সিরিজটির জৌলুশ একটুও কমেনি। পাঠক এতটাই তিন গোয়েন্দার নেশায় বিভোর হয়ে যায়! বিষয়টা তিন বেলা ক্ষুধা লাগার মতো, যাঁরা এই সিরিজের পাঠক-ভক্ত তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন।

১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মেছিলেন তিন গোয়েন্দার জনক। সনদে তাঁর নাম কিন্তু আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব। বাবা ডাকতেন হাসান নামে। আর পাঠকের কাছে তিনি রকিব হাসান। সত্তরের দশকে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনুবাদ দিয়ে শুরু করেন লেখালেখি। প্রথমে ছদ্মনামে লিখতেন। ১৯৭৭ সালে ‘ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা’ অনুবাদ করে স্বনামে প্রকাশ করেন প্রথম বই। ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ কিংবা ‘টারজান’-এর অনুবাদ—বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বইয়ে নিজের সেরাটাই ঢেলে দিয়েছেন তিনি। কিশোরদের জন্য কিছু ভৌতিক গল্প ও সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন মন খুলে। তবে তাঁর সব লেখাকেই ছাপিয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।

আর এই তিন গোয়েন্দা যে আমাদের কিশোর বয়সে কেমন প্রভাব ফেলেছিল, তার ছোট একটা উদাহরণ বলি। এলাকায় আমরা তিন বন্ধু ছিলাম, অভিন্ন স্কুল এবং ভিন্ন ক্লাসেই পড়তাম। তিনজনই বুঁদ হয়ে পড়তাম তিন গোয়েন্দা। এই সুবাদে তিনজনের বন্ধুত্ব বেশ পাকাপোক্ত হয়। একবার আমরা ঠিক করলাম কিশোর-মুসা-রবিনের মতো একটা গোয়েন্দা সংস্থা খোলার। শিমলা আপু বইয়ের পোকা হওয়ায় তাঁকে আমরা রবিন মিলফোর্ড নাম দিলাম। খুশির চুল কোঁকড়া বলে সে হলো কিশোর পাশা। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমি হয়ে গেলাম মুসা আমান। অবশ্যই সবাই তিন গোয়েন্দার লেডি ভার্সন! শিমলা আপুর খালাতো বোন কলি আপু বেজায় সুন্দরী হওয়ায় তিনি হলেন জর্জিনা পার্কার ওরফে জিনা। দুষ্টু কাকে যেন শুঁটকি টেরি নামও দিয়েছিলাম, মনে নেই।

খুশিদের বাড়ি টিনশেড ভবন। পেয়ারাগাছ বেয়ে টিনের চালে উঠে গাছের ডাল-পাতার আড়ালে বসে যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম আমরা। সেটাই ছিল আমাদের হেডকোয়ার্টার্স। সেখান থেকে এলাকার দৃশ্য মোটামুটি দেখা যেত এবং আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম কোনো মন্দ কাজ হচ্ছে কি না, তা বের করার। কিন্তু কখনোই কোনো রহস্য পেলাম না ভেদ করার জন্য। বরং কার সঙ্গে কার প্রেম চলে, তারা ইশারায় কীভাবে কথা বলে, এসব দৃশ্যের সাক্ষী হতে থাকলাম! স্কুল শেষ করার পর আমাদের সেই আড্ডা আর হতো না। বড় হয়ে আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ার বেছে নিলাম। কিন্তু কেউ গোয়েন্দা হতে পারিনি। তাতে কী! রকিব হাসান তিন গোয়েন্দার মাধ্যমে আমাদের ভেতর প্রশ্ন করা ও উত্তর খোঁজার ইচ্ছা আর ভাষাশৈলীর যে ব্যবহার শিখিয়ে গেছেন, তা হয়তো আমরাও বুঝতে পারিনি। আর রকিব হাসান তো জানতেই পারলেন না—হয়তো আমাদের মতো আরও অনেক পাঠক নিজেদের কিশোর, মুসা, রবিন কিংবা জিনা ভেবে নিয়েছেন।

রকিব হাসান কি একেবারেই চলে গেছেন? বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ওপারে কী হচ্ছে—সেই রহস্য ভেদ করতে গেছেন তিনি। কিশোর মনে যে ব্যক্তি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে গেছেন, তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আদালত চত্বরে জোড়া খুন ও রাষ্ট্রের দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা

আইনের শাসন দুর্বল হলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়, আর মানুষ আইন হাতে তুলে নিতেও আগ্রহী হয়; ফলে সমাজে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে ক্ষতিকর, কারণ ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

চিররঞ্জন সরকার
খুলনায় আদালত চত্বরের প্রধান ফটকের সামনে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
খুলনায় আদালত চত্বরের প্রধান ফটকের সামনে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

না, দেশের কোথাও কোনো সুসংবাদ মিলছে না। কেবলই অস্থিরতা, সংঘাত ও রক্তপাত। গত রোববার প্রকাশ্য দিবালোকে খুলনায় আদালত চত্বরের প্রধান ফটকের সামনে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে। সন্ত্রাসীরা শত শত মানুষের সামনে এই বেপরোয়া খুনের ঘটনা ঘটায়। সেখানে পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং এটি অপরাধী চক্রের বেপরোয়া শক্তি ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার স্পষ্ট ইঙ্গিত। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দলীয় প্রভাব, স্বার্থের সংঘাত এবং রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে অনেক সময়ই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভব হয় না, এটি দেশের দীর্ঘদিনের বাস্তবতা। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা দলীয় প্রভাব নেই; তাদের থাকার কথা নিরপেক্ষ অবস্থানে। তবু কেন তারা অপরাধ দমনে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারছে না? এটি কি প্রশাসনিক অদক্ষতা, নাকি সদিচ্ছার ঘাটতি? আর যদি তারা অপরাধীদের ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নির্বাচনমুখী উত্তপ্ত পরিস্থিতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, এই প্রশ্ন এখন সামনে উঠে এসেছে।

এর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালত চত্বরে অপরাধী ছিনতাই, পুলিশি ব্যারিকেড উপেক্ষা করে আদালতে হাজিরা দিতে আসা অভিযুক্তকে মারধর, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অপরাধীরা এখন আর বিচারব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না। তাদের আচরণ দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, কারণ তারা জানে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের ভয়ের কিছু নেই। যে ভীতি অপরাধীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়ার কথা, তা এখন নিরীহ নাগরিকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ আদালতের মতো নিরাপদ বিবেচিত স্থানেও নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। প্রশ্ন জাগে, যেখানে নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার কথা, সেখানে যদি মানুষ আতঙ্কে গুটিয়ে থাকে, তবে এটিই কি সেই সুশাসনের চিত্র, যা আমাদের উপহার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল?

মানুষের জীবন রক্ষা রাষ্ট্রের সবচেয়ে মৌলিক দায়িত্ব। রাষ্ট্র, আইন, আদালত, সরকার—সবকিছুর অস্তিত্বই মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। যদি একটি সরকার নাগরিকের প্রাণ সুরক্ষার ন্যূনতম দায়িত্বও পালন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই সরকার কতটা কার্যকর, তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১৫ মাসের শাসনামলের চিত্র মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনোই স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরতে পারেনি; বরং খুনোখুনির ঘটনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সহিংসতা যেন সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১১ জন মানুষের খুন হওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। এটি কি সত্যিই সেই ‘নতুন বাংলাদেশ’, যার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল? নাকি আমরা আরও গভীর নিরাপত্তাহীনতার এক অন্ধকার বাস্তবতায় ঢুকে পড়ছি?

সরকারের ঘোষণা মতে, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সামনে রেখে দেশজুড়ে রাজনৈতিক তৎপরতা, সমাবেশ, জনসংযোগ ও ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্গঠনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই তীব্র হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এলাকায় প্রভাব বিস্তার, মাঠ দখল ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। এই বাড়তি উত্তাপের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও দুর্বল হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ঠিক এই সময়েই খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি অপরাধ নয়, বরং দেশের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য একটি বড় সতর্কসংকেত।

নিহত দুজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ছিল, যা থেকে ধারণা করা যায় যে তাঁরা নিজেরাও স্থানীয় অপরাধী নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে কারণে হত্যাকাণ্ডটি প্রতিশোধমূলক নাকি আধিপত্যের লড়াইয়ের অংশ—এমন প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু এসব বিশ্লেষণের মধ্যেও সবচেয়ে গুরুতর যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, আদালত চত্বরের মতো জায়গায় কী করে এমন পরিকল্পিত হামলা নির্বিঘ্নে ঘটানো সম্ভব হলো? আদালত এলাকা সাধারণত সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আওতায় থাকে, সিসিটিভি ক্যামেরা, পুলিশি টহল, কঠোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন স্তরের নজরদারি সেখানে নিয়মিত থাকার কথা। বাস্তবে দেখা গেল, দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এসে খুব কম সময়ের মধ্যে গুলি চালিয়ে সেখান থেকে কোনো বাধা ছাড়াই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এটি নিছক নিরাপত্তা-দুর্বলতা, নাকি অপরাধীদের শক্তি এমনভাবে বেড়ে গেছে যে তারা এখন আর আইন বা বিচারব্যবস্থাকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না, এই প্রশ্ন এখন সমাজে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়লে নানা ধরনের গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ, প্রতিশোধমূলক হামলা, চাঁদাবাজি বা এলাকা দখল—এসবের সাধারণত উত্থান দেখা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং স্থানীয় বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। অপরাধী চক্রের অনেকেই তখন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আরও বেপরোয়া হয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক দলগুলো মাঠের পরিস্থিতি নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য কখনো কখনো স্থানীয় শক্তিমান গোষ্ঠীর সহযোগিতা নেয়, ফলে অপরাধীরা শক্তির প্রদর্শন করতে উৎসাহিত হয়। খুলনার এই হত্যাকাণ্ড সেই বাস্তবতারই এক ভয়ানক উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

এই হত্যাকাণ্ড বিচারব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থাকেও গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। আদালত এমন একটি স্থান, যেখানে মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় আসে। নিরাপত্তার জন্য আসে। সেখানে যদি দুর্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে খুন করতে পারে, তবে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা সম্পর্কে কী ভাববে?

এমনিতেই আমাদের বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ। অনেক আসামি বছরের পর বছর জামিনে থেকে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, আবার অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গ্রেপ্তার হলেও শিগগিরই মুক্ত হয়ে যায়। এই বিপরীতমুখী চিত্রের কারণে অপরাধীরা আইনের শাসনকে দুর্বল মনে করে এবং প্রতিপক্ষকে দমন করতে বা আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। এই অবৈধ অস্ত্রের প্রবাহ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সীমান্তপথে অস্ত্র আসা, গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্র এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক ইত্যাদি কারণে খুন-সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেছে। খুলনার আদালত চত্বরে হামলাকারীরা যেভাবে নির্ভয়ে গুলি চালিয়েছে, তা এই অবৈধ অস্ত্র প্রবাহের বিপজ্জনক বাস্তবতাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।

নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন গোষ্ঠী, অপরাধী নেটওয়ার্ক ও রাজনৈতিক কর্মীদের কার্যক্রম নিবিড় পর্যবেক্ষণে না রাখলে সংঘর্ষ, হামলা বা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়হীনতা থাকলে অপরাধীরাই সুযোগ নেয়। দুর্বৃত্তরা কখন কোথায় হামলা করবে, তা অনুমান করা কঠিন। তাই গোয়েন্দা নজরদারি কেবল বাড়ানোই নয়, তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করাও জরুরি। এর পাশাপাশি আদালতসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থায় উচ্চমানের প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে এ ধরনের আক্রমণ ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা যায়।

এমন একটি হত্যাকাণ্ডের প্রভাব শুধু নিরাপত্তা বা রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সামাজিক প্রতিক্রিয়াও গভীর। সাধারণ মানুষ যখন দেখে বিচারব্যবস্থার আঙিনা পর্যন্ত সুরক্ষিত নয়, তখন তারা আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। আইনের শাসন দুর্বল হলে অপরাধীরা আরও সাহসী হয়, আর মানুষ আইন হাতে তুলে নিতেও আগ্রহী

হয়; ফলে সমাজে নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে ক্ষতিকর, কারণ ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু নিরাপত্তা পরিস্থিতি যদি অস্থিতিশীল হয়, তাহলে ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাবে, নির্বাচনের পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এখন সবচেয়ে জরুরি হলো, এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা। মামলার অগ্রগতি চোখে দেখা না গেলে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হবে এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি থাকবে। অপরাধ রোধে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। নির্বাচনের আগে উত্তেজনা না বাড়িয়ে সহিংসতা থেকে দূরে থাকা, দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার না করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়াই হতে পারে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত।

এখন প্রয়োজন সতর্কতা, দ্রুত পদক্ষেপ এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ।

নইলে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে গভীরভাবে ব্যাহত করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নিষ্ক্রিয় গবেষণাকেন্দ্র: অপচয় নাকি নীতিগত ব্যর্থতা

বাংলাদেশ যদি গবেষণার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব না দেয়, তবে আমাদের তরুণেরা এবং মেধাবী গবেষকেরা বিদেশমুখী হবে, মেধা পাচার বাড়বে, এবং দেশ প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে, যা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে কেউ কেউ মনে করে।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি একটি জাতির টেকসই উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে, বিশেষত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণার ক্ষেত্রটি নানাভাবে অবহেলিত। যেমন সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬টি গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি কেন্দ্র সক্রিয়। বাকি কেন্দ্রগুলো কেবল নামমাত্র কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যেমন অর্থ অপচয় হচ্ছে, তেমনি দেশের তরুণ মেধাবীদের গবেষণার আগ্রহও কমিয়ে দিচ্ছে।

মাইক্রোচিপ বা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে বলা হচ্ছে একুশ শতকের নতুন তেল। বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের চিপ বা ডিভাইস রপ্তানির লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। কিন্তু দক্ষ প্রকৌশলী ও গবেষক ছাড়া এই লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টারটি যদি পর্যাপ্ত অর্থায়ন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মানবসম্পদ সহায়তা পেত, তবে দেশীয় গবেষণা ইতিমধ্যে বহুদূর এগিয়ে যেত। আজও সেখানে গবেষণার জন্য শিক্ষার্থীদের এক মাস আগে থেকে নাম লেখাতে হয়, কারণ সুযোগ-সুবিধা সীমিত। ফলে প্রতি ব্যাচের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যায়, যা আমাদের জন্য ভালো খবর নয়। কারণ, আমরা মেধাবীদের ধরে রাখতে পারছি না।

বাজেট বরাদ্দের অবস্থা আরও হতাশাজনক। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেট ১ হাজার ৩৫ কোটি টাকা হলেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ মাত্র ২.৮ শতাংশ। এই অর্থে উচ্চমানের গবেষণা চালানো কার্যত অসম্ভব। অন্যদিকে যেসব কেন্দ্র বছরের পর বছর ধরে নিষ্ক্রিয়, তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া অর্থের অপচয় হচ্ছে। গবেষণার প্রকৃত উন্নতির জন্য এসব কেন্দ্রকে বন্ধ বা একীভূত করা দরকার।

উচ্চশিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং গবেষণার মাধ্যমে জাতির উন্নয়নে অবদান রাখা। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাম্প্রতিক গবেষণা ব্যয়ের চিত্র বিশ্লেষণ করলে উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, কার্যক্রম চালু থাকা ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টি গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। এ তথ্য শুধু হতাশাজনক নয়, বরং প্রশ্ন, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদৌ উচ্চশিক্ষার মানদণ্ড পূরণ করছে কি না।

অবশ্য ইতিবাচক দিকও আছে। ইউজিসির তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় সর্বাধিক ব্যয় করে শীর্ষে রয়েছে, তাদের বার্ষিক ব্যয় ৬ কোটি টাকার বেশি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং এআইইউবিও উল্লেখযোগ্য ব্যয় করেছে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মানসম্মত গবেষণা করতে পারে।

কিন্তু যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় নামমাত্র অর্থ ব্যয় করছে, কিংবা একেবারেই ব্যয় করছে না, তারা আসলে শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যায় করছে। গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয় কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দিতে পারে না। আইন অনুযায়ী, প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণায় ব্যয় করার কথা। এই বাধ্যবাধকতা অমান্য করলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয় এবং দেশও বঞ্চিত হয় মানসম্মত জ্ঞান উৎপাদন থেকে।

তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।

এখন সময় এসেছে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান নেওয়ার। প্রস্তাব

করা যায়—

ক) যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে গবেষণা ব্যয় করছে না, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হোক।

খ) নির্দিষ্ট গবেষণা বাজেট না রাখলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি অনুমোদন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।

গ) গবেষণা ব্যয়ের ওপর নজরদারি ও ফলাফলের মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা উচিত।

ঘ) গবেষণার জন্য শিল্প খাত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দিতে পারে ইউজিসি। প্রয়োজনে আরও কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে তাদের অনুমোদন কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করা যেতে পারে।

গবেষণা খাতে বিনিয়োগ ব্যয় নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সঞ্চয়। আবারও অনেকেই বলে থাকে এটা বড় ধরনের সম্পদ হিসেবে কাজ করে। যে দেশ যত বেশি গবেষণায় বিনিয়োগ করবে, সেই দেশ তত বেশি উন্নয়ন করবে। আর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। যদি এখনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনা না হয়, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতক উৎপাদন করবে, কিন্তু জ্ঞান উৎপাদন করতে পারবে না। তখন তারা ডিগ্রি প্রদানকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যা দেশের জন্য এক বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শুধু অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, দরকার কার্যকর নীতিগত কাঠামো। একটি গবেষণাকেন্দ্রকে সক্রিয় করতে প্রয়োজন—

১. পূর্ণকালীন ও দক্ষ পরিচালক, পর্যাপ্ত অবকাঠামো

২. আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল

৩. আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা

৪. গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ডেটা, সফটওয়্যার ও প্রযুক্তিসুবিধা।

এ ছাড়া গবেষণার ফলাফলকে শিল্প ও নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করার একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে। উন্নত দেশগুলো এই কারণেই এগিয়ে। তারা গবেষণাকে নীতিনির্ধারণ ও শিল্পোন্নয়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। গবেষণা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষককে সমৃদ্ধ করে না, এটি গোটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। গবেষণা দেশকে নিয়ে যায় উন্নয়নের উচ্চ স্তরে। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের মতো যুগান্তকারী আবিষ্কার আজও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পথ দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি গবেষণার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব না দেয়, তবে আমাদের তরুণেরা এবং মেধাবী গবেষকেরা বিদেশমুখী হবে, মেধা পাচার বাড়বে, এবং দেশ প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে, যা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে কেউ কেউ মনে করে।

এখনই সময় একটি জাতীয় গবেষণা নীতি প্রণয়নের। নিষ্ক্রিয় কেন্দ্রগুলো একীভূত করে কার্যকর কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শিল্প খাতের অংশগ্রহণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গবেষণা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কার্যকর কিছু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যা প্রকৃতপক্ষে মৌলিক গবেষণা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করবে এবং দেশকে নানাভাবে স্বনির্ভর করবে।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম,সহযোগী অধ্যাপক হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

উচ্চ রক্তচাপ

সম্পাদকীয়
উচ্চ রক্তচাপ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে’ শীর্ষক সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফল থেকে জানা যায়, দেশের মানুষের অসুস্থতায় ১০টি রোগের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। প্রতি ১ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৮.২৮ জন এই রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়া সন্তান জন্মদানে সিজার করার হার ৪৯ শতাংশ, যা একদিকে সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা খাতের বাণিজ্যিকীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাকে স্পষ্ট করছে।

উচ্চ রক্তচাপসহ অন্য গুরুতর রোগগুলো মানুষকে আক্রান্ত করে শুধু দেহগত ত্রুটির কারণে নয়। মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতার অভাব, জীবনযাপনের পদ্ধতি এবং খাদ্যাভ্যাসের কারণে রোগগুলো আক্রমণ করে। আবার রোগ হওয়ার পর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে টোটকা চিকিৎসা নেয় অনেকে। ফলে রোগের বিস্তার দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে যায়। কথায় আছে, রোগে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করা জরুরি।

রুটিন মেনে খাদ্যাভ্যাস করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ, দৈনন্দিন ব্যায়াম—এ সবই হলো সুস্থ থাকার জরুরি উপায়। দেশের অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ। এর বাইরে খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের কারণে খাদ্যে আর পুষ্টিগুণ থাকছে না। এ ছাড়া খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যাপক ব্যবহারের কারণেও নানা জটিল রোগ তৈরি করছে। এসব ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মানুষকে সচেতন করার কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে ক্রমেই অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। তাহলে কি আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা হেরে যাবে? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তাই জীবনযাপন পদ্ধতি মানার দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ—রোগীদের সে বিষয়ে সচেতন না করে শুধু গাদা গাদা ওষুধ লিখে দেন তাঁরা। তাই চিকিৎসকদের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা জরুরি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় হেলথ গাইডলাইন তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা করা সম্ভব হলে, মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ পাবে। আর সেটা কার্যকর করা সম্ভব হলে দেশের জনগণই উপকৃত হবে। কিন্তু রাষ্ট্রকে তার জনগণের প্রতি দায়বোধ থাকতে দেখা যায় না। যেহেতু চিকিৎসা জনগণের মৌলিক অধিকার, তাই এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ না থাকা কোনো ভালো লক্ষণ নয়।

উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমাতে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর মান ও সেবার পরিধি বাড়িয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে তারা ওষুধের দোকানের বদলে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্রে যায়।

বিবিএসের এই জরিপের তথ্যকে কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিটি নাগরিকের জন্য মানসম্মত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ নেওয়া উচিত সরকারকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তফসিল, নির্বাচন ও জনগণ

সম্পাদকীয়
তফসিল, নির্বাচন ও জনগণ

রাজনীতি কোন পথে যাত্রা করেছে, তা কি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে? যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির মাঠে সক্রিয়, তারা নির্বাচনের জন্য কতটা তৈরি হয়ে আছে, তা নিয়ে সংশয় এখনো কাটছে না। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। রমজানের আগেই নির্বাচন সুসম্পন্ন হবে বলে অনেকেই আশা প্রকাশ করছেন। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে নিজের পছন্দমতো ভোট দেবেন।

রাজনীতি নিয়ে দেশের জনগণ বেশ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। একই দিনে সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটের কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাধারণ মানুষকে দুই রকম ভোট একই সঙ্গে দেওয়ার বিষয়টি ঠিকঠাকভাবে বোঝানো যাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিগত সময়ে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তাই এবার যেন ভোটার নিজের ভোটটি ইচ্ছেমতো দিতে পারেন, সে রকম একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া প্রয়োজন। গণভোটের প্রসঙ্গ নিয়েও অনেক ধরনের তর্কবিতর্ক হচ্ছে। গণভোটে চারটি প্রশ্ন থাকায় কেউ যদি তিনটির পক্ষে থাকে এবং একটির বিপক্ষে থাকে, কিংবা দুটির পক্ষে থাকে এবং দুটির বিপক্ষে থাকে, তাহলে ভোটার ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ ভোট দেবেন, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই এ বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখবে।

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি বেড়ে গেছে। কোনো কোনো দলের কোনো কোনো নেতা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক প্রকাশভঙ্গি বলা যাবে না। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের নানা ধরনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ অবস্থায় ঠিক কাজটি করতে পারছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এলাকার রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেললে নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে।

দেশের সাধারণ জনগণ নিজের ইচ্ছায় নিরাপদে নিজের ভোটটি দিতে চাইছে। জনগণের মনে সত্যিকার সাহস জোগানোর কাজটি এখন খুবই জরুরি কাজে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে করা যাবে কি না, তা নির্ভর করছে এ সময়টিতে সেভাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া যাচ্ছে কি না, তার ওপর। প্রস্তুতিতে সমস্যা যেন না থাকে, তার দায়িত্ব নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।

নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগ, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা কেটে যাবে বলে মনে করে অভিজ্ঞ মহল। অনেক ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নীতি-অস্পষ্টতা এবং ব্যাংকিং বা মনিটারি সমস্যার কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। সেই আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা একান্ত জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য যেন পূর্ণ নিরাময়ের গ্যারান্টি পায়, তা নিশ্চিত করা দরকার। তবে এ কথাও ঠিক, রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে কিছুটা সুসংবাদ দেয়।

সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ দুর্নীতি করে না। তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পেলেই শান্তি পায়। নির্বাচনের মাধ্যমে সে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত