Ajker Patrika

বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রত্যাশা

বিধান রিবেরু
বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রত্যাশা

বাংলাদেশে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর নতুন ও পুরোনো মুখ, নয়া ও আদি বিতর্কিত চিন্তাভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছেন গণমাধ্যমে। এদের ভেতর অর্ধেকই তরুণ। এটা একটা লক্ষণীয় বিষয়। তরুণ চিন্তাবিদ হিসেবে গণমাধ্যমে হাজির হয়ে তাঁরা বক্তব্য রাখছেন। কোথাও কোথাও সৌজন্যবোধ হারাচ্ছেন, যুক্তিও ভালো করে করতে পারছেন না, তবু এই তারুণ্যের উত্থানকে আমি সাধুবাদ জানাই। বাকিরা পুরোনো পরিচিত বা অর্ধপরিচিত কিংবা অপরিচিত বয়স্ক মানুষ। তাঁরা তাঁদের পূর্বনির্ধারিত ছকেই কথা বলছেন। এখন প্রশ্ন হলো, এত এত নতুন মুখ যাঁদের আমরা টেলিভিশন টক শোতে দেখছি, পত্রিকার পাতায় যাঁদের কলাম পড়ছি, এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সরকারি অনুষ্ঠানেও যাঁদের বক্তৃতা শুনছি, তাঁরা কি সবাই বুদ্ধিজীবী? যদি তাঁরা বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা কী?

এই প্রশ্নের জবাবে ঢোকার আগে দেখে নিলে ভালো হয়, বুদ্ধিজীবী বর্গ নিয়ে যাঁর কথা সারা দুনিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে, ইতালির রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি, তিনি আসলে কী ভাবছেন বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। তাঁর মতে, বুদ্ধিজীবী পেশার মাধ্যমে নয়, আত্মপ্রকাশ করে কর্মতৎপরতায়। অর্থাৎ, কেউ যদি সামাজিক সচেতনতা বা সমাজের যেকোনো ধরনের বয়ান নির্মাণ, বিনির্মাণ অথবা নাকচ করে দেওয়ার কাজটি করেন, সে-ই বুদ্ধিজীবী। এমন কোনো কথা নেই যে সমাজে শুধু শিক্ষক, লেখক আর সাংবাদিকেরাই বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিগণিত হবে। বুদ্ধিজীবী আসতে পারেন শ্রমিকশ্রেণি অথবা কৃষকসমাজ থেকেও। কাজেই এই বিচারে গণমাধ্যমে বা গণপরিসরে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা কোনো না কোনো ভাবাদর্শকে প্রচার বা খণ্ডনের কাজ করছেন। অতএব তাঁরা সবাই বুদ্ধিজীবী। তাহলে তাঁদের কাছ থেকে আমরা কী চাই? তাঁদের কাছ থেকে আমরা ধনসম্পত্তি চাই না। বা চাই না তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক রাতের ভেতর ঠিক করে দেবেন। আমরা চাই, তাঁরা যেন সত্য গোপন না করেন। আমরা চাই, তাঁরা যেন ছলনার আশ্রয় নিয়ে অন্যায়কে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে না ফেলেন। আমরা চাই, তাঁরা যেন জ্ঞানপাপী না হন।

আবারও একটু গ্রামশিতে ফিরি। গ্রামশির ট্র্যাডিশনাল ও অর্গানিক বুদ্ধিজীবীর ধারণা শ্রেণিসচেতনতার সঙ্গে জড়িত, তিনি বলছেন: শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, ধর্মগুরুরা ট্র্যাডিশনাল বা প্রথাগত বুদ্ধিজীবী, তাঁদের আপাতদৃষ্টিতে শ্রেণি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে মনে হলেও, আখেরে তাঁরা শাসকদের স্বার্থকেই রক্ষা করেন। তারচেয়েও বড় কথা, তাঁরা নিজেদের সুখশান্তি নষ্ট করতে চান না। কিন্তু অপর দিকে অর্গানিক বা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী শাসক শ্রেণিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, পাল্টা বয়ান হাজির করতে চান। তাঁরা হতে পারেন সাংবাদিক, শ্রমিক বা কৃষকসমাজ থেকে উঠে আসা মানুষ, কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মী। আদতে যাঁরাই শ্রেণি প্রশ্নে শোষিত মানুষের পক্ষে থাকবেন, শাসককে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন, তাঁরাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীদের ভেতর এই শ্রেণীকরণকে বিবেচনায় রেখে বর্তমান বাংলাদেশে শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সবকিছু আমলে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

আমি দেখেছি বাংলাদেশে একদল বুদ্ধিজীবী সটান দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁরা ঋজু বুদ্ধিজীবী। পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন, তাঁরা সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিপরীতে অবস্থান করেন। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে তাঁদের দ্বিধা নেই। তাঁরা কথার মারপ্যাঁচে নিজেদের অবস্থান আড়াল করেন না। আরেক দল বুদ্ধিজীবী হেলে থাকেন সব সময়—ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে—যখন যেদিকে হাওয়া বয়। তাঁরা যেন হাওয়ার বেগের সঙ্গে নিজেদের খুব সহজে সামলে নিতে পারেন। এরা হেলানো বুদ্ধিজীবী। সুবিধাবাদী ধরনের এসব বুদ্ধিজীবী যখন যে শাসক ক্ষমতায় আসেন, তাঁদেরই চাটুবৃত্তি করেন, কিন্তু সেটা বেশ কৌশলে। তাঁদের কৌশল চট করে বোঝা যায় না। তাঁরা এমনভাবে কথা বলেন যেন শাসকগোষ্ঠী চটে না যায়। তাঁরা একটা ভান নিয়ে থাকেন সমালোচকের, কিন্তু তলে তলে সুযোগ-সুবিধা আদায়ে তাঁরা তৎপর। তৃতীয় দলটি হলো শায়িত বুদ্ধিজীবী। এরা শাসকদের মতাদর্শের সঙ্গে শয়ন করেন এবং তাদের মতামত ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বয়ান, সেটি যত মিথ্যাই হোক, প্রচার করে যান। প্রয়োজনে তাঁরা বারবার মিথ্যা বলে মিথ্যাটাকে সত্যের মতো রূপ দিয়ে দেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা তাঁদের অপরিসীম। এরা কিছুটা নির্লজ্জও বটে।

মজার বিষয়, উল্লিখিত তিন ধরনের বুদ্ধিজীবী সারা জীবন যে স্বীয় অবস্থানেই স্থির থাকেন, তা কিন্তু নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী শয়নাবস্থা থেকে দণ্ডায়মান হন বটে। তখন তিনি সাধারণ ও নিরপেক্ষ মানুষের বাহবা পান। হেলে পড়াদের মতিগতি ধরা খুব মুশকিল। তাঁরা খুব ধূর্ত। তাঁরা ধর্মেও আছেন, জিরাফেও আছেন। মনে হবে তাঁরা জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে গণমানুষের কথা বলছেন। আবার তাঁদের কথা সরাসরি শাসকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ করেও হয় না, বা শাসকদের জন্য অস্বস্তি উৎপাদন করে না।

এখন শাসকগোষ্ঠী সব সময় তার বলয়, প্রচারমাধ্যম ও কৌশল দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বয়ান হাজির করতে থাকে। সটান দাঁড়ানো প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব সেই বয়ানের বিপরীতে গিয়ে যুক্তি-প্রমাণসহ সম্যক আলোচনা করা এবং জাতির জন্য দিকনির্দেশনামূলক বয়ান হাজির করা। শাসকদের ভাষাবলয় বা হেজিমনির বিপরীতে এসব বুদ্ধিজীবী এক প্রতি-ভাষাবলয় সৃষ্টি করেন এবং সাধারণ মানুষের মগজে চিন্তার খোরাক জোগান। এদেরকেই গ্রামশি বলছেন অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল। গ্রামশি কথিত দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীর বাইরে আমি একটি আলো-আঁধারি মেশানো হেলানো বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করেছি। মুশকিল হলো, বাংলাদেশে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা বেশি প্রভাবশালী। এসব সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা না গ্রামশির ট্র্যাডিনশাল ইন্টেলেকচুয়াল, না কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বর্ণিত আইডিওলজিস্ট বা আদর্শবাদী। এদের কোনো আদর্শ নেই। এরা আদর্শ-উত্তর যুগের কৌশলী বুদ্ধিজীবী।

এদের কাছ থেকে জাতি কিছু প্রত্যাশা করলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতির শঙ্কাই বেশি। তাঁরা বিভ্রান্তি ছড়াতে ওস্তাদ, পাশাপাশি আখের গোছাতেও তুলনাহীন। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, কোন আমলে কোন জিনিস আমলে নিয়ে আম ও ছালা সামলাতে হয়। এটা কি আসলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর কাজ? গ্রামশির মতো জাঁ পল সার্ত্রেও মনে করেন বুদ্ধিজীবী নিজেদের সব সক্ষমতা দিয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। শাসকদের অন্যায় রাষ্ট্র করবেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা ক্রমাগত ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন। বাংলাদেশের হেলানো বুদ্ধিজীবীদের মতো তাঁরা ছল করে শাসকগোষ্ঠীর ভুল ও অন্যায়কে বৈধতা দেবেন না।

আমরা চাই, ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে যে-ই থাকুক, যারাই থাকুক, তারা যেন জবাবদিহির ভেতর থাকে এবং এই জবাবদিহির ভেতর থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাপ আসা উচিত প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে। এই বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সাংস্কৃতিক পুঁজির শক্তি খাটিয়ে শাসকদের বলতে বাধ্য করবেন, দেশে যা হচ্ছে তা আগ্রাসী ভিড়তন্ত্র, এটি কোনোভাবেই চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নয়, গ্রহের সংঘর্ষ থেকে সৃষ্ট ধূমকেতুও নয়। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা শাসকদের বলতে বাধ্য করবেন, দেশে একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাঁরা বলতে বাধ্য করাবেন, বহির্দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। তাঁরা আরও বলতে বাধ্য করাবেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক সরকার অনুপস্থিত থাকলে, সেটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থারই নামান্তর হয় মাত্র।

এটা ঠিক, শিরদাঁড়া সোজা করে, ঋজু ভঙ্গিতে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর মতো বয়ান হাজির করা এ দেশে কঠিন কাজ। কিন্তু বুদ্ধিজীবীকে সেই কঠিন ও বন্ধুর পথেই হাঁটতে হয়। কারণ, বুদ্ধিজীবী কেবল চিন্তার নৈরাজ্যে ভারসাম্যই আনেন না, তাঁরা জনগণের হয়ে, জনগণের জন্য চিন্তাটা করে দেন। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, দেশের কঠিন সময়ে কঠিন সত্যটি উচ্চারণ করে অন্যসব হেলানো ও শায়িত বুদ্ধিজীবীরা যে খর্বাকৃতির, সেটা প্রমাণ করে দেবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত