Ajker Patrika

পত্তনে চেনা সেই মুলোই দেখছি

আজাদুর রহমান চন্দন
শিক্ষার্থীদের দেয়াললিখন ও গ্রাফিতিতে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটেছিল। ফাইল ছবি
শিক্ষার্থীদের দেয়াললিখন ও গ্রাফিতিতে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটেছিল। ফাইল ছবি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন। তাতে প্রশংসার তুলনায় সমালোচনার দিকগুলোই বেশি সামনে এসেছে। সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব সন্ত্রাসের মতো ইস্যুগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতাসংক্রান্ত আলোচনায় অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে যে প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মব সন্ত্রাস, মামলা-বাণিজ্য, জামিন-বাণিজ্য, মৌলিক সংস্কার, এমনকি বিচারপ্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের সামনে তিনটি বড় দায়িত্ব ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই শুরু হয়েছিল ভাস্কর্যসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাঙার তাণ্ডব। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও চলতে থাকে ভাস্কর্য, মাজার ইত্যাদি ভাঙচুর এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ধারা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এক বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রায় দুই হাজার স্মারক, ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম ধ্বংস করা হয়েছে। মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক। নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং মিডিয়া হাউস দখল করা হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগে এক দলের অনুসারী লোকজনের বদলে অন্য দলের পক্ষের লোকজন বসানো ছাড়া কার্যকর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের মাথায় ‘শেষটা ভালো হলেই বাঁচোয়া’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে পাঠিয়েছিলাম পরপর দুটি সংবাদমাধ্যমে। লেখাটি ছাপতে তারা অপারগতা প্রকাশ করে। সেই লেখাই পরে ‘উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়’ শিরোনামে আরও বর্ধিত কলেবরে পোস্ট করি নিজের ব্লগ সাইটে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের মাথায় এসেও দেখা যাচ্ছে সেই পত্তনে চেনা মুলোই। এটি শুধু আমার একার পর্যবেক্ষণ নয়, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের অনেক বিশিষ্টজনেরও মূল্যায়ন এর কাছাকাছি।

বাম-প্রগতিশীল বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে গত বছরের ২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত যে ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল, তার অন্যতম নেতা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এক বছর পর এসে তিনি বলছেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে যেসব কাজ দরকারি ছিল, তার উল্টো যাত্রা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ‘দ্রোহযাত্রার’ বর্ষপূর্তির দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নারী, শ্রমিক ও ছাত্রসংগঠন আয়োজিত ‘শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার দ্রোহযাত্রা’য় সমাপনী বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, ইউনূস সরকারের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, একের পর এক সেই প্রত্যাশা ভঙ্গ করে এই সরকার এক বছর পার করেছে।’ এর কয়েক দিন আগে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক গোলটেবিল বৈঠকে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শামীম ওসমানের মতো মাফিয়া চলে গেলেও অনেক ছোট ছোট শামীম ওসমানের জন্ম হচ্ছে দেশে।’ তিনি আরও বলেন, মব সন্ত্রাস হচ্ছে, নারীর ওপর আক্রমণ হচ্ছে; সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেও যারা দুর্বল, তাদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরজবরদস্তি, মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নতুন নতুন মাফিয়াতন্ত্র তৈরি হচ্ছে সরকারের মধ্য থেকে একধরনের নিষ্ক্রিয়তা, নির্লিপ্ততা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে।

খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন—তিনটি ক্ষেত্রেই কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে সরকার একটি রূপরেখা দিয়েছে। তবে বিচার ও সংস্কার ইস্যুতে অগ্রগতির বেলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। গত এক বছরে বিচারব্যবস্থা প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।

কারণ হিসেবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঢালাও মামলার ব্যাপারে শুরু থেকেই তাঁদের উদ্বেগ রয়েছে। এটি কোনো দেশেই বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য সুষ্ঠু নয় বলে তাঁরা মনে করেন। তিনি আরও বলেন, কতটুকু বিচার, কতটুকু প্রতিশোধ—এই প্রশ্নটা ওঠা খুবই যৌক্তিক, যেভাবে চলছে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বলেছেন, দেখানোর জন্য যদি বিচার হয়, তখন অনেক ধরনের নতুন অন্যায়-অবিচার হয়ে যায়। যাঁরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, অবশ্যই তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে যে বিচার যেন সুষ্ঠু ও ন্যায় হয়। তা না হলে এ বিচার টিকবে না। আর যাঁরা বিচার চাইবেন, তাঁরাও সন্তুষ্ট হবেন না। ৪ আগস্ট টিআইবি এক প্রতিবেদনে বলেছে, সুশাসনের আলোকে অপ্রাপ্তি, বিশেষ করে একদিকে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অ্যাডহক ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্য, গ্রেপ্তার ও জামিন-বাণিজ্যের স্বাভাবিকতার চাপে রাষ্ট্র সংস্কারের অভীষ্ট অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সম্প্রতি অভিযোগ করে বলেছেন, জুলাই আন্দোলনকে মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করা হয়েছে।

জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের (অন্তর্ভুক্তি) কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে।’

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে হলে এগোতে হয় ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন অর্থাৎ সত্য ও পুনর্মিলনের পথে। কিন্তু আমরা হাঁটছি বিরোধ ও প্রতিশোধের পথে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত মে মাসে এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন বটে, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু পরের মাসেই মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি।

জুলাই আন্দোলনে নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা প্রকাশ পায়নি। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গানে-স্লোগানে এবং দেয়াললিখন ও গ্রাফিতিতে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশার প্রকাশ ঘটেছিল। মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা জেগেছিল, স্বৈরাচারী সরকার আর আসবে না, গণতান্ত্রিক রূপান্তর হবে। কিন্তু বর্তমান প্রশাসনেও দলীয়করণ থেমে নেই। এক দলের জায়গায় অন্য দল এসে বসেছে। জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলা হলেও বিশেষ মহলের ইচ্ছা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস লক্ষণীয়। জাতি, ধর্ম, শ্রেণি বা জেন্ডারের নামে বৈষম্যবাদী রাজনীতি ও দর্শন যারা ধারণ করে, তাদের তুমুল দাপট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারাই কেবল এই গণ-অভ্যুত্থান করেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিএনপির মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও দক্ষিণপন্থার উত্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।

বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন করতে হবে, ধর্মীয় বৈষম্যের কোনো ব্যবস্থা রাষ্ট্রের থাকা যাবে না, জাতিগত বৈষম্য নিরসনে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিরও স্বীকৃতি থাকতে হবে এবং জেন্ডারবৈষম্যও দূর করতে হবে। আর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পাশাপাশি দরকার আইনের শাসন নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এক বছরে সরকার বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। পারবে বলেও মনে হয় না।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালার সঙ্গে শত্রুতা মুহাম্মদ ইউনূসের, আমি ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’: টিউলিপ সিদ্দিক

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে লেখা—‘প্রস্তুত হ রাজাকার’

ফেল করায় বকা খেয়ে বাড়ি ছাড়ে বাংলাদেশি কিশোরী, ভারতে ৩ মাসে ২০০ লোকের ধর্ষণ

৪০ পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার, অর্থ ফেরতের নির্দেশ

গণশুনানিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষোভ দেখালেন মৎস্যচাষি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত