Ajker Patrika

শরণার্থী: ইউক্রেনীয়রা মূল্যবান, সুদানিরা ফেলনা

মায়া এল জুন্ডি
সুদানি শরণার্থীরা বিশ্বের মনোযোগ, অর্থায়ন এবং জরুরি পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
সুদানি শরণার্থীরা বিশ্বের মনোযোগ, অর্থায়ন এবং জরুরি পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

ঠিক তিন বছর আগে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য বাহু প্রসারিত করেছিল ইউরোপ। আজ তারাই ভূমধ্যসাগরের ওপারে থাকা ৪০ লাখের বেশি ক্ষুধার্ত আফ্রিকানদের দিকে দৃষ্টি অন্ধ করে রেখেছে। তাদের দেখেও দেখছে না।

এই বিষয়টি একটি বড় ধরনের বৈপরীত্যকে উন্মোচন করে, যা বিশ্বের সহানুভূতির প্রদর্শনে একটি বেদনাদায়ক দ্বিচারিতাকে প্রকাশ করেছে। কাগজ-কলমে এবং মানবিক সংস্থাগুলোর যত্নসহকারে তৈরি করা সুন্দর বক্তব্যে বলা হয়, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতার মানবিক নীতির আলোকে প্রতিটি শরণার্থীই মর্যাদা ও সহায়তা পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে, কে আসলে সেই সহায়তা পায় তা প্রায়ই নির্ভর করে তারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের ত্বকের রং কী এবং বিশ্বের দৃষ্টি এখনো তাদের সংকটের দিকে রয়েছে কি না তার ওপর।

সংখ্যার দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখব ২০২৪ সালে দাতা দেশগুলো তাদের নিজস্ব সীমান্তের মধ্যে স্থানচ্যুতির প্রথম বছরে শরণার্থীদের সহায়তার জন্য প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলো পূরণ করে। যদিও এই অর্থ জাতীয়তার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়নি, তবু এটা স্পষ্ট যে এর বেশির ভাগই ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপ প্রায় ৪৪ লাখ ইউক্রেনীয়কে অস্থায়ী সুরক্ষার আওতায় আশ্রয় দিয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সেখানে সবচেয়ে বড় শরণার্থী জনসংখ্যা। এর মানে, গড়ে প্রতি ইউক্রেনীয় শরণার্থী বছরে প্রায় ৬ হাজার ২০০ ডলার সহায়তা পাচ্ছে।

এখন যদি আমরা এর সঙ্গে সুদানের পরিস্থিতির তুলনা করি, তাহলে দেখা যায় যে ১২ লাখের বেশি সুদানি শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ চাদে আশ্রয় নিয়েছে এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, ছয় মাসের জন্য অর্ধেক রেশন দিতে তাদের ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার প্রয়োজন। এটি গড়ে প্রতি ব্যক্তির জন্য বছরে প্রায় ৭৭০ ডলার দাঁড়ায়। মিসর, ইথিওপিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং লিবিয়ার মতো অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে অর্থায়ন এতটাই কম যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ডব্লিউএফপি সতর্ক করে দিয়েছে যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খাদ্য সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ডব্লিউএফপি আরও বলছে, এই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষুধা ও অপুষ্টি রোধে জরুরি ভিত্তিতে তাদের ২০ কোটি ডলার প্রয়োজন।

এই পার্থক্যটি সত্যিই হতবাক করার মতো এবং অত্যন্ত লজ্জাজনক: একজন ইউক্রেনীয় শরণার্থীর জন্য যেখানে বছরে ৬ হাজার ২০০ ডলার ব্যয় হচ্ছে, সেখানে একজন সুদানি শরণার্থীর জন্য ব্যয় মাত্র ৭৭০ ডলার। কিছু সুদানি শরণার্থী তো আগামী মাসগুলোতে কোনো ধরনের সহায়তা নাও পেতে পারে।

তবে এটা নয় যে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা সাহায্য পাওয়ার যোগ্য নয়। অবশ্যই তারা সাহায্য পাওয়ার যোগ্য, নিঃসন্দেহে। এই তুলনা ইউক্রেনীয়দের দুর্ভোগকে খাটো করার জন্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সুদানি পরিবারগুলো—যারা পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে—তাদের প্রতি একই রকম সহানুভূতির ঢল দেখা যায় না? এটি আসলে অর্থের বিষয় নয়, কারণ আফ্রিকায় লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ২০ কোটি ডলার হলো ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে কিছু দেশ যে পরিমাণ অর্থ এক সপ্তাহেই ব্যয় করে তার চেয়ে কম, অথবা একটি যুদ্ধবিমান কেনার খরচেরও চেয়ে অনেক কম।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি একটি কঠিন সত্যকে প্রকাশ করে—কিছু জীবনকে শোক করার মতো বেশি যোগ্য, বেশি দৃশ্যমান, বেশি মূল্যবান বলে মনে করা হয়। বিশ্বব্যাপী দুর্ভোগের প্রতি প্রতিক্রিয়ায় এক ধরনের নীরব শ্রেণিবিন্যাস কাজ করে। ইউক্রেনীয়রা ইউরোপজুড়ে নীতি পরিবর্তন, বাজেট বৃদ্ধির ঘোষণা এবং জনসমর্থন পেয়েছে। অন্যদিকে, সুদানি শরণার্থীরা মুখোমুখি হচ্ছে বাজেট কাটছাঁট, দাতাদের ক্লান্তি ও নীরবতার।

কেউ একজন প্রশ্ন করতেই পারে: এই পার্থক্যের কারণ কী? এখানে বর্ণের ভূমিকা আছে, তবে ভৌগোলিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইউরোপ ইউক্রেনকে তাদের কাছের মনে করে। কিন্তু গণমাধ্যমের প্রচার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ইউক্রেন শিরোনাম দখল করে রাখে, শীর্ষ সম্মেলন ও আলোচনায় স্থান পায়, বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে। কিন্তু সুদানের খবর খুব কমই প্রচারিত হয়। সেখানে যুদ্ধ প্রায় তিন বছর ধরে চলতে থাকায় ৪০ লাখের বেশি শরণার্থী সাতটি প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেছে এবং ১ কোটির বেশি মানুষ নিজ দেশে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করছে আরও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ব্যাপক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আসন্ন। তবু তাদের প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ দ্রুতই কমছে।

এর ফলাফল মর্মস্পর্শী, বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে যে সুদানি শরণার্থী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ক্রমাগত এবং বহুগুণ হারে বাড়ছে। একই সময়ে, মানবিক কর্মীদের বাধ্য করা হচ্ছে সহায়তা কর্মসূচি সীমিত করতে বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিতে। কঠিনভাবে বলতে গেলে, পুরো শরণার্থীদের শিগগিরই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য একা ফেলে রাখা হতে পারে। কারণ বিশ্ব তাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে।

আমি আর মনে করি না যে এটি শুধু একটি যুদ্ধজনিত সংকট; এই সংকট এখন উদাসীনতাজনিত। কী ঘটে যখন বিশ্ব কোনো যুদ্ধকে ভুলে যায়? একটি নৃশংস, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে? ৪০ লাখের বেশি সুদানি শরণার্থী খুব শিগগিরই সেই উত্তর জানতে চলেছে।

যদি আমরা সত্যিই মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, তাহলে তা কেবল তখনই সক্রিয় হতে পারে না, যখন ক্যামেরা চালু থাকে বা ভূরাজনীতি কোনো ইস্যুকে সুবিধা দেয়। সহানুভূতি, সহায়তা, পক্ষে কথা বলা, রাষ্ট্র গঠন, সংকটের অবসান—এসবই আফ্রিকার শরণার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে, সেসব ভুলে যাওয়া সংকটগুলোতেও, এমনকি যখন কেউ দেখছে না তখনো।

সুদানি শরণার্থীরা বিশ্বের মনোযোগ, অর্থায়ন এবং জরুরি পদক্ষেপের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের ছয় মাস খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ২০ কোটি ডলার অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য। কিন্তু যা অনুপস্থিত তা হলো গরজ। আর যা অনুপস্থিত তা হলো এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

আমরা আমাদের সহানুভূতির যোগ্য কে, তা বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই। পরেরবার যখন আমরা বলব, ‘আবার কখনো নয়’, সেটি হোক এমন এক প্রতিশ্রুতি, যা সব শরণার্থীর জন্য পালন করা হয়, তাদের পাসপোর্ট বা ত্বকের রং নির্বিশেষে।

(মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)

লেখক: গবেষণা সহকারী, সেন্টার ফর কনিফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান স্টাডিজ, দোহা, কাতার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত