Ajker Patrika

অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়

আনোয়ারুল হক
Thumbnail image
সবকিছুই মুজিবময় করার বিরক্তিকর ও স্বেচ্ছাচারী প্রচেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। গত ১০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অন্যতম রূপকার মাহফুজ আলম। তিনি যখন শপথ গ্রহণ করেন, তখন তাঁর মাথার ওপরে স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটি ছিল। কিন্তু শপথ শেষে তা নামিয়ে ফেলা হয়। ওই ছবিবিহীন স্থানে দাঁড়িয়ে বিজয়ের ভঙ্গিতে নিজের ছবিসহ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তরুণ এই নেতা। এ বিষয়ে সাংবাদিক মাসুদ কামাল কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করার পরপরই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এর পরদিন আর একটি স্ট্যাটাস দিয়ে মাহফুজ বলেন, ‘ছবিটি কর্মকর্তারা নামিয়েছেন।’

প্রশ্ন উঠেছে ছবিটি নামানোর সময় তিনি কি নিষেধ করেছিলেন, নাকি তাঁর সম্মতিতেই নামানো হয়েছিল? যাক, এ প্রসঙ্গ থাক। আগের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ১৯৭১ সালে উন্মেষ ঘটা জাতির বাসনা পুনর্বিবেচনার নতুন সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের পূর্বপুরুষের লড়াই এবং লাখ লাখ শহীদের আত্মদানের পেছনে যে বাসনা ছিল, সেটা আমরা আবার বাস্তবায়নের সুযোগ পেলাম।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মানুষের মুক্তির যে স্বপ্ন ছিল, সেটা নিছক কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল না।’ ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব মাহফুজ আলম দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে জাতির স্বাধীন ভূখণ্ড গঠনের যে বাসনা এবং সাম্য, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা, তা রূপায়ণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কে? নিশ্চয় মাহফুজ আলম নন। একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেকোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।’ ছবি সরানো কি গড়ার পর্যায়ে পড়ে?

মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে শেখের ছবি নামানো হয়েছে।’ এ কেমন কথা! স্কুলে ছাত্রছাত্রী অসদাচরণ করলে যেমন অভিভাবককে ডেকে পাঠানো হয়, তেমনি হাসিনার অপরাধের জন্য মুজিবের ছবি টেনে নামানো হলো। মাহফুজ আলম আরও বলেছেন, স্বাধীনতার পর পিতার ‘কৃত অপরাধের’ জন্য এখন কন্যা ক্ষমা চাইলে পিতাকে আবার সম্মানের আসনে বসানো হবে। কিন্তু জাতীয় সম্পদের যেমন কোনো একক মালিকানা থাকে না, তেমনি একটা দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাঁদের পরিচয়ে পরিচিত হন না—তা যতই তারা তাঁর নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। দেশের স্থপতি হিসেবে শেখ মুজিবের পরিচিতি তো কন্যার কারণে নয়।

মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস দেখে আমার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ছে। শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুর প্রসঙ্গে শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘যিনি খারাপ কাজ করবেন, তা ফের তাঁর ওপরই আসবে। শেখ মুজিবুর রহমান এই অবিভক্ত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছিলেন। যিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি অবশেষে তাঁর করুণ পরিণতি ভোগ করেছেন।’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মনোযাতনা দেখে আমার মনে হয়েছে শেখ মুজিব দেয়ালের ছবিতে না থাকলেও আমাদের সঙ্গে এই বাংলাদেশেই আছেন। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কেননা, তিনিই আমাদের স্বাধীনতার নেতা। অবশ্যই স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে একদিকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, দলীয় লোকজনের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি; অন্যদিকে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে দেশের কিছু এলাকায় সশস্ত্র লড়াই, ঈদের জামাতে গুলি করে জনপ্রতিনিধি হত্যা, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে হরতালের ডাক ইত্যাদি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি কতটুকু প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, গণতন্ত্রের পরিসর কতটুকু সংকুচিত করেছেন—সেসব নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে...।

এবারের আন্দোলনের ছাত্রনেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, তারা এখনো ‘ট্রমাটাইজড’। মুজিবের ছবি নামানো এবং সেটাকে কেন্দ্র করে পোস্ট দেখে মনে হয় তাঁরা আসলেই ‘ট্রমাটাইজড’। কেউ কেউ তো গত ১০০ দিনে নাকি ১০০ ঘণ্টাও ঘুমাতে পারেননি। ট্রমাটাইজড অবস্থা কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টি করে। তাই তাঁরা দ্রুত ট্রমা ও অস্থিরতা থেকে বের হয়ে আসুক। শেখ হাসিনাও কিন্তু ট্রমাটাইজড ছিলেন! সে বিষয়ে আরেক দিন লেখার ইচ্ছা আছে।

বর্তমান সরকারে বহুমুখী ভাবধারার মানুষের সমন্বয় হয়েছে। কিন্তু যাঁরা চালিকাশক্তি হিসেবে পেছনে আছেন, মাঝে মাঝে মনে হয় কর্তৃত্ববাদী হাসিনা বা আওয়ামী দুঃশাসন অপেক্ষা একাত্তর বা মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁদের আক্রোশ বেশি, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। তাই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মুজিবকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে মনের ঝাল মেটাচ্ছেন! আর এই সুযোগ শেখ হাসিনা করে দিয়ে গেছেন—সবখানেই মুজিবের ছবি, সব মোড়েই মুজিবের ভাস্কর্য, সব প্রতিষ্ঠান-স্থাপনা মুজিবের নামে, সবকিছুই মুজিবময় করার বিরক্তিকর ও স্বেচ্ছাচারী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

এবারের আন্দোলনের এই স্বপ্নিল উত্তরণের জননী শেখ হাসিনা, তাঁর ভয়ংকর নোংরা দীর্ঘস্থায়ী কর্তৃত্ববাদ। মাহফুজ আলমদের সবচেয়ে বেশি ঋণী থাকা উচিত শেখ হাসিনার কাছে। এখানে জামায়াত-শিবির এমনকি বিএনপিও স্বনামে, নিজ পরিচয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পায় না। এখানে সফলতা পেতে হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের জমিন লাগে, জাতীয় পতাকার লাল সূর্য কপালে ধারণ করা লাগে, ডি এল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ কণ্ঠে তুলে নিতে লাগে!

আবার এসব দেখে দেশবাসীও নিশ্চিন্ত হয় যে আশার সব জায়গা এখনো জীবিত আছে। কঠিনেরে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রূপকথার গল্পের চেয়েও উজ্জ্বল এক সংগ্রামের জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখা এই দলকে এখন তার নিজের দেশের মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হচ্ছে। এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগের রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। তার পরেও আন্দোলনের সামনের কাতারে থাকা নেতারা কিসের ভয়ে এত অস্থির!

মাহফুজ আলম দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন প্রক্রিয়া, ভবিষ্যৎ সরকার, সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে বিতর্ক না করে সেসব বিষয়ে অধিক মনোযোগ দিয়ে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণের উপায় বের করতে পারলে এবারের আন্দোলনের সাফল্য স্থায়ী রূপ পাবে।

লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত