সম্পাদকীয়
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন—এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ নামের এই প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে গদিচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশদাতা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুম ও খুনের বিষয়ে অবগত আছেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে এ ভয়াবহ তথ্য জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এইচআরডব্লিউ এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে বলে জানানো হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, বাহিনীকে রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং র্যাবে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পুরস্কৃত করে নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামোর অধীনে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের ঘটনা ঘটত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুমের ঘটনা দেখাশোনা করতেন স্বয়ং শেখ হাসিনা এবং তাঁর নির্বাচিত কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। কথিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক। তিনি শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়ও বটে। শেখ রেহানার দেবর। এ ছাড়া সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গুম-খুনের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য ছিলেন।
এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, গুমের সঙ্গে জড়িত এমন কর্মকর্তা তাদের বলেছেন, গুমের বিষয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের সিনিয়র সদস্যরা জানতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হয়ে যাওয়ার পর বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর’ থেকে ছাড়া পাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ্ আমান আযমী, মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান), মাইকেল চাকমার আটকের বিষয়ে শেখ হাসিনা আগাগোড়াই জানতেন। এ ছাড়া বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তান হুম্মাম কাদের চৌধুরীকেও যে গুম করা হয়েছিল, সে ব্যাপারেও শেখ হাসিনা অবগত ছিলেন। বেআইনিভাবে আটকে রাখার বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে হুম্মামকে ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আযমী, আরমান ও হুম্মাম—তিনজনই বিরোধীদলীয় নেতাদের সন্তান। আরমানের গুমের বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, এ ধরনের আটকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হতো। এই কর্মকর্তাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, আযমী, আরমান ও হুম্মাম হলেন বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতাদের সন্তান। শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া তাঁদের মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত একমাত্র শেখ হাসিনাই নিতে পারেন।
ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমাকৃত গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ নামে প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনা ঘটেছে মূলত রাজনৈতিক কারণেই। গুম করা হতো চার ধরনের ব্যক্তিকে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, যাঁরা শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতেন। এ সমালোচনা হতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সংবাদপত্রের কলামে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো ইত্যাদিতে। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত বিরোধে। যেমন হাসিনা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব আছে, তেমন কেউ তাঁর প্রভাব খাটিয়ে র্যাব বা ডিবিকে দিয়ে গুম করে শায়েস্তা করতেন। শেষ ক্যাটাগরি হলো জঙ্গি বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি। তবে এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জঙ্গি সন্দেহের ১০০টি গুমের ঘটনার মধ্য হয়তো ৮০টির ঘটনার অভিযোগ অসত্য ছিল। গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন এযাবৎ ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগপর্যন্ত ৭৫৮টি বিশ্লেষণ করেছে। তার মধ্যে অন্তত ২০৪ জনের ফিরে না আসার কথা জানতে পেরেছে। তবে মোট অভিযোগের মধ্যে ৪০০ থেকে ৫০০ জনের হদিস তারা পায়নি। যাঁদের হদিস নেই তাঁদের বিষয়ে কাজ করছে তারা।
ইতিপূর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের গুম বিষয়ে ব্যাপক কাজ করেছে। তারা বলেছিল, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। এসব সংস্থা বিরোধী দল এবং ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের শারীরিক নজরদারি এবং সেই সঙ্গে সেলফোন কিংবা ল্যান্ড ফোনে আড়ি পাতা, আন্তর্জাতিক সেলফোন গ্রাহক পরিচয় শনাক্তকরণ, অবস্থানভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেম সফটওয়্যার ও ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্র্যাকিং করা হতো। এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে বলে তারা দাবিও করেছিল। ডিক্লারেশন অন দ্য প্রকেটশন অব অল পারসন ফ্রম এনফোর্সড ডিজাপেয়ারেন্স অর্থাৎ গুমের শিকার হওয়া থেকে প্রতিটি ব্যক্তির সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণার লঙ্ঘন এবং এ ঘোষণা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে যে বাধা দেওয়া হতো, এমন অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ।
গুমের বিষয়ে সে সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিল। যেমন সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সেসব বিষয়ে সরকারের মন্তব্য কিংবা বক্তব্য কী? গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে যেন কোনো বাধার মুখোমুখি না হয়, তা সরকার নিশ্চিত করে কি না? গুমের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা গুমের শিকার স্বজন, সাক্ষী, আইনজীবীদের কোনো ভয়ভীতি দেখানো বা মামলা বা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য কোনো প্রকার অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় কি না—এসব সরকার কীভাবে নিশ্চিত করে? ভয়ভীতি বা চাপে পড়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে না পারলে, বিশেষ করে এ ধরনের অভিযোগ নথিভুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়লে সরকার কীভাবে গুমের ঘটনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করার বিষয়ে নিশ্চিত করে ইত্যাদি।
ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার অধীন ছয় শতাধিক গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০১৩ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে গুমসংক্রান্ত এমন আরও অনেক ঘটনা ও নির্দিষ্ট বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলেও শেখ হাসিনা সরকার কোনো জবাব দেয়নি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যে দেড় সহস্রের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার মাত্রা বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন চাক্ষুষ সাক্ষীর বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিলেন—এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে—‘আমি পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে গুলি চালাতে দেখেছি। আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখার জন্য যে সমস্ত উৎসুক মানুষ তাঁদের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এমনকি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অফিসে বসে সিসিটিভির মনিটরে ফুটেজ দেখে ঘটনাস্থলে থাকা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের এমন মনোভাব দেখে মনে হয়েছে তাঁরা যেন ভিডিও গেমে শত্রুর উদ্দেশ্যে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে গিয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসনও বলেছেন, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা তাঁদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা এবং সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। বছরের পর বছর ইলিয়াস আলীর মতো একজন রাজনৈতিক নেতা এভাবে হারিয়ে যাবেন এবং সে খবর সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা জানবেন না, এ কথা কাকপক্ষীও বিশ্বাস করবে না। অথচ ৫ আগস্টের পর ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা খুব নিকট থেকে দেখেছেন, এমন একজনের বর্ণনা আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি। কাজেই বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে যে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি চালু ছিল, তার দায়িত্ব শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিটি ঘটনার জবাব তাঁকেই দিতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কিছুতেই তাঁর দায় এড়াতে পারেন না।
একেএম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন—এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ নামের এই প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে গদিচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশদাতা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুম ও খুনের বিষয়ে অবগত আছেন—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে এ ভয়াবহ তথ্য জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশ-র্যাবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। এইচআরডব্লিউ এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে বলে জানানো হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, বাহিনীকে রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং র্যাবে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পুরস্কৃত করে নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামোর অধীনে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের ঘটনা ঘটত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুমের ঘটনা দেখাশোনা করতেন স্বয়ং শেখ হাসিনা এবং তাঁর নির্বাচিত কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। কথিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক। তিনি শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয়ও বটে। শেখ রেহানার দেবর। এ ছাড়া সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গুম-খুনের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য ছিলেন।
এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, গুমের সঙ্গে জড়িত এমন কর্মকর্তা তাদের বলেছেন, গুমের বিষয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের সিনিয়র সদস্যরা জানতেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম ও খুনের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হয়ে যাওয়ার পর বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর’ থেকে ছাড়া পাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ্ আমান আযমী, মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান), মাইকেল চাকমার আটকের বিষয়ে শেখ হাসিনা আগাগোড়াই জানতেন। এ ছাড়া বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তান হুম্মাম কাদের চৌধুরীকেও যে গুম করা হয়েছিল, সে ব্যাপারেও শেখ হাসিনা অবগত ছিলেন। বেআইনিভাবে আটকে রাখার বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে হুম্মামকে ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আযমী, আরমান ও হুম্মাম—তিনজনই বিরোধীদলীয় নেতাদের সন্তান। আরমানের গুমের বিষয়ে দেখাশোনা করেছেন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, এ ধরনের আটকের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নেওয়া হতো। এই কর্মকর্তাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, আযমী, আরমান ও হুম্মাম হলেন বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতাদের সন্তান। শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া তাঁদের মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অর্থাৎ তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে কি হবে না, সে সিদ্ধান্ত একমাত্র শেখ হাসিনাই নিতে পারেন।
ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমাকৃত গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ নামে প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের ঘটনা ঘটেছে মূলত রাজনৈতিক কারণেই। গুম করা হতো চার ধরনের ব্যক্তিকে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, যাঁরা শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতেন। এ সমালোচনা হতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, সংবাদপত্রের কলামে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো ইত্যাদিতে। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত বিরোধে। যেমন হাসিনা সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব আছে, তেমন কেউ তাঁর প্রভাব খাটিয়ে র্যাব বা ডিবিকে দিয়ে গুম করে শায়েস্তা করতেন। শেষ ক্যাটাগরি হলো জঙ্গি বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি। তবে এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জঙ্গি সন্দেহের ১০০টি গুমের ঘটনার মধ্য হয়তো ৮০টির ঘটনার অভিযোগ অসত্য ছিল। গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন এযাবৎ ১ হাজার ৬৭৬টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগপর্যন্ত ৭৫৮টি বিশ্লেষণ করেছে। তার মধ্যে অন্তত ২০৪ জনের ফিরে না আসার কথা জানতে পেরেছে। তবে মোট অভিযোগের মধ্যে ৪০০ থেকে ৫০০ জনের হদিস তারা পায়নি। যাঁদের হদিস নেই তাঁদের বিষয়ে কাজ করছে তারা।
ইতিপূর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের গুম বিষয়ে ব্যাপক কাজ করেছে। তারা বলেছিল, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। এসব সংস্থা বিরোধী দল এবং ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের শারীরিক নজরদারি এবং সেই সঙ্গে সেলফোন কিংবা ল্যান্ড ফোনে আড়ি পাতা, আন্তর্জাতিক সেলফোন গ্রাহক পরিচয় শনাক্তকরণ, অবস্থানভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেম সফটওয়্যার ও ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্র্যাকিং করা হতো। এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে বলে তারা দাবিও করেছিল। ডিক্লারেশন অন দ্য প্রকেটশন অব অল পারসন ফ্রম এনফোর্সড ডিজাপেয়ারেন্স অর্থাৎ গুমের শিকার হওয়া থেকে প্রতিটি ব্যক্তির সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণার লঙ্ঘন এবং এ ঘোষণা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে যে বাধা দেওয়া হতো, এমন অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ।
গুমের বিষয়ে সে সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিল। যেমন সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সেসব বিষয়ে সরকারের মন্তব্য কিংবা বক্তব্য কী? গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে যেন কোনো বাধার মুখোমুখি না হয়, তা সরকার নিশ্চিত করে কি না? গুমের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা গুমের শিকার স্বজন, সাক্ষী, আইনজীবীদের কোনো ভয়ভীতি দেখানো বা মামলা বা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য কোনো প্রকার অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় কি না—এসব সরকার কীভাবে নিশ্চিত করে? ভয়ভীতি বা চাপে পড়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে না পারলে, বিশেষ করে এ ধরনের অভিযোগ নথিভুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়লে সরকার কীভাবে গুমের ঘটনা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দ্রুত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করার বিষয়ে নিশ্চিত করে ইত্যাদি।
ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার অধীন ছয় শতাধিক গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০১৩ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ে গুমসংক্রান্ত এমন আরও অনেক ঘটনা ও নির্দিষ্ট বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলেও শেখ হাসিনা সরকার কোনো জবাব দেয়নি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যে দেড় সহস্রের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার মাত্রা বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন চাক্ষুষ সাক্ষীর বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিলেন—এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে—‘আমি পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনকারীদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে গুলি চালাতে দেখেছি। আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখার জন্য যে সমস্ত উৎসুক মানুষ তাঁদের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। এমনকি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অফিসে বসে সিসিটিভির মনিটরে ফুটেজ দেখে ঘটনাস্থলে থাকা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বিক্ষোভকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের এমন মনোভাব দেখে মনে হয়েছে তাঁরা যেন ভিডিও গেমে শত্রুর উদ্দেশ্যে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে গিয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসনও বলেছেন, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা তাঁদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা এবং সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনা উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। বছরের পর বছর ইলিয়াস আলীর মতো একজন রাজনৈতিক নেতা এভাবে হারিয়ে যাবেন এবং সে খবর সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা জানবেন না, এ কথা কাকপক্ষীও বিশ্বাস করবে না। অথচ ৫ আগস্টের পর ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা খুব নিকট থেকে দেখেছেন, এমন একজনের বর্ণনা আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি। কাজেই বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে যে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি চালু ছিল, তার দায়িত্ব শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিটি ঘটনার জবাব তাঁকেই দিতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা কিছুতেই তাঁর দায় এড়াতে পারেন না।
একেএম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি একটি অনন্য মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য যে পথ রচনা করে দিয়েছে, সেই পথই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে সেই পথকে করেছে মসৃণ...
৩ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা বাধা দেখা যাচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
৩ ঘণ্টা আগেআজ থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা শুরু হচ্ছে। মাসব্যাপী এই আয়োজন প্রাণের মেলায় পরিণত হোক, সেই কামনা করি। তবে আজ বইমেলা নিয়ে নয়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে যে নাটক অভিনীত হলো, তা নিয়েই কিছু কথা বলা সংগত হবে।
৩ ঘণ্টা আগে২০ বছর আগে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অটিজম শব্দটির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজে পাওয়া যেত না। অটিজম বিষয়ে মানুষের ধারণা সীমিত ছিল। ঠিক সেই সময়ে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন পরিচালিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ‘কানন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ৪ এপ্রিল, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির একটি চারতলা ভাড়া বাড়িতে...
২১ ঘণ্টা আগে