সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
পাকিস্তানের জাতির পিতা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আমরা তাঁকে ভুলে যেতে চাইব। কেননা মৃতের সঙ্গে ঝগড়া নেই। জুলিয়াস সিজার প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের মার্ক অ্যান্টর্নি যে বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায়, মৃতের ভালো কাজগুলো প্রায় সবই কবরে মিশে যায়, খারাপ কাজগুলোই বেঁচে থাকে, সেই কথা ঘুরিয়ে দিয়ে আমরা বরং বলব খারাপ কাজের স্মৃতি মরে যাক, ভালো কাজ বাঁচুক, শক্তি যদি থাকে বাঁচার। কিন্তু অনুরাগীরা সেটা হতে দেন না। এ বছরই বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় প্রেসক্লাবে জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলেন তাঁর অনুরাগীরা। আমরা ঝগড়া করতে চাই না। জীবনের শেষে এখন তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন, নিন, বিশ্রামই তাঁর বেশি প্রয়োজন। কিন্তু অনুরাগীরা ছাড়ছেন না, তাঁকে টেনে বের করেছেন, বলছেন তিনি মহামানব ছিলেন। তাঁর আদর্শ ও দর্শন তাঁরা কায়েম করবেন, বাস্তবে।
কিন্তু তাঁর আদর্শ কী ছিল, সেটা তো বলেন না। তবে এটা জানি আমরা, অনুসারীরা যা-ই বলুন, যত জোরেই বলুন, বাঙালির পক্ষে ছিলেন না তিনি, ছিলেন বিরুদ্ধে। প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ঔপনিবেশ করতে। একটি পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর অনুসারীরা একাত্তরে ঘৃণ্য ভূমিকায় প্রত্যক্ষেই ছিল, তাঁরই অনুসারী খান এ সবুর একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর রাতেই তো টেলিভিশনে এক বক্তৃতায় বাংলাদেশকে জারজ সন্তান বলেছিলেন। তবে একাত্তরের সূচনা তো একাত্তরে নয়, অনেক আগে, সেই অনেক আগে থেকেই তিনিও ছিলেন একাত্তরবিরোধী। এই ব্যাপারে তো কোনো ঢাকঢাক গুড়গুড় ছিল না।
এত বছর পর জিন্নাহর অনুরাগীরা যে তাঁর অস্পষ্ট আদর্শ ও দর্শন নিয়ে হল্লা করছেন, সে-কাজটা কিন্তু মোনাফেকি হচ্ছে। তবে বলতেই হয় যে এ কাজ দিয়ে মৃত লিডারের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না, লিডারের আসল বীরত্ব তুলে ধরা হচ্ছে না জাতির সামনে। তবে এটা বোধ হয় বলা দরকার যে দেশে সরকার বদল হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে অন্তর্বর্তী নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে এবং অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তানের জাতির পিতাকে স্মরণ করা উপলক্ষে এমন সব রাজনৈতিক ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিকেই আক্রমণ করে।
স্মরণসভায় যাঁরা জিন্নাহর আদর্শ ও দর্শনের প্রশংসা করতে সক্ষম হননি, তাঁদের একজন বলেছিলেন, মরহুম খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। সেসব বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, কিন্তু সেসব বক্তৃতার কোনোটাই যে বাঙালি জনগণের পক্ষে ছিল না, তা বোধ করি নির্দ্বিধায় বলা যায়। খোদা না করুন, তাঁর স্বপ্ন যদি সফল হতো, তবে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? একসময়ে আমরাও পাকিস্তানে বিশ্বাস করতাম, যখন চিনিনি পাকিস্তান জিনিসটা আসলে কী। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ়তায় চিনলাম প্রথমে, চিনে হতাশ হলাম, ধিক্কার দিলাম, চেষ্টা করলাম প্রতিবাদী হতে। আর তিনি? তিনি না থাকলেও তাঁর গড়া রাষ্ট্র বাধা দিল সর্বশক্তি দিয়ে। পাকিস্তান কী ছিল? ছিল শোষণের একটি প্রকাণ্ড যন্ত্র। তাজা আখের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকে সেই যন্ত্রের ভেতর, রস বের করে নেবে। বেরিয়ে যে আসতে পেরেছি, সে আমাদের মনুষ্যত্বের জোরে। সেই যন্ত্রটাকে চালু রাখাই তো ছিল পাকিস্তান স্রষ্টার আদর্শ ও দর্শন। তাঁর অনুরাগীরা এখনো খোয়াব দেখেন সেই পরিত্যক্ত পাকিস্তানের, যেখানে তাঁরা লুটপাটের অংশ পাবেন। পাকিস্তান এখন খোদ পাকিস্তানেই মার খাচ্ছে, তবু বেঁচে আছে এদের দিবাস্বপ্নে। ধন্য আশা কুহকিনী।
সভায় একজন বলেছেন, আমরা ইতিহাস পড়ি না। মিথ্যে বলেননি। কিন্তু কার ইতিহাস পড়ব? পড়ব কি সেই ইতিহাস, যে ইতিহাস ভূতপ্রেতের? দৈত্য-দানবের? বিপরীত ইতিহাসও আছে। মানুষের ইতিহাস। সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস পড়বার সুযোগ পাই কোথায়? উৎপাত নানাবিধ, উত্ত্যক্ত করে অনেকে—ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানবেরাও। তদুপরি আছে আমাদের অভাব, আছে আমাদের হতাশা। সেই আমাদের অমনোযোগের ফাঁকে ফাঁকে দুর্বত্তরা নায়ক হতে চায়। বাপের বেটারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জনসাধারণের স্বার্থের যে নিরিখে সেটাকে আমরা সামনে রাখতে পারিনি। জনসাধারণও পারেনি রাখতে, যে জন্য তারা ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে। আমরা বলি ক্ষমার কথা, উদারতার কথা। কিন্তু যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে, তারা ক্ষমা করবে কী করে? জনতার কাছে তো উদারতা মহানুভবতার প্রশ্ন অবান্তর: প্রশ্ন সেখানে একটাই—বাঁচা ও মরার। কে তাকে বাঁচতে সাহায্য করে, আর কে তাকে মারে—নিরিখ এটাই।
জনতার আন্দোলন এ দেশে হয়েছে। উনসত্তরে, নব্বইতে হয়েছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পরিস্থিতি ছিল এই রকম যে কোথাও একটি লুটের খবর পাওয়া যায়নি। বন্দুকের দোকান লুট হয়েছে, কিন্তু ক্যাশবাক্সে হাত পড়েনি। আগরতলা মামলার বিচারকের আবাসে সাধারণ মানুষ আগুন ধরিয়েছে; কিন্তু আসবাবপত্রের একটা ধরেও কেউ টান দেয়নি। এমনকি টাকাসহ মানিব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কেউ নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। অবিশ্বাস্য মনে হবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী লুণ্ঠনের ভিডিও ফুটেজ এবং সংবাদপত্রের খবর পড়লে। হাজার হাজার মানুষ এসেছিল সেদিন ঢাকা শহরে, অভ্যুত্থানের আহ্বানে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অংশ নিতে। আশঙ্কা ছিল আর কিছু না করুক অন্তত যদি থুতুও ছিটিয়ে যায় পথে-ঘাটে এবং এই শহরের চকচকে আত্মসন্তুষ্টির গায়ে, তবে মারাত্মক ব্যাপার হবে।
ছিটায়নি যে সে-ওবা বলি কী করে? আমাদের তো ধারণা ছিটিয়ে ছিল। আমাদের অন্য এক আশঙ্কার ওপর থুতু ছিটানো হয়েছে বইকি। আশঙ্কা ছিল লুটতরাজ হবে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধবে, ভীষণ গোলযোগ দেখা দেবে পথে পথে, মোড়ে মোড়ে; সংকট সৃষ্টি হবে আইন ও শৃঙ্খলার। হয়েছেও তাই। সাজানো বাগান যেমন তছনছ হয় তেমনি। তারা এসেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং চলে গেছে। তাদের আসার আগের ঢাকা ও পরের ঢাকা এক নয়। কিন্তু সেটা গোলযোগের দিক থেকে নয় একেবারেই। যে-জনতা যুদ্ধ করে, সেই জনতাই যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে, তা প্রমাণ হয়েছে উনসত্তরে, একাত্তরে। বিশেষভাবে তাঁদের জন্য যাঁরা জনতার ক্ষমতায় আস্থা রাখেন না, কেবলই বোঝা দেখেন, শক্তি দেখেন না। এও বোঝা গেল যে ল অ্যান্ড অর্ডার সমস্যা তখনই সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, যখন অর্ডারটা আসে ওপর থেকে। এবং যখন উসকানিদাতারা তৎপর থাকে জনতার মধ্যে লুকিয়ে। নইলে শৃঙ্খলা কাকে বলে জনতা তা দেখাতে পারে—যদি ঐক্য থাকে লক্ষ্যের ও উদ্দেশ্যের, যেমন ছিল উনসত্তরের অভ্যুত্থানে।
মফস্বলের মানুষ মফস্বলে চলে গেল, কেবল জানিয়ে গেল তারা আছে, জানান দিল তারা কী চায় এবং কী চায় না। এসব খবর সব সময়ে রাখা হয় না, শাসকেরা রাখে না, যারা সরাসরি শাসক নয়, অথচ শাসকেরা আছে বলেই করেকম্মে খাচ্ছে, তারাও রাখে না। মফস্বলে কী ঘটছে তার খবর বড় একটা আসে না খবরের কাগজেও। অথচ সেখানেই অধিকাংশ মানুষ থাকে এ দেশের।
জনতার আগুন ভিন্ন আগুন। জ্বালায়, কিন্তু লুট করে না। এ হচ্ছে সে আগুন, গ্রিক উপকথার দেবতারা যেটি মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, পাছে মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে। সেই আগুন, যা প্রমিথিউস চুরি করে মানুষকে এনে দিয়েছিলেন, দিয়ে শাস্তি পেয়েছিলেন। পাহাড়ে ঝুলিয়ে ইগল পাখি লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর ওপর। এ আগুনে সভ্যতার চাকা তৈরি হয়। এ আগুন লুণ্ঠনও করে না, আবার ক্ষমাও করে না।
লুণ্ঠন হয়েছে। একাত্তরেও হয়েছে। পাকিস্তানিরা করেছে। তাদের দোসরেরা করেছে। মুক্ত এলাকায় সব মানুষ মুক্ত ছিলেন, রাতের দরজা-জানালা খুলে ঘুমাতেন। চোর-ডাকাত ছিল না, ভূত-প্রেত ছিল না। কেউ ঘুষ খায়নি, কেউ ঘুষ দেয়নি। তারপর! পরের কাহিনি ভিন্ন কাহিনি। আশা হতাশায় পরিণত হওয়ার কাহিনি, যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাকিস্তানের জাতির পিতা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আমরা তাঁকে ভুলে যেতে চাইব। কেননা মৃতের সঙ্গে ঝগড়া নেই। জুলিয়াস সিজার প্রসঙ্গে শেক্সপিয়ারের মার্ক অ্যান্টর্নি যে বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায়, মৃতের ভালো কাজগুলো প্রায় সবই কবরে মিশে যায়, খারাপ কাজগুলোই বেঁচে থাকে, সেই কথা ঘুরিয়ে দিয়ে আমরা বরং বলব খারাপ কাজের স্মৃতি মরে যাক, ভালো কাজ বাঁচুক, শক্তি যদি থাকে বাঁচার। কিন্তু অনুরাগীরা সেটা হতে দেন না। এ বছরই বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় প্রেসক্লাবে জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলেন তাঁর অনুরাগীরা। আমরা ঝগড়া করতে চাই না। জীবনের শেষে এখন তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন, নিন, বিশ্রামই তাঁর বেশি প্রয়োজন। কিন্তু অনুরাগীরা ছাড়ছেন না, তাঁকে টেনে বের করেছেন, বলছেন তিনি মহামানব ছিলেন। তাঁর আদর্শ ও দর্শন তাঁরা কায়েম করবেন, বাস্তবে।
কিন্তু তাঁর আদর্শ কী ছিল, সেটা তো বলেন না। তবে এটা জানি আমরা, অনুসারীরা যা-ই বলুন, যত জোরেই বলুন, বাঙালির পক্ষে ছিলেন না তিনি, ছিলেন বিরুদ্ধে। প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ঔপনিবেশ করতে। একটি পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর অনুসারীরা একাত্তরে ঘৃণ্য ভূমিকায় প্রত্যক্ষেই ছিল, তাঁরই অনুসারী খান এ সবুর একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর রাতেই তো টেলিভিশনে এক বক্তৃতায় বাংলাদেশকে জারজ সন্তান বলেছিলেন। তবে একাত্তরের সূচনা তো একাত্তরে নয়, অনেক আগে, সেই অনেক আগে থেকেই তিনিও ছিলেন একাত্তরবিরোধী। এই ব্যাপারে তো কোনো ঢাকঢাক গুড়গুড় ছিল না।
এত বছর পর জিন্নাহর অনুরাগীরা যে তাঁর অস্পষ্ট আদর্শ ও দর্শন নিয়ে হল্লা করছেন, সে-কাজটা কিন্তু মোনাফেকি হচ্ছে। তবে বলতেই হয় যে এ কাজ দিয়ে মৃত লিডারের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না, লিডারের আসল বীরত্ব তুলে ধরা হচ্ছে না জাতির সামনে। তবে এটা বোধ হয় বলা দরকার যে দেশে সরকার বদল হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে অন্তর্বর্তী নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে এবং অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে পাকিস্তানের জাতির পিতাকে স্মরণ করা উপলক্ষে এমন সব রাজনৈতিক ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিকেই আক্রমণ করে।
স্মরণসভায় যাঁরা জিন্নাহর আদর্শ ও দর্শনের প্রশংসা করতে সক্ষম হননি, তাঁদের একজন বলেছিলেন, মরহুম খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। সেসব বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, কিন্তু সেসব বক্তৃতার কোনোটাই যে বাঙালি জনগণের পক্ষে ছিল না, তা বোধ করি নির্দ্বিধায় বলা যায়। খোদা না করুন, তাঁর স্বপ্ন যদি সফল হতো, তবে আজ আমরা কোথায় থাকতাম? একসময়ে আমরাও পাকিস্তানে বিশ্বাস করতাম, যখন চিনিনি পাকিস্তান জিনিসটা আসলে কী। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ়তায় চিনলাম প্রথমে, চিনে হতাশ হলাম, ধিক্কার দিলাম, চেষ্টা করলাম প্রতিবাদী হতে। আর তিনি? তিনি না থাকলেও তাঁর গড়া রাষ্ট্র বাধা দিল সর্বশক্তি দিয়ে। পাকিস্তান কী ছিল? ছিল শোষণের একটি প্রকাণ্ড যন্ত্র। তাজা আখের মতো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকে সেই যন্ত্রের ভেতর, রস বের করে নেবে। বেরিয়ে যে আসতে পেরেছি, সে আমাদের মনুষ্যত্বের জোরে। সেই যন্ত্রটাকে চালু রাখাই তো ছিল পাকিস্তান স্রষ্টার আদর্শ ও দর্শন। তাঁর অনুরাগীরা এখনো খোয়াব দেখেন সেই পরিত্যক্ত পাকিস্তানের, যেখানে তাঁরা লুটপাটের অংশ পাবেন। পাকিস্তান এখন খোদ পাকিস্তানেই মার খাচ্ছে, তবু বেঁচে আছে এদের দিবাস্বপ্নে। ধন্য আশা কুহকিনী।
সভায় একজন বলেছেন, আমরা ইতিহাস পড়ি না। মিথ্যে বলেননি। কিন্তু কার ইতিহাস পড়ব? পড়ব কি সেই ইতিহাস, যে ইতিহাস ভূতপ্রেতের? দৈত্য-দানবের? বিপরীত ইতিহাসও আছে। মানুষের ইতিহাস। সংগ্রামের ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস পড়বার সুযোগ পাই কোথায়? উৎপাত নানাবিধ, উত্ত্যক্ত করে অনেকে—ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানবেরাও। তদুপরি আছে আমাদের অভাব, আছে আমাদের হতাশা। সেই আমাদের অমনোযোগের ফাঁকে ফাঁকে দুর্বত্তরা নায়ক হতে চায়। বাপের বেটারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
জনসাধারণের স্বার্থের যে নিরিখে সেটাকে আমরা সামনে রাখতে পারিনি। জনসাধারণও পারেনি রাখতে, যে জন্য তারা ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে। আমরা বলি ক্ষমার কথা, উদারতার কথা। কিন্তু যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে, তারা ক্ষমা করবে কী করে? জনতার কাছে তো উদারতা মহানুভবতার প্রশ্ন অবান্তর: প্রশ্ন সেখানে একটাই—বাঁচা ও মরার। কে তাকে বাঁচতে সাহায্য করে, আর কে তাকে মারে—নিরিখ এটাই।
জনতার আন্দোলন এ দেশে হয়েছে। উনসত্তরে, নব্বইতে হয়েছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পরিস্থিতি ছিল এই রকম যে কোথাও একটি লুটের খবর পাওয়া যায়নি। বন্দুকের দোকান লুট হয়েছে, কিন্তু ক্যাশবাক্সে হাত পড়েনি। আগরতলা মামলার বিচারকের আবাসে সাধারণ মানুষ আগুন ধরিয়েছে; কিন্তু আসবাবপত্রের একটা ধরেও কেউ টান দেয়নি। এমনকি টাকাসহ মানিব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কেউ নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। অবিশ্বাস্য মনে হবে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-পরবর্তী লুণ্ঠনের ভিডিও ফুটেজ এবং সংবাদপত্রের খবর পড়লে। হাজার হাজার মানুষ এসেছিল সেদিন ঢাকা শহরে, অভ্যুত্থানের আহ্বানে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অংশ নিতে। আশঙ্কা ছিল আর কিছু না করুক অন্তত যদি থুতুও ছিটিয়ে যায় পথে-ঘাটে এবং এই শহরের চকচকে আত্মসন্তুষ্টির গায়ে, তবে মারাত্মক ব্যাপার হবে।
ছিটায়নি যে সে-ওবা বলি কী করে? আমাদের তো ধারণা ছিটিয়ে ছিল। আমাদের অন্য এক আশঙ্কার ওপর থুতু ছিটানো হয়েছে বইকি। আশঙ্কা ছিল লুটতরাজ হবে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধবে, ভীষণ গোলযোগ দেখা দেবে পথে পথে, মোড়ে মোড়ে; সংকট সৃষ্টি হবে আইন ও শৃঙ্খলার। হয়েছেও তাই। সাজানো বাগান যেমন তছনছ হয় তেমনি। তারা এসেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং চলে গেছে। তাদের আসার আগের ঢাকা ও পরের ঢাকা এক নয়। কিন্তু সেটা গোলযোগের দিক থেকে নয় একেবারেই। যে-জনতা যুদ্ধ করে, সেই জনতাই যে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারে, তা প্রমাণ হয়েছে উনসত্তরে, একাত্তরে। বিশেষভাবে তাঁদের জন্য যাঁরা জনতার ক্ষমতায় আস্থা রাখেন না, কেবলই বোঝা দেখেন, শক্তি দেখেন না। এও বোঝা গেল যে ল অ্যান্ড অর্ডার সমস্যা তখনই সমস্যা হয়ে দেখা দেয়, যখন অর্ডারটা আসে ওপর থেকে। এবং যখন উসকানিদাতারা তৎপর থাকে জনতার মধ্যে লুকিয়ে। নইলে শৃঙ্খলা কাকে বলে জনতা তা দেখাতে পারে—যদি ঐক্য থাকে লক্ষ্যের ও উদ্দেশ্যের, যেমন ছিল উনসত্তরের অভ্যুত্থানে।
মফস্বলের মানুষ মফস্বলে চলে গেল, কেবল জানিয়ে গেল তারা আছে, জানান দিল তারা কী চায় এবং কী চায় না। এসব খবর সব সময়ে রাখা হয় না, শাসকেরা রাখে না, যারা সরাসরি শাসক নয়, অথচ শাসকেরা আছে বলেই করেকম্মে খাচ্ছে, তারাও রাখে না। মফস্বলে কী ঘটছে তার খবর বড় একটা আসে না খবরের কাগজেও। অথচ সেখানেই অধিকাংশ মানুষ থাকে এ দেশের।
জনতার আগুন ভিন্ন আগুন। জ্বালায়, কিন্তু লুট করে না। এ হচ্ছে সে আগুন, গ্রিক উপকথার দেবতারা যেটি মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, পাছে মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে। সেই আগুন, যা প্রমিথিউস চুরি করে মানুষকে এনে দিয়েছিলেন, দিয়ে শাস্তি পেয়েছিলেন। পাহাড়ে ঝুলিয়ে ইগল পাখি লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর ওপর। এ আগুনে সভ্যতার চাকা তৈরি হয়। এ আগুন লুণ্ঠনও করে না, আবার ক্ষমাও করে না।
লুণ্ঠন হয়েছে। একাত্তরেও হয়েছে। পাকিস্তানিরা করেছে। তাদের দোসরেরা করেছে। মুক্ত এলাকায় সব মানুষ মুক্ত ছিলেন, রাতের দরজা-জানালা খুলে ঘুমাতেন। চোর-ডাকাত ছিল না, ভূত-প্রেত ছিল না। কেউ ঘুষ খায়নি, কেউ ঘুষ দেয়নি। তারপর! পরের কাহিনি ভিন্ন কাহিনি। আশা হতাশায় পরিণত হওয়ার কাহিনি, যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বলে, প্রতিটি দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। প্রশ্ন হলো—প্রশাসন কি সেই সংঘাতের দিকে এগোতে চায়, নাকি একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়?
৪২ মিনিট আগেমনজিল মোরসেদ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তিনি ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (এইচআরপিবি)-এর প্রেসিডেন্ট। জনস্বার্থে এ পর্যন্ত তিনি ২২৫টির বেশি মামলা করে মানবাধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই দ্রুত নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকার যাতে বেশি দিন ক্ষমতায় না থাকে, সে বিষয়ে সোচ্চার বিএনপি। এমনকি সরকার যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোও নির্বাচিত সরকার ছাড়া বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে দলটি মনে করে।
১৪ ঘণ্টা আগেজয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলায় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটেছে, সে ঘটনায় আর যাই হোক আক্কেলের কোনো পরিচয় দেখা যাচ্ছে না। সোজা কথায়, এটা বেআক্কেলি কর্মকাণ্ড। জয়পুরহাট ও রংপুরের নারী ফুটবল দলের মধ্যে ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়েছিল ২৯ জানুয়ারি।
১৪ ঘণ্টা আগে