Ajker Patrika

শিঙাড়া

রাজীব কুমার সাহা
শিঙাড়া

আমাদের যাপিত জীবনে অন্যতম মুখরোচক একটি খাবার হলো শিঙাড়া। বন্ধুবান্ধবদের বিকেল-সন্ধ্যার আড্ডা থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়নে শিঙাড়ার জুড়ি মেলা ভার। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় বিচিত্র রকমের সুস্বাদু শিঙাড়া আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, শিঙাড়া কীভাবে আমাদের এমন পছন্দের মুখরোচক খাদ্যবস্তু হয়ে উঠল? কীভাবে শিঙাড়া আমাদের জলখাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠল? পাশাপাশি এ-ও জানা দরকার, আকৃতিগত দিক থেকে এটি তিনটি কোনাবিশিষ্ট কেন?

শিঙাড়া বাংলা শব্দ। এটি তৎসম শব্দ ‘শৃঙ্গাটক’ থেকে বাংলায় এসেছে। এটি বিশেষ্য পদ। অভিধানে শিঙাড়া শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। দুটি অর্থই ভোজ্য অর্থাৎ খাওয়ার যোগ্য। শিঙাড়া বলতে আমরা বুঝি মসলা মেশানো আলু, কপি প্রভৃতির পুর দিয়ে ময়দার তৈরি তেকোনা তেলে ভাজা খাদ্যবস্তুবিশেষ। আর অপর অর্থটি হলো পানিফল অর্থাৎ তিন দিকে তিনটি কাঁটাযুক্ত জলজ ফলবিশেষকে আমরা শিঙাড়া নামে চিনি। এর কাঁটাগুলো দেখতে শিংয়ের মতো। শিঙাড়ার সঙ্গে এই ফলের আকৃতিগত সাদৃশ্য থাকায় প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে শিঙাড়াকে ‘শৃঙ্গাটক’ বলে উল্লেখ করা হতো। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ শিঙাড়ার অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘পানীফলের মত ময়দার ঘৃত পক্ক খাদ্য বিশেষ।’ আর জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গলা ভাষার অভিধান’-এ শিঙাড়ার অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘শৃঙ্গটিক ফল’। আবার ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে ‘ঘৃতে ভাজা পানিফলাকৃতি খাদ্য বিশেষ’।

দশম শতকের ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বেহাগি তাঁর ‘তারিখ-ই-বেহাগি’ গ্রন্থে প্রথম ‘সাম্বুসাক’ খাবারটির কথা উল্লেখ করেন। ১৩ শতকে আমির খসরুর লেখায় পাওয়া যায়, দিল্লির অভিজাত মুসলিমদের খাদ্যতালিকায় খুব প্রিয় খাবার হিসেবে যে ‘সামোসা’র উল্লেখ করা হয়েছে তা তৈরি হতো মাংস ও পেঁয়াজ দিয়ে ঘিয়ে ভেজে। ইবনে বতুতার লেখা থেকে জানা যায়, তখন মাংসের কিমা অ্যামন্ড, আখরোট, পেস্তা বাটা, পেঁয়াজ ও মসলা সহযোগে কষে ময়দার মোড়কে পুরে দেওয়া হতো। তিনি অবশ্য খাবারটির নাম লিখেছিলেন ‘সামসুক’। তাঁর বর্ণনা থেকে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভায় ‘সামসুক’ পরিবেশনের বিষয়টি জানা যায়। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে একইভাবে তৈরি করা খাদ্যটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সানবুসা’। ষোল শতকের ভারতীয় রন্ধনপুস্তক ‘নিমতনামা-ই-নাসিরুদ্দিন-শাহি’-তেও ‘সানবুসা’ পরিবেশনের সুনিপুণ চিত্র রয়েছে। ‘সাম্বুসাক’ বা ‘সামোসা’ বা ‘সামসুক’ বা ‘সানবুসা’-ই হলো সোজা বাংলায় আমরা যাকে সমুচা নামে চিনি। উল্লিখিত নামগুলো থেকেই স্থান এবং সময় ভেদে সমুচা বা বাঙালির শিঙাড়ার চল যার অন্যতম কারণ আকৃতিগত সাদৃশ্য। পাশাপাশি উল্লেখ্য যে, পর্তুগিজরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে আলু চাষ শুরু করে আনুমানিক ১৭ শতকে। ধারণা করা হয়, সে সময় ভারতের পশ্চিম উপকূলের নিরামিষাশী মানুষ মাংসের পুরের বদলে আলু দিয়ে সমুচা বানানো শুরু করে। এতে সমুচার আসল আকার কিছুটা বদলে গিয়ে পানিফলের রূপ নেয়। সেই থেকে আলুর পুর ভরা সমুচা হয়ে যায় শিঙাড়া।

শিঙাড়ার জন্ম নিয়ে প্রচলিত আরেকটি কাহিনি হলো, ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় সে সময় রাজ-হালুইকর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠ পুত্র গিরিধারী হালুইকর। কথিত রয়েছে, তাঁর স্ত্রী ধরিত্রী দেবী শিঙাড়ার আদি রন্ধনশিল্পী। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে একটি গল্প। একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজ-হালুইকরের বানানো লুচি খেয়ে বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। কারণ লুচি নেতানো, আহারে তিনি এর কোনো স্বাদ পেলেন না। নির্দেশ দিলেন হালুইকরকে রাজ্য ছাড়ার। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এই সময় একটা বুদ্ধি করলেন। রাজদরবারে গিয়ে বললেন, সুযোগ পেলে সে এমন লুচি-তরকারি রান্না করে খাওয়াতে পারবেন যা অনেক সময়ব্যাপী গরম থাকবে। এমনকি ভাজার সঙ্গে সঙ্গে খেলে জিভ পর্যন্ত পুড়ে যেতে পারে। এই ভেবেই তিনি তৈরি করলেন তিন পাটে ময়দার খোলস করে তার মধ্যে পুর ভরে ফুটন্ত তেলে ভাজা এই খাদ্যবস্তু। এই খাবার খেয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শেষমেশ খুশি হয়ে হালুইকরের শাস্তি বাতিল করেন এবং ধরিত্রী দেবীকে মুক্তার মালা উপহার দেন। কথিত রয়েছে, এই থেকেই এমন ত্রিকোনাকৃতির শিঙাড়ার প্রচলন হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে রুচিভেদে শিঙাড়ার বহুমুখী বিবর্তন সাধিত হয়েছে। মাংসের শিঙাড়া, ফুলকপির শিঙাড়া, কলিজার শিঙাড়া, পনিরের শিঙাড়া, ক্ষীরের শিঙাড়া প্রভৃতি নানা স্বাদের শিঙাড়ার প্রচলন থাকলেও আলুর পুর দেওয়া শিঙাড়াই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তবে শিঙাড়ার পুর কিংবা নাম যা-ই হোক না কেন, পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই শিঙ্গাড়ার আকার কিন্তু বর্তমানে এক রকমই—ত্রিকোনাকৃতি। আর তার পেটের মধ্যে ভরা থাকে সুস্বাদু পুর। ধারণা করা হয়, শিঙাড়ায় পুর ভরার সুবিধার জন্য এটিকে গোল বা লম্বা আকৃতির না করে তিন কোনাবিশিষ্ট করা হয়েছিল।

লেখক:–আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা মামলার আসামি দুই ভাই নেত্রকোনায় গ্রেপ্তার

পাওনা টাকা চাওয়ায় ব্যবসায়ীকে মারধরের পর বললেন, ‘আমি যুবদলের সভাপতি, জানস?’

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

গণভবনকে বাস্তিল দুর্গের সঙ্গে তুলনা করলেন ফরাসি রাষ্ট্রদূত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত