Ajker Patrika

বিদেশি অনুষ্ঠান সম্প্রচারে আইন ও ক্লিন ফিড

মামুনুর রশীদ
বিদেশি অনুষ্ঠান সম্প্রচারে আইন ও ক্লিন ফিড

সরকার সম্প্রতি বিদেশি চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন থেকে বিজ্ঞাপনমুক্ত ক্লিন ফিড (টেলিভিশনে কোনো অতিরিক্ত গ্রাফিকস, ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞাপনবিহীন কনটেন্ট সম্প্রচার করাই হলো ক্লিন ফিড।) প্রচার করা যাবে, কিন্তু বিজ্ঞাপনসহ কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। এ নিয়ে কেব্‌ল অপারেটররা আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। বাংলাদেশে বহু বছর যাবৎ বিদেশি চ্যানেলের অবিরাম প্রচার চলছে। এই বিদেশি চ্যানেলের প্রচারের ব্যাপারে ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। আইনটি আন্তর্জাতিক সম্প্রচার নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছিল। যেহেতু বাংলাদেশ টেলিভিশন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থার সঙ্গে নানাভাবে সংযুক্ত, তাই সেসব বিবেচনায় আইনটি অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করা হয়েছিল।

সেই ২০০৬ সাল থেকে আইনটির লঙ্ঘনও পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং যখন দেখা গেল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী নানান কার্যক্রম করতে যাচ্ছে, তখন ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে চ্যানেল মালিক, প্রযোজক, নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফেডারেশন অব টিভি প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের (এফটিপিও) নেতৃত্বে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের পর সরকার ডাবিং সিরিয়াল ও ক্লিন ফিডের ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি কমিটিও গঠন করে।

কমিটির প্রধান ছিলেন তদানীন্তন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হারুনুর রশীদ এবং সদস্যদের মধ্যে ছিলেন এফটিপি এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (এটিসিও) সদস্যরা। কমিটি খুব দ্রুতই এ বিষয়ে একটি সুপারিশমালা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করে। এর মধ্যে ২০০৬ সালের কেব্‌ল নেটওয়ার্ক আইন সামনে রেখে প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে নানাবিধ বিষয়ে আলাপ-আলোচনাও হয় এবং বর্তমানে সরকার বিষয়গুলো উপলব্ধি করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গত দুই বছর যাবৎ এ বিষয়ে কেব্‌ল অপারেটরদের ক্লিন ফিড দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়েই সরকার ক্লিন ফিডের জন্য অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করেছে।

বাংলাদেশের দর্শকেরা  কেব্‌ল মালিকদের প্রতি মাসে একটি টাকা দিয়ে থাকে। এই টাকার মধ্যেই বিদেশি অনুষ্ঠানের চ্যানেল মালিকদের অর্থ যুক্ত থাকে। তার মানে, অনুষ্ঠানগুলো দেখার জন্য বিনা মূল্যে কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদেশি চ্যানেল মালিকদের সেদেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের মানে হচ্ছে দুই রকম—একটি হচ্ছে বিদেশে অনুষ্ঠান প্রচার করে বিজ্ঞাপনের বাড়তি অর্থ উপার্জন এবং সেই দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজার তৈরি করা। এই বাজার তৈরি করতে গিয়ে আমাদের দেশের জাতীয় সংস্কৃতির ওপরও একটা প্রভাব ফেলে দেওয়া। ওই দেশের সংস্কৃতিতে যা কিছু সহজ-সাবলীল, তা আমাদের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে।

মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের আকাশ মুক্ত করা হয়, যেখানে বিবিসি সীমিত সময়ের জন্য অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে। বিবিসির সেই অনুষ্ঠান ছিল ক্লিন ফিড, কোনো বিজ্ঞাপন এর সঙ্গে যুক্ত হয়নি। এরপর একে একে বিদেশি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে সম্প্রচার শুরু করে। এরই মধ্যে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনসহ সম্প্রচার শুরু করায় ২০০৬ সালে এসে কেব্‌ল নেটওয়ার্কের জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়। ইতিমধ্যে ডিশ কানেকশন একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, শহরের পাড়া-মহল্লায় এবং ছোট শহর, এমনকি গ্রামেও ডিশ কানেকশন দেওয়া শুরু হয়। বিদেশি চ্যানেলগুলোর জন্য বাংলাদেশে এজেন্সি তৈরি হয়ে যায়। মোটামুটি কয়েক হাজার কোটি টাকার একটা ব্যবসা জমে ওঠে। ভারতীয় বিনোদন চ্যানেল, স্পোর্টস চ্যানেল এবং কিছু কিছু বিদেশি চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এদিকে বাংলাদেশে একের পর এক নতুন চ্যানেল আসতে থাকে, যারা অনুষ্ঠান বাবদ কেব্‌ল অপারেটরদের কাছ থেকে একটি টাকাও পায় না, সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয় বিজ্ঞাপনের ওপর। একটি অনুষ্ঠান প্রচার করতে হলে অনুষ্ঠানের মূল্য বাবদ প্রচুর বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয়। চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতাও তীব্র হতে থাকে, যার ফলে বিজ্ঞাপনের মূল্য ভীষণভাবে কমে যায়। দেখা যায় ২০ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানের জন্য ২০ মিনিটই বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে হয়। এই বিজ্ঞাপনের কাছে সবগুলো চ্যানেল সমর্পিত হওয়ায় দর্শক অনুষ্ঠান দেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চ্যানেলগুলোও খুব অল্প দামে অনুষ্ঠান ক্রয় করতে থাকে, অনুষ্ঠানের মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়ে যায়। বাজারে একটা কথা চালু হয়ে যায় যে, বাংলাদেশের অনুষ্ঠান কেউ দেখে না। ঈদের সময় প্রচুর অনুষ্ঠান নির্মিত হয়, সেখানেও প্রচুর বিজ্ঞাপন দেখা যায়। বহুবার পে-চ্যানেলের কথা এসেছে। পে-চ্যানেল হলে চ্যানেলগুলো দর্শকনির্ভর হতে পারত, বিজ্ঞাপনের চাপ কমে যেত। কিন্তু নানা কারণে পে-চ্যানেলের ব্যাপারে চ্যানেলগুলো আগ্রহ দেখায়নি।

প্রতিটি চ্যানেলই কোনো একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কালক্রমে করপোরেট সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে গেছে। এই ঢুকে যাওয়ার কারণে চ্যানেলটি কোনোমতে রক্ষা করাই তাদের কাছে প্রয়োজন। কোনো ধরনের মানসম্মত অনুষ্ঠান বা পেশাদারি এখানে তারা চাইছে না। আবার কেব্‌ল অপারেটররা বাংলাদেশের অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যাপারে তেমন যত্নও নিতে চায় না। অনুষ্ঠান দেখার সময় পর্দায় ঝিরঝির ভাব লেগেই থাকে। অথচ বিদেশি চ্যানেলগুলোর পর্দা যথেষ্ট ঝকঝকে। সবটা মিলিয়ে বর্তমান অবস্থায় ক্লিন ফিডের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এবং কেব্‌ল অপারেটররা ক্লিন ফিডের ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে।

বিদেশি সিরিয়াল দেখার ব্যাপারে দর্শকও টেলিভিশন সেট বন্ধ করে বসে আছে, কেউ কেউ ইউটিউবে দেখার চেষ্টা করছে। এই দর্শক যদি টেলিভিশনের বদলে ইউটিউবে অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করে, তাহলে টেলিভিশন মারফত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করাটা একটা পর্যায়ে অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। কাজেই বিদেশি চ্যানেল মালিকদের ঝুঁকি কিন্তু কমছে না, বরং বাড়বে। ইতিমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওটিটির সুবিধা হচ্ছে, এটি যেকোনো সময় দেখা যায়। টেলিভিশনের টাইমলাইন অনুষ্ঠান দেখার অভ্যাস দিনদিন কমে আসছে। বস্তুত টেলিভিশন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঙ্গে টেলিভিশন তাল মিলিয়ে চলতে পারবে, তা অনিশ্চিত।

বাংলাদেশের দর্শকদের যদি ধরে রাখতে হয়, তাহলে সরকারের নির্দেশিত পথে ক্লিন ফিড চালু করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। বাংলাদেশের অনুষ্ঠান ভারতে প্রচার করা হয় না, কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি চ্যানেলেরই ইউটিউব স্টেশন আছে। তাই ভারতীয় দর্শক ইউটিউবের মাধ্যমে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান দেখে থাকে।

এই ইউটিউব ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আকাশ উন্মুক্ত করলেও একটা আইন বা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় স্বার্থে যেমন প্রতিটি দেশ তার শিল্প রক্ষা করার জন্য কিছু আইনকানুন প্রণয়ন করে, তেমনি বাংলাদেশও করে থাকে। এর মধ্যে আবার কখনো আইন লঙ্ঘনের হিড়িক লেগে যায়। আমলাতান্ত্রিক নমনীয়তা বিশৃঙ্খলা এবং আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতার কারণে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারি না। ব্যবসায়ীরা এত বেশি বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেন এবং পার পেয়ে যান, যা হরহামেশা আমরা আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাই। ক্লিন ফিডের বিষয়টি হয়তো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না বা বুঝলেও একদল স্বার্থান্বেষী তাদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করবে।

এসব অতিক্রম করতে পারে সরকারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি। রাষ্ট্রের ভেতরে এসব সুবিধাভোগী বিভ্রান্তকারীদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করার জন্যও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করে যাঁরাই এই সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরাও যেন কোনো কারণে বিভ্রান্ত না হন। বাংলাদেশের চ্যানেল মালিকদেরও উন্নতমানের অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৩০-৪০ হাজার টাকার অনুষ্ঠান দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে গেলে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। একজন স্পনসর আমাকে বলেছেন, ১০ টাকার জিনিস আমি ১০ টাকা দিয়েই কিনব, ৫০ টাকার জিনিস ৫০ টাকা দিয়েই কিনব, কিন্তু ১০ টাকার জিনিস আমি ৫০ টাকা দিয়ে কিনব না। এসব বিবেচনায় আশা করি অবিলম্বে ক্লিন ফিডসহ মিডিয়া সম্প্রচারে যেসব অব্যবস্থাপনা আছে, সরকার সেগুলো দ্রুত দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

লেখক: মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখামাত্র পুতিনকে গ্রেপ্তারের আহ্বান

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

বরিশাল-৩ আসনে বিএনপির দুই হেভিওয়েট নেতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

ভূমি অফিসের কাণ্ড: এসি ল্যান্ড দপ্তরের নামে দেড় কোটি টাকা আদায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত