Ajker Patrika

রাজনীতির আদর্শিক দেউলিয়াত্বের স্বরূপ

মুজাহিদুল ইসলাম মাহির
রাজনীতির আদর্শিক দেউলিয়াত্বের স্বরূপ

ন্যায়বিচার, সংস্কার ও বৈষম্য বিলোপের দাবি থেকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের অনেকেই অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) নেতার উন্মুক্ত চাঁদাবাজির ঘটনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ ছাড়া সদ্য গঠিত গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল এনসিপি নেতাদের কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অনৈতিক রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগের রোষানলে পড়ে নির্যাতনের শিকার দেশের বৃহত্তম দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অপরাধকর্মের অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির হাতে দেড় শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটা যেন আসন্ন ফ্যাসিবাদের আতঙ্ক জাগায় মনে।

সম্প্রতি সংঘটিত চাঁদাবাজি-কাণ্ডে আটক হন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের পাঁচ নেতা। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজি করার অভিযোগে তাঁদের আটক করা হয়। প্রথমবার ১০ লাখ টাকা নেওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও টাকা নিতে এলে আটক হন তাঁরা। ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির এ ঘটনায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন বাগছাসের শীর্ষ নেতা আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদ, জানে আলম অপুসহ কয়েকজন।

সারা দেশে আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে, সমন্বয়ক পরিচয়ে, সংগঠক পরিচয়ে, রাজনৈতিক নেতা পরিচয়ে চাঁদাবাজি, জুলুম, নির্যাতন, আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা ঘটছে অহরহ। কিন্তু এসব ঘটনা কি নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের ফল? আমরা ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখতে পাই এসব ঘটনা শুধু কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর মেরুকরণ ও স্ট্রাকচারাল প্যাটার্নকেই ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতি দ্বিধারবিশিষ্ট ছুরির মতো। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ চব্বিশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে ছাত্ররা। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাদের অনেককেই সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরূপে দেখা গেছে। দুর্নীতি, পেশিশক্তির ব্যবহারসহ সব অন্যায়, অবিচারের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে ছাত্রদের একাংশ। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে মুজিব বাহিনীর হাতে খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি তার অন্যতম উদাহরণ।

চব্বিশের আন্দোলনের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক উমামা ফাতেমা গুলশানের চাঁদাবাজি-কাণ্ডের পর সংগঠনের অভ্যন্তরীণ হয়রানি, হুমকি, বলপ্রয়োগ, চাঁদাবাজিসহ প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সামনে তুলে ধরেছেন এবং ওই প্ল্যাটফর্মকে ‘মানি মেকিং এন্টারপ্রাইজ’ আখ্যা দিয়েছেন।

সংস্কার, পরিবর্তন, ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন কীভাবে মানি মেকিং এন্টারপ্রাইজে পরিণত হয়, তা বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের তৃণমূলের রাজনীতির ইতিহাসে চোখ বুলানো প্রয়োজন। তৃণমূলের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশই রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। শুধু তৃণমূলই নয়, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বড় একটি অংশের রাজনীতি ভিন্ন কোনো পেশা নেই বা অর্থনৈতিক উৎস নেই। ফলে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত অর্থের জোগান দিতেই রাজনীতি হয়ে পড়ে শাসন-শোষণের হাতিয়ার। শুরু হয় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারের নামে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন। অন্যায় জনপরিসরে প্রকাশিত হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের মাধ্যমে চোখে ধুলা দেওয়া হয়। কিন্তু আদতে সত্যিকারের সংস্কার কোনো দলের কার্যবিধিতে গুরুত্ব পায় না। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিচারের আওতামুক্ত রাখা হয় সব অপকর্মের হোতাদের।

রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের হোতাদের যখন অসীম ক্ষমতায়িত করা হয়; প্রশাসন, পুলিশের থানায় যখন তাদের বাধাহীন প্রবেশাধিকার থাকে, তখন একজন আদর্শহীন অপরাধী চক্রের হোতা যে রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলবে—তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চব্বিশের আন্দোলন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসে বীরত্বের মাইলফলক নাকি কলঙ্কিত স্মারক হিসেবে থাকবে, তা নির্ভর করছে জনগণের ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ওপর। সত্যিকার অর্থে নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক আমূল পরিবর্তন ছাড়া ক্ষমতার হাতবদল শুধু আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ও নব্য ফ্যাসিবাদেরই জন্ম দিতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখামাত্র পুতিনকে গ্রেপ্তারের আহ্বান

যুবককে আটক করা নিয়ে বিজিবি ও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি দাবি

বরিশাল-৩ আসনে বিএনপির দুই হেভিওয়েট নেতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

‘তেলের ক্রেতা’ হিসেবে ভারতকে আর পাবে না রাশিয়া, জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

বরখাস্ত সৈনিককে অস্ত্র দিয়েছেন বিএনপি নেতা, অডিও নিয়ে তোলপাড়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত