Ajker Patrika

বিলুপ্ত হওয়া গাছগুলো কি আর ফিরে আসবে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
তালিপাম নামের সে গাছটিতে যখন ফল ধরল তখন হা রে হা রে রব উঠল পরিবেশবাদীদের কণ্ঠে, হায় হায় হায়—পৃথিবী থেকে কি তাহলে চিরতরে হারিয়ে যাবে তালিপাম। ছবি: সংগৃহীত
তালিপাম নামের সে গাছটিতে যখন ফল ধরল তখন হা রে হা রে রব উঠল পরিবেশবাদীদের কণ্ঠে, হায় হায় হায়—পৃথিবী থেকে কি তাহলে চিরতরে হারিয়ে যাবে তালিপাম। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর ঘূর্ণন চক্রের সঙ্গে সঙ্গে সবই ঘোরে, কালের চক্রও। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে আবির্ভাব যেমন ঘটছে বা আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রজাতির জীব, তেমনি এ গ্রহের বুক থেকে তাদের কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন বিলুপ্তি। একসময় পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াত যে ডাইনোসর, তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত অর্থ হলো কোনো জীব প্রজাতির সর্বশেষ সদস্যটির মৃত্যু বা বিলোপ। অর্থাৎ সে প্রজাতির আর কোনো জীব যখন এ পৃথিবীর কোথাও আর থাকে না বা পাওয়া যায় না, তখন তাকে বিলুপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। এ রকম একটি উদ্ভিদ প্রজাতি ছিল আমাদের দেশে, যেটির সর্বশেষ সদস্য বা গাছটি বেঁচে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে গাছে প্রায় শত বছর পর জীবনে একবারই ফুল ফোটে। ফুল ফোটার পর তাতে ফল ধরে, এরপর গাছটি মারা যায়। তালিপাম নামের সে গাছটিতে যখন ফল ধরল তখন হা রে হা রে রব উঠল পরিবেশবাদীদের কণ্ঠে, হায় হায় হায়—পৃথিবী থেকে কি তাহলে চিরতরে হারিয়ে যাবে তালিপাম?

তালিপামের বংশরক্ষায় এগিয়ে এলেন পরিবেশবাদীরা। মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক ড. আখতারুজ্জামান চৌধুরী ২০১০ সালে সে গাছের পাকা বীজ সংগ্রহ করে তা থেকে তালিপামের চারা তৈরি করতে সক্ষম হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ভবনের মালি জাহাঙ্গীর আলমও সে তালিপাম গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করেন। অবশেষে তাঁদের প্রচেষ্টায় রক্ষা পেল সে প্রজাতির গাছটি। এখন সারা দেশে তার প্রায় ৩০০ গাছ বিভিন্ন স্থানে লাগানো হয়েছে। এ গাছগুলো একই বছরে লাগানো হয়েছে। তাই গাছগুলো নিয়ে আবারও শঙ্কার যে বিষয়টি রয়ে গেছে, ভবিষ্যতে যদি সেসব গাছে একই সময়ে বা একই বছরে ফুল ফোটে, তাহলে সবগুলো গাছ আবার একই বছরে মারা যাবে না তো? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি পরিবেশবাদী না হয় বা রক্ষায় সচেষ্ট না হয় তাহলে সেসব গাছও বিলুপ্তির ঝুঁকিতে চলে যেতে পারে।

বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, বাংলাদেশে আছে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থে বাংলাদেশের ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা রয়েছে। ধারণা করা হয়, আবাসস্থল ধ্বংস ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে বাংলাদেশে ৮ থেকে ১০ শতাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশের ১ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করে সেগুলোর স্ট্যাটাস প্রদান করেছে ও বৃহৎ দুটি খণ্ডে বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা প্রকাশ করেছে। সে মূল্যায়নে ২৭১ প্রজাতির উদ্ভিদকে ন্যূনতম উদ্বেগজনক প্রজাতি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এসব প্রজাতির উদ্ভিদগুলো নিয়ে আপাতত আশঙ্কার কোনো কারণ নেই, ওগুলো এ দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে নেই। কিন্তু ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদকে চিহ্নিত করা হয়েছে সম্মিলিতভাবে বিলুপ্তির হুমকিগ্রস্ত হিসেবে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে মহাবিপন্ন ও ১২৭ প্রজাতি রয়েছে বিপন্ন অবস্থায়। ইতিমধ্যে সাতটি প্রজাতির উদ্ভিদ এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এগুলো হলো ফ্যাবেসি গোত্রের কুরা জিরি, ম্যাগনোলিয়েসি গোত্রের ম্যাগনোলিয়া, মিরিকেসি গোত্রের সুফি বা সাতসারিলা, মেলোস্টোমেটাসি গোত্রের গোলা অঞ্জন, পুত্রঞ্জীভেসি গোত্রের ড্রাইপেটিস ভেনাসটা ও মির্টেসি গোত্রের জামজাতীয় সিজাইজিয়াম ভেনাস্টাম। বন্য অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়েছে তালিপাম।

যতদূর জানা যায়, ম্যাগনোলিয়া গ্রিফিতি প্রজাতির গাছ এই বাংলারই গাছ, এ গাছের জন্মস্থান বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারত। বাংলাদেশ থেকে এ প্রজাতির গাছ হারিয়ে গেলেও জন্মস্থান বা পৃথিবীর অন্য কোথাও না কোথাও সে গাছ থাকতে পারে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের চ্যাংগল্যাং, তাওয়াং ও লোহিত জেলায় এ গাছ রয়েছে বলে জানা গেছে। সেসব দেশের উদ্ভিদবিদদের সহায়তায় বা দুই দেশের ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম যদি পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সে গাছের অনুসন্ধান ও চারা উৎপাদন করতে সম্মত হয়, তাহলে সে চারা এ দেশে এনে এই প্রজাতিটিকে ফিরিয়ে আনা যায়। একইভাবে সেই প্রক্রিয়া অন্যান্য বিলুপ্ত প্রজাতি রক্ষার বেলাতেও হতে পারে।

বিপন্নের তালিকায় থাকা প্রজাতির গাছগুলোকে রক্ষার এখনই মোক্ষম সময়। সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই সেসব গাছ যেটি যেখানে আছে, সেটি আইনের মাধ্যমে সংরক্ষিত প্রজাতির গাছ হিসেবে সরকারকেই ইন সিটু পদ্ধতিতে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। সেসব গাছ থেকে বীজ বা স্পোর সংগ্রহ করে চারা উৎপাদনের দ্বারা এক্স সিটু পদ্ধতিতে সেগুলো দেশের বিভিন্ন সংরক্ষিত এলাকা, উদ্যান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে। বীজ ছাড়া ক্লোনিং বা টিস্যু কালচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রজাতির উদ্ভিদকে রক্ষা করা যেতে পারে। তবে সেগুলো ছড়ানোর আগে সেসব প্রজাতির গাছপালা যেখানে যে পরিবেশে আছে, সে পরিবেশকেও রক্ষা করতে হবে। যে উদ্ভিদ প্রজাতির বীজ থেকে অঙ্কুর গজানো, ডালপালা মেলা, ফুল-ফল ও বীজ উৎপাদন করার জন্য যে ধরনের অনুকূল পরিবেশ লাগে, সেখানে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভিদের ব্যাপকহারে বিপন্নের ঝুঁকির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণই হলো তার আবাসস্থল ধ্বংস। লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনে পৃথিবীর উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর বংশগত নমুনা সংরক্ষণের জন্য যেরূপ সংরক্ষণাগার করা হয়েছে, দেশেও তেমন বীজব্যাংক গড়ে তোলা যায়। কিউ যদি কোনো প্রজাতির উদ্ভিদের কৌলিকণা লাখ লাখ বছর ধরে সংরক্ষণ করতে পারে, তাহলে আমরা কেন শত শত বছরের জন্য পারব না? এর বড় সুবিধা হলো যখনই কোনো উদ্ভিদ প্রজাতি চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছাবে, সে প্রজাতি তার বংশধর উৎপাদনে অক্ষম হবে, তখনই জার্মপ্লাজম ব্যাংক বা বীজব্যাংক থেকে বীজ অথবা স্পোর বের করে তার চারা তৈরির মাধ্যমে প্রজাতি রক্ষা করা হবে। অসুবিধা হলো, এর জন্য অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ কর্মী ও অবকাঠামো দরকার।

এ দেশের বিপন্ন গাছগুলো সংরক্ষণের যথাযথ পদক্ষেপ বা প্রকল্প না নিলে এই ১৩২ প্রজাতির গাছও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। একটি প্রজাতির বিলুপ্তি মানে শুধু সে গাছটিকেই হারিয়ে ফেলা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা হারাচ্ছি সে প্রজাতির সঙ্গে অন্য যেসব জীবের সম্পর্ক রয়েছে, তাদেরও। গবেষকেরা দেখেছেন যে এ গ্রহের বুক থেকে যেকোনো একটি প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাওয়া মানে তার ওপর নির্ভরশীল অন্তত ৩০ প্রজাতির জীবের জীবন হুমকির মধ্যে পড়া। একটি প্রজাতির গাছ হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো সে উদ্ভিদের বিবর্তনের ইতিহাস মুছে ফেলা। আমরা সে গাছের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কিছু পাতা, ডাল বা শিকড়কে হারাই না, বরং তার সঙ্গে হারাই তার বংশগত কৌলিসম্পদ বা জিনগুলোকেও। একটি গাছের ভেতরে শুধু জাইলেম-ফ্লোয়েম বা কোষ-কলাই নয়, তার ভেতর যে জীবনের রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, সে রহস্য আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনো জানতেই পারবে না। বুঝবে না সে প্রজাতির মধ্যে থাকা কোন প্রাণরাসায়নিক উপাদান মানুষের রোগ-চিকিৎসায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমনকি গাছের নিজেরও রোগ প্রতিরোধে তার ভেতরে কী শক্তি লুকিয়ে ছিল। কাজেই পৃথিবীর বুকে জন্মানো কোনো প্রজাতির গাছকেই অবহেলা করা বা তুচ্ছ ভাবার কোনো কারণ নেই। সে প্রজাতির গাছের একটি জিনই বদলে দিতে পারে মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্যের ভবিষ্যৎ, খুলে দিতে পারে উদ্ভিদ প্রজননের নতুন দিগন্ত।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত