Ajker Patrika

নতুন করে পাব বলে

জাহীদ রেজা নূর
সন্জীদা খাতুন
সন্জীদা খাতুন

আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে আপাকে স্মরণ করবে তাঁর স্পর্শ পাওয়া সংগঠনগুলো। ‘নতুন করে পাব বলে’—এই কটি শব্দে জড়ানো থাকবে সন্জীদা স্মরণ। যাঁরা পেয়েছে তাঁর প্রাণের স্পর্শ, তাঁরা আসবেন এখানে।

আমিও আজ তাঁকে নতুন করে পাব। তাঁর বিদেহী অস্তিত্বই থাকবে সম্বল, কিন্তু তাতে তাঁর স্পর্শটি থাকবে বলে তিনি থাকবেন মনের কাছাকাছি। কে না জানে, কারও মনের কাছে থাকা কিংবা কাউকে মনের কাছে রাখা কত কঠিন আজ! আপার ভালোবাসার বলয়টি এতই বড় যে, তাকে আর বলয় বলে মনেই হয় না। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি মিশে যান অস্তিত্বে। সেখানেই তাঁর জয়।

বলতে পারি, দীর্ঘ সময় ধরে আমি পেয়েছি তাঁর সস্নেহ প্রশ্রয়। তাঁর এমন কিছু ভাবনার সঙ্গী আমি, যার অনেকটাই এখন আর বলা যাবে না। তবে যেগুলো বলা যাবে, তারই কিছুটা প্রকাশ করব আজ।

একটা সময় ঘন ঘন ফোনে কথা হতো। কিংবা রাতে ফোন করে বলতেন, ‘সকালে আসবি।’

একদিন সকালে সোবহানবাগের বাড়ির লিফট থেকে নেমে শুনি হারমোনিয়ামের সুর। দোরঘণ্টি বাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম, হারমোনিয়ামটা গুছিয়ে রাখছেন। বললাম, ‘একটা গান করুন না!’

‘না, এখন আর নয়। আগে আসতে পারিসনি?’

আমি বরাবর যা করি, তাই করলাম। বকাটা মেনে নিলাম। একটা শব্দও উচ্চারণ করলাম না। আমি জানতাম, আমার এই মৌনতা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপার জন্য পীড়ন হয়ে উঠবে। নৈঃশব্দ কাটল আবার হারমোনিয়ামের সুরে। তখনো তিনি গুছিয়ে বসেননি। পরিপাটি হয়নি চুলগুলো, কপালে ছিল না টিপ, আটপৌরে শাড়ি পরেই শোনালেন গান।

দূর থেকে যাঁরা আপাকে দেখেছেন, তাঁরা শুধু তাঁর রাশভারী চেহারাটাই দেখেছেন। যাঁরা কাছে গেছেন, তাঁরা জানেন, স্নেহের সমুদ্র নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। অবগাহনেই কেবল মুক্তি ছিল।

একদিন অফিসে পৌঁছে দেখি তিনটা মিসড কল। তিনটাই তাঁর। খুবই কাঁচুমাচু হয়ে ফোন করলাম তাঁকে। আমার ওপর রাগ দেখাতে যেন না পারেন, তাই তড়িঘড়ি বললাম, ‘গাড়ি চালাচ্ছিলাম তো, তাই ফোন ধরতে পারিনি।’

তাঁর কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা। ‘তুই বলতো, আমি কি ভুল করেছিলাম?’

বুঝতে পারছিলাম না, কী নিয়ে কথা বলছেন। ‘কেন ভুল করবেন?’ না বুঝেই একটা অবস্থান নিয়ে নিই।

‘অপালাকে যখন লাইফ সাপোর্টে দিতে চাইল, তখন সবাই আমার মতামত চাইল। আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম। একবার মনে হলো, লাইফ সাপোর্টে দিলে তো বাঁচার একটা সম্ভাবনা থাকে। আরেকবার ভাবলাম, কেন ওকে কষ্ট দেব? ও কষ্ট পাচ্ছে কি না, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কৃত্রিমভাবে ওকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। আমি এই কথাই বলেছিলাম। বল তো, আমি কি ভুল করেছিলাম?’

বুঝলাম, জ্যেষ্ঠ সন্তান অপালার লাইফ সাপোর্টের বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি দ্বিধান্বিত। হঠাৎ করেই হয়তোবা প্রশ্নটা এসেছে তাঁর মাথায়। খচখচ করছে মন। এ কারণেই ফোন। বললাম, ‘আপনি একেবারে ঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছেন। এত দিন পর এসব নিয়ে ভাবছেন কেন?’

‘সত্যি বলছিস?’

‘আমার যা মনে হচ্ছে, সেটাই বললাম।’

স্বস্তি পেলেন। ছেড়ে দিলেন ফোন।

তিনি চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে মিলি আপা (ফওজিয়া মান্নান) আমাকে বললেন, ‘আপা যেতে বলেছেন। যাবি?’

নিশ্চয়ই যাব। একদিন বিকেলে যখন তাঁর কাছে গেলাম আমরা, তখন তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। জানালেন, এখন আর একা একা চলাফেরা করতে পারেন না। কারও সাহায্য ছাড়া উঠতে পারেন না। এ রকম জীবন উপভোগ করছেন না।

মিলি আপাকে একটা শাড়ি দেবেন বলেছিলেন আগে। সেটা রেখেছিলেন যত্ন করে। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় মিলি আপা সেটা নিতে পারেননি। একজন আপার কাছ থেকে দুটো শাড়ি নিয়েছিলেন, তারই একটা তিনি মিলি আপাকে দিয়েছিলেন। সে শাড়ি এখন মিলি আপার অমূল্য সম্পদ।

সেদিন কথা যা বলছিলেন, তাতে সেই আগের সন্জীদা আপাকেই পাওয়া যাচ্ছিল। শরীর দুর্বল হলেও মাথা ছিল আগের মতোই পরিষ্কার। আর সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, তিনি যে কষ্ট পাচ্ছেন, চোখে দেখছেন না, চলাফেরা করতে পারছেন না, তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই। বাইরের মানুষ তাঁর অসহায়ত্ব নিয়ে কথা বলুক, সেটা চাননি কখনই।

চিরকাল তিনি ছিলেন স্বাবলম্বী। কারও সাহায্য ছাড়াই পাড়ি দিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ পথ। নিজে যা বুঝেছেন, তা-ই করেছেন। উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেননি, কিন্তু তাঁর কথার দৃঢ়তা ও যুক্তির কাছে নতজানু হতো অন্যরা।

এখনো মনে পড়ে, কণ্ঠশীলনের এক পাঠচক্রে তিনি উচ্চারণ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তারপর একসময় কাউকে কাউকে ডেকে রবীন্দ্রনাথের ‘একটি চাউনি’ পড়তে বলেছিলেন। আমি পড়ার পর বলেছিলেন, ‘এভাবে পড়তে কে শিখিয়েছে তোকে?’

হেসে বলেছিলাম, ‘বহু আগে যিনি এভাবে পড়তে শিখিয়েছেন, তাঁর নাম ওয়াহিদুল হক।’

হেসেছিলেন তিনি।

অন্য অনেকের মতো আমিও আজ তাঁকে নতুন করে পাব। এবং বাজি রেখে বলতে পারি, আজ দিনের কোনো এক সময়ে হঠাৎ আমার মনে হবে, একটা ফোন এসেছে আমার। কেউ একজন বলছেন, ‘কিরে, ফোন করিস না কেন? মরে গেছিস নাকি?’

‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ই তো আপনাকে আমি পাই, আপা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত