Ajker Patrika

জাতীয় পার্টিতে আবার মালিকানা বিরোধ

আহমেদ শমসের
জাতীয় পার্টিতে আবার মালিকানা বিরোধ

জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলের তিন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে দল থেকে অপসারণ করেছেন। যাঁদের অপসারণ করা হয়েছে, তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁরা দলের চেয়ারম্যানের এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত মানবেন না। তাঁরা জাতীয় পার্টিতেই আছেন এবং থাকবেন। জাপার এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্ব-সংকট আবারও স্মরণ করিয়ে দিল যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ দলই ব্যক্তিনির্ভর, দলগুলোর গঠনতন্ত্র থাকলেও তার প্রয়োগে খামখেয়ালিপনার শেষ নেই এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চায় ন্যূনতম আগ্রহী নয় দলের নেতৃত্ব। পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। চুন্নুকে মহাসচিব পদ থেকে সরিয়ে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে।

ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে দলজুড়ে বিস্ফোরণ ঘটে। তিনজন নেতাই তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন এবং পাল্টা অভিযোগ করেন, পার্টির গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে, একক কর্তৃত্বে, স্বেচ্ছাচারীভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, প্রেসিডিয়ামের যে সভার কথা বলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটিতে কোরাম হয়নি এবং মহাসচিবের সম্মতি ছাড়াই সভা ডাকা হয়েছে, যা গঠনতন্ত্রের ২০(৩) (খ) ধারার লঙ্ঘন। এমনকি কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগ করেছেন, জি এম কাদের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে ‘রাতের অন্ধকারে’ জোরপূর্বক তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে দলের ‘ক্ষমতা’ দখল করেছিলেন এবং এখন দলের ভেতর কাউকে সহ্য করতে পারছেন না।

বহিষ্কৃত নেতারা শুধু সিদ্ধান্তের অনিয়ম নয়, ব্যক্তিগত আক্রমণও চালিয়েছেন। কেউ বলেছেন, জি এম কাদের মানসিকভাবে অসুস্থ, আবার কেউ বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে অযোগ্য। অভিযোগ করা হয়েছে, এই মানুষটি নিজের ভাইয়ের পরিচয় ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করতে পারেননি, অথচ আজ তিনি সবাইকে বাদ দিয়ে এককভাবে দল চালাতে চান। জাতীয় পার্টির এই সংকট অবশ্য নতুন নয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই একক নেতৃত্বের ধাঁচে দল পরিচালনা করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি প্রকট হয়ে উঠেছে, তা হলো নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা। রওশন এরশাদ বনাম জি এম কাদেরের দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে এখন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নুর মতো প্রবীণ, ত্যাগী নেতারাও চূড়ান্ত বিরোধিতার অবস্থানে চলে গেছেন।

এখানে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, যাঁরা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাঁরা কেউ রাজনীতিতে হঠাৎ আসা ব্যক্তি নন। তাঁরা তিন দশকের বেশি সময় ধরে দল গঠন, সাংগঠনিক তৎপরতা, জনসম্পৃক্ততা এবং মন্ত্রিত্বের মাধ্যমে দলের পরিচিতি বহন করেছেন। তাঁরা কেউই বলেননি যে তাঁরা ভিন্ন দল করতে চান, বরং বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। তাঁরা সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে মতবিনিময়ের পথ খুলতে বলেছেন। কিন্তু এসব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে দলীয় চেয়ার থেকে একক সিদ্ধান্তে বহিষ্কার চিঠি পাঠানো হয়েছে, যা কেবল নেতৃত্বের সংকীর্ণ মানসিকতা এবং দলে গঠনতান্ত্রিক চর্চার ঘাটতির প্রমাণ বহন করে। এরশাদের জীবদ্দশায় জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতা যতই সীমিত থাকুক, তিনি অন্তত সব পক্ষকে নিয়ে কোনো রকম ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা সেই ভারসাম্য রক্ষা তো করতে পারেনইনি বরং দলকে আরও খণ্ডবিখণ্ড ও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।

আজ জাতীয় পার্টি আর আদর্শভিত্তিক দল নয় (অবশ্য কখনোই সেটা ছিল না), বরং এটা নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিক লড়াইয়ে জর্জরিত এক রাজনৈতিক কাঠামো, যেখানে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের কথার কোনো মূল্য নেই, সম্মান নেই দলের ইতিহাসের। অথচ এই নেতারাই সেই সময়েও ছিলেন, যখন জাতীয় পার্টি ছিল অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত, ভোটবিহীন এবং তাঁরা লড়াই করে সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। আর এখন তাঁদের ‘প্রাথমিক সদস্যপদ’ পর্যন্ত বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে এক চিঠিতে, এক চেয়ারের ইচ্ছায়। বহিষ্কৃত নেতারা এই ঘটনায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ এবং আহত হয়েছেন, কেউ বলেছেন, ‘আপনার লাভ লেটার পেয়েছি’, কেউ বলেছেন, ‘এই আচরণ রাজনৈতিক নয়’, কেউ বলছেন, ‘দলটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’ আবার কেউ কেউ সরাসরি বলেছেন, ‘আপনি একা থাকবেন? একা তো ব্যবসা করা যায়, রাজনীতি নয়’।

জাতীয় পার্টির বর্তমান সংকট বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় পাঠের জায়গা। দল যখন কেবল নির্বাচনমুখী প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়, যখন রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি পূজাই প্রধান হয়ে ওঠে, তখন এমনটাই ঘটে। বাংলাদেশের অধিকাংশ দলই এই সংকটে আছে, তবে জাতীয় পার্টির সংকট সবচেয়ে প্রকট এই কারণে যে, এটি একসময় প্রধান বিরোধী দল ছিল এবং একসময় দেশের শাসক দলও ছিল। আজ সেই দল যদি প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের বের করে দেয়, যদি গণতন্ত্রচর্চার পরিবর্তে নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারী হয়, তাহলে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলা অবধারিত। দল ভাঙার, নতুন গ্রুপ তৈরির, বিকল্প নেতৃত্ব ঘোষণার যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা আর আটকানো যাবে না।

এই অবস্থায় জাতীয় পার্টির সামনে দুটি পথ খোলা। এক. সম্মেলনের মাধ্যমে সব পক্ষকে নিয়ে একটি নতুন সমঝোতা ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা; দুই. দলটিকে কার্যত ভাগ হয়ে যেতে দেওয়া। প্রথমটি একটি রাজনৈতিক দলে সুস্থতার ইঙ্গিত দিতে পারে, দ্বিতীয়টি তার পতনের দিকেই যাবে। রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, দল ভাঙা মানেই একসময় অস্তিত্ব সংকট। যারা দল গড়েছে, সেই মানুষগুলো যদি আজ একে ‘ব্যক্তিগত কোম্পানি’ বলে আখ্যায়িত করে, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সংকট দলীয় নয়, অস্তিত্বগত। আজ যদি জাতীয় পার্টি নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে চায়, তবে তাকে নেতৃত্বের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে, অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক, সম্মেলনভিত্তিক নেতৃত্ব পুনঃস্থাপন করতে হবে। তা না হলে, ইতিহাসে জাতীয় পার্টি বিলীন হওয়ার দিকেই দ্রুত এগিয়ে যাবে। নামে রাজনৈতিক দল হলেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার, মালিকানা বিরোধ জাতীয় পার্টির মতো দলগুলোকে কার্যত ‘নাই’ হওয়ার পথেই নিয়ে যাচ্ছে।

লেখক:–সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা মামলার আসামি দুই ভাই নেত্রকোনায় গ্রেপ্তার

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

‘নৌকা আউট, শাপলা ইন’, সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির চাওয়া

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

পাওনা টাকা চাওয়ায় ব্যবসায়ীকে মারধরের পর বললেন, ‘আমি যুবদলের সভাপতি, জানস?’

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত