Ajker Patrika

কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২২, ১১: ২৫
Thumbnail image

না, বুঝবে না, একের বেদনা অপরের পক্ষে বোঝা কোনো দিনই সহজ ছিল না; কিন্তু এখন এই পরিবর্তিত বিশ্বে সেটা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। বড় কারণ বিচ্ছিন্নতার বৃদ্ধি। বিশ্বজুড়েই এখন মানুষ তার সামাজিক সত্তাকে অবজ্ঞা করতে উৎসাহিত হচ্ছে। উৎসাহিত করছে শুধু ব্যক্তি নয়, আসলে গোটা ব্যবস্থাটাই। ব্যবস্থাটাই বলছে, বাঁচতে হলে নিজেরটা দেখো। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।

ওই যে বাংলা প্রবচন, ‘কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?’ তাতে তো এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে ব্যথিতরাই কেবল ব্যথিতের বেদনা বুঝবে; কালের অগ্রগতিতে এবং সভ্যতার উন্নতিতে ওই আশাতেও এখন বিস্তর বালু পড়েছে। ব্যথিতের সংখ্যা বেড়েছে। প্রত্যেকেই এখন ব্যথিত, কে কার অশ্রু মোছায়? অথচ পৃথিবীতে এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় প্রাচুর্য অধিক। কোথাও কোথাও তা উপচে পড়ছে। বাংলা প্রবচনটিতে সাপের বিষের উল্লেখ আছে। তা সাপ একসময় ভয়ংকর ছিল বৈকি, তার দংশন কেবল যে দুঃসহ ছিল তা নয়, দংশন এড়ানোও খুব সহজ ছিল না। এখন সাপ কমেছে, কিন্তু বিষের প্রাচুর্য অনেক অনেক গুণ বেড়ে গেছে। খাদ্য, বাতাস, পানি, মাটি, মানবিক সম্পর্ক—সবকিছুতেই বিষ রয়েছে জড়িয়ে-ছড়িয়ে। বিষের হাত থেকে বাঁচাটা সহজ নয়। দংশিত হলে চিকিৎসা হয়তো পাওয়া যাবে, তবে সমবেদনা পাওয়া কঠিন। সবকিছুই তো এখন পণ্যে পরিণত, সমবেদনাও কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু সে জিনিস খাঁটি নয়, ভেজাল বটে।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষের নাম হচ্ছে হতাশা। গোপনে গোপনে ছড়িয়ে পড়ে, ক্রমেই প্রবল হয়ে কাবু করে, ঠেলে দিতে পারে আত্মহত্যার দিকে। সবকিছুতে আস্থা হারানোটাও একধরনের আত্মহত্যাই। মানসিক আত্মহত্যা। পরবর্তী ও চরম স্তরটা হচ্ছে আত্মহনন, দৈহিকভাবে। যেসব সমাজে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে, সেখানেও দেখা যায় বিস্তর লোক আত্মহত্যা করে। যেমন সুইডেনে, জাপানে। তাদের মনেও হতাশা দেখা দেয়, তারা সৃষ্টিশীল কাজ পায় না খুঁজে। জীবন মনে হয় অর্থহীন, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। আশা নেই পরিবর্তনের। জীবনের বোঝা বহন করাটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। সহানুভূতি জানাবে এমন লোক পাওয়া যায় না। এটাও পুঁজিবাদী উন্নয়নের অবদান বৈকি।
বাংলাদেশেও বেশ ভালো রকমের উন্নতি হচ্ছে, তবে সেই উন্নতি অধিকাংশ মানুষকেই ভরসা দিচ্ছে না, হতাশা বাড়াচ্ছে। নিজেকে একাকী, নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতের কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। হতাশা বিশেষভাবে ভর করেছে কিশোর-কিশোরীদের ঘাড়ে। করোনা ব্যাপক হারে আঘাত করেছে গরিব মানুষকে তো বটেই, তরুণদেরও। তাদের মধ্যে মারাত্মক হতাশা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে। যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি। সাদিয়া তাবাসসুম নাম। বাড়ি ময়মনসিংহে। বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। সাদিয়ার মা সেদিন ঘরে ছিলেন না। বাবা গিয়েছিলেন একজনের জানাজায়। এই ফাঁকে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঘরের আড়ার সঙ্গে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে সাদিয়া। তার বাবার ডায়েরিতে সাদিয়ার নিজের হাতে লেখা পাওয়া গেছে, ‘চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন বেড়েই যাচ্ছে। মুক্তির পথ নাই। গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন। মেনে নিতে পারছি না।’ অসহায় এক তরুণীর করুণ আর্তনাদ।

সাদিয়ার সমবয়স্কা ডায়ানা হাবিব প্রাপ্তি নামের মেয়েটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। থাকত ঢাকার আদাবরে, জাপান গার্ডেন আবাসিক এলাকায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। ১৬ তলার ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন সে শেষ করে দিয়েছে। তার লেখা চিরকুট পাওয়া গেছে। তাতে সে জানিয়েছে, ব্যক্তিগত আবেগজনিত জটিলতার কারণে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সান্ত্বনাহীন দুঃসহ মনঃকষ্টে ভুগছিল। পরিবারের সদস্যদের প্রতি অভিমান ছিল তার। নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। মা-বাবা বা অন্য কাউকে সে খুশি করতে পারেনি। লিখেছে, সে জানে যে তার জন্য কোনো কিছুই থেমে থাকবে না। সহজেই পূর্ণ হয়ে যাবে। নিজেকে ভেবেছে সে সম্পূর্ণ একা। কেউ নেই আশপাশে।

এরা একা নয়। তাদের মতো বহু ছেলেমেয়েই খাপ খাওয়াতে পারছে না, মেনে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদেরই কেউ কেউ চরম হতাশায় নিক্ষিপ্ত হয়ে নিজের সবচেয়ে মূল্যবান যে সম্পদ নিজের প্রাণ, সেটাকেই হনন করছে। এমন ঘটনা আগেও ঘটত। কিন্তু এখন বেড়েছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ‘আঁচল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন গবেষণা করে এ রকমের ফল পেয়েছে যে গত এক বছরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০২ জন শিক্ষার্থী জীবনযন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আত্মহননের পথে চলে গেছে। সংখ্যাগুলো পরিসংখ্যানের অক্ষরের মতো প্রাণহীন, কিন্তু প্রতিটি সংখ্যার পেছনে তো একটি করে জীবন্ত প্রাণ ছিল। ছিল তার বেঁচে থাকার অধিকার। চেষ্টা করেছিল সে বাঁচতে।

উন্নয়নের অনুষঙ্গী হিসেবে এ ক্ষেত্রেও উন্নয়ন ঘটেছে। নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন ভাবছে যারা, তাদের জন্য আত্মহত্যার বুঝি ক্ষমতা প্রদর্শনের সহজপ্রাপ্য পথ। এর বাইরে সবটাই অন্ধকার। পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানুষকে মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত করছে না, সে কাজ তার চরিত্রবিরুদ্ধ। তার জন্য স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করা, সেটাই সে করছে। পুঁজিবাদের ভেতরে রয়েছে মুনাফালিপ্সা, যা সাপের বিষের চেয়ে বহু বহু গুণ মারাত্মক ও সর্বগ্রাসী।

আত্মহত্যা করেছে অঙ্কন বিশ্বাস। সে-ও ছাত্রী ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়; সেখানে ভর্তি হওয়াটা সহজ কাজ নয়। ভর্তির জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। অঙ্কন পড়ত ইংরেজি সাহিত্যে। অনার্স শেষ করেছে, মাস্টার্সে ছিল। ফল করেছিল ভালো। অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। ডিবেট করত টেলিভিশনে। বেশ নামডাক ছিল অঙ্কনের। সে-ও নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিয়েছে, নিজের হাতে। বিষ খেয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র শাকিলের সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। অঙ্কন তার মা-বাবার সঙ্গে থাকত, পরিবারকে না জানিয়ে সে বিয়ে করেছিল শাকিলকে, কোর্টে গিয়ে, বিধিসম্মত উপায়ে। শাকিল ইতিমধ্যে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। টের পেয়ে অঙ্কন গেছে শাকিলের বাসায়। সঙ্গে বিষ নিয়ে গিয়েছিল। কথা-কাটাকাটি হয়েছে। অঙ্কন বিষ খেয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে শাকিলই। অঙ্কন বাঁচেনি। কয়েক দিন পরে হাসপাতালেই মারা গেছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীএসব চরম ঘটনা। চরম ঘটনা ঘটলে তবেই জানাজানি হয়। তারপরে আবার যেই কে সেই; ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা। সংসার চলতে থাকে সংসারের মতোই। ডায়ানা হাবিব প্রাপ্তি নামের মেয়েটি মোটেই বাড়িয়ে বলেনি তার সুইসাইড নোটে।

একই সময়ের ঘটনা মানিকগঞ্জে। কিশোর নয়, মানুষটি ছিলেন একজন দন্তচিকিৎসক। নিজের হাতে স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানকে হত্যা করে উন্মাদের মতো ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা-আরিচা রোডে, গাড়ির নিচে পড়ে আত্মহত্যা করবেন বলে। পথের লোকজন ধরে নিয়ে পুলিশে দিয়েছে। দন্তচিকিৎসক ঋণগ্রস্ত ছিলেন। নাকি ১০ লাখ টাকা কর্জ করেছিলেন তিনি। ওদিকে আবার ভুল চিকিৎসার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এক নারী। সালিসে মীমাংসা হয়েছিল দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। ২০ হাজার দিয়েছিলেনও। আর দেওয়ার সক্ষমতা ছিল না তাঁর।

রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকায় একজন কৃষক বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন, সেচের পানি না পেয়ে। পানির সেখানে স্বল্পতা রয়েছে, যেটুকু পাওয়া যায় তাও নিয়ন্ত্রণে থাকে ধনী ব্যবসায়ীদের। অসহায় কৃষক কী করবেন? হতাশার বোঝা বহন অসহ্য হওয়ায় বিষপান করেছেন। মরে গিয়ে মুক্তি পেলেন হতাশার হাত থেকে।

সবচেয়ে উন্নত দেশ আমেরিকা। সেখানেও ব্যক্তিমানুষ নিরাপদে নেই। আত্মহত্যা আছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, রয়েছে বন্দুকে হত্যা। বিকারগ্রস্ত এক বন্দুকধারী স্কুলে ঢুকে একসঙ্গে ১৯টি শিশুকে হত্যা করেছে। দুজন শিক্ষককেও। এর পরপরই আরেক খবর। এবার হাসপাতালে। গুলিতে আততায়ীসহ মারা গেছে পাঁচজন। ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই খবর এসেছে দুজন নারীসহ তিনজন প্রাণ হারিয়েছে বন্দুক হামলার আরেক ঘটনায়। অকুস্থল এক গির্জা, যেখানে একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান চলছিল। শোকার্তের সংখ্যা বেড়েছে। দুই দিন পরের খবর। আমেরিকার তিন শহরে গোলাগুলি; নিহত নয়জন, আহত অনেকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত