রাজীব কুমার সাহা
বাংলা ভাষায় একটি অতি পরিচিত শব্দ হলো ‘জেরবার’। নানামুখী চাপে পড়ে জীবন-যৌবন জেরবার হওয়ার কথা আমরা কে না শুনেছি? এমনকি দূষণের কবলে পড়েও আমাদের জনজীবন জেরবার হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে দূষণ হোক বায়ু কিংবা ভাষার। নানারকম অসুবিধাজনক অবস্থায় পতিত হয়ে মনের ভাব প্রকাশে আমরা জেরবার শব্দের ওপর ভর করেছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এই জেরবার শব্দটি বাংলা ভাষায় কীভাবে এল? জেরবার কোন ভাষার শব্দ? এর প্রকৃত অর্থ কী? তবে চলুন আজ জানব জেরবার শব্দের ইতিবৃত্ত।
জেরবার বাংলা শব্দ নয়, এটি ফারসি শব্দ। আভিধানিকভাবে জেরবার শব্দের অর্থ হলো নাকাল; বিপর্যস্ত; বিধ্বস্ত; পরাস্ত; হীনবল; ক্ষতবিক্ষত; ভারাক্রান্ত, দুশ্চিন্তা বা পরিশ্রমে জর্জরিত এমন প্রভৃতি। এটি বিশেষণ পদ। সমাজভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, পূর্বে ভাষাভাষীরা যেকোনো ধরনের সমস্যা বা অসুবিধায় পতিত হলে পেরেশান, পেরেশানি, হয়রান, হয়রানি, জেরবার প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ভাষাবৈজ্ঞানিক বিবর্তন এবং বিশ্বায়নের ধারায় বর্তমানের শিক্ষিত সমাজ এ-জাতীয় শব্দ ব্যবহারে মনোযোগী নয়। তার পরিবর্তে তারা বহুবিচিত্র ইংরেজি শব্দে পারদর্শী। অনেক ক্ষেত্রে ‘বাংলিশ’ শব্দেও সমানভাবে পটু। যার ফলে জেরবার শব্দটির ব্যবহার সীমিত রূপে ভাষাভাষী সমাজে পরিলক্ষিত হয়।
ফারসি জের শব্দের অর্থ হলো আগের হিসাবের রেশ (আমরা যে অর্থে বলি, কাজের জের মেটানো বা হিসাবের জের টানা), অনুবৃত্তি; পরিণাম প্রভৃতি। কিন্তু স্মরণে রাখা ভালো, ফারসি জেরবার শব্দের সঙ্গে জের শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। ফারসি বাগধারা ‘জের ওয়াবার’ থেকেই বাংলায় এসেছে জেরবার। ফারসি জের শব্দের অর্থ হলো নিচে আর বার শব্দের অর্থ হলো বোঝা। অর্থাৎ জের ওয়াবার বাগধারার আক্ষরিক অর্থ হলো বোঝার নিচে চাপা পড়া। সুতরাং পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, যে ব্যক্তি বোঝার নিচে পতিত হয়েছেন তিনি আলংকারিক অর্থে কতটা বিপন্ন, বিধ্বস্ত এবং পর্যুদস্ত হতে পারেন।
‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ থেকে জানা যায় জেরবার শব্দটি প্রথম বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে ১৮৭৩ সালে ‘হেনস্থা’ অর্থে। ১৯১৯ সালে ‘হয়রান’ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন প্রমথ চৌধুরী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় জেরবার শব্দটি ‘পর্যুদস্ত’ বা ‘লাঞ্ছিত’ অর্থে পাই ১৯২২ সালে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে জেরবার শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে ঋণগ্রস্ত এবং নিপীড়িত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে জেরবার শব্দটির ব্যবহার করেছেন এভাবে, ‘এক ধারে একটিমাত্র নিমগাছ, তার গুঁড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে।’ জেরবার শব্দটি কবিগুরু তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যযাপনে এই একবারই লিখিতরূপে ব্যবহার করেছেন।
জেরবার শব্দটি প্রকৃত অর্থেই গণমানুষের অন্তরের শব্দ; গ্রামীণ জনপদের সহজ-সরল নিপীড়িত মানুষের অকপট ভাষ্য। কেননা শব্দটি ধ্বনিত হয় যাপিত জীবন থেকে উৎসারিত ক্ষোভ থেকে। আর এই ক্ষোভের কারণ শাসক কর্তৃক শোষিতের ওপর নিষ্পেষণ। কারও কারও মহাজনের দেনার দায়ে নিষ্পেষিত হতে হতে জীবন জেরবার আবার কেউ কেউ মামলা-মোকদ্দমার বেড়াজালে জেরবার। শব্দটি যেন নিষ্পেষিত গণমানুষের একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলা ভাষায় একটি অতি পরিচিত শব্দ হলো ‘জেরবার’। নানামুখী চাপে পড়ে জীবন-যৌবন জেরবার হওয়ার কথা আমরা কে না শুনেছি? এমনকি দূষণের কবলে পড়েও আমাদের জনজীবন জেরবার হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে দূষণ হোক বায়ু কিংবা ভাষার। নানারকম অসুবিধাজনক অবস্থায় পতিত হয়ে মনের ভাব প্রকাশে আমরা জেরবার শব্দের ওপর ভর করেছি। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এই জেরবার শব্দটি বাংলা ভাষায় কীভাবে এল? জেরবার কোন ভাষার শব্দ? এর প্রকৃত অর্থ কী? তবে চলুন আজ জানব জেরবার শব্দের ইতিবৃত্ত।
জেরবার বাংলা শব্দ নয়, এটি ফারসি শব্দ। আভিধানিকভাবে জেরবার শব্দের অর্থ হলো নাকাল; বিপর্যস্ত; বিধ্বস্ত; পরাস্ত; হীনবল; ক্ষতবিক্ষত; ভারাক্রান্ত, দুশ্চিন্তা বা পরিশ্রমে জর্জরিত এমন প্রভৃতি। এটি বিশেষণ পদ। সমাজভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, পূর্বে ভাষাভাষীরা যেকোনো ধরনের সমস্যা বা অসুবিধায় পতিত হলে পেরেশান, পেরেশানি, হয়রান, হয়রানি, জেরবার প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ভাষাবৈজ্ঞানিক বিবর্তন এবং বিশ্বায়নের ধারায় বর্তমানের শিক্ষিত সমাজ এ-জাতীয় শব্দ ব্যবহারে মনোযোগী নয়। তার পরিবর্তে তারা বহুবিচিত্র ইংরেজি শব্দে পারদর্শী। অনেক ক্ষেত্রে ‘বাংলিশ’ শব্দেও সমানভাবে পটু। যার ফলে জেরবার শব্দটির ব্যবহার সীমিত রূপে ভাষাভাষী সমাজে পরিলক্ষিত হয়।
ফারসি জের শব্দের অর্থ হলো আগের হিসাবের রেশ (আমরা যে অর্থে বলি, কাজের জের মেটানো বা হিসাবের জের টানা), অনুবৃত্তি; পরিণাম প্রভৃতি। কিন্তু স্মরণে রাখা ভালো, ফারসি জেরবার শব্দের সঙ্গে জের শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। ফারসি বাগধারা ‘জের ওয়াবার’ থেকেই বাংলায় এসেছে জেরবার। ফারসি জের শব্দের অর্থ হলো নিচে আর বার শব্দের অর্থ হলো বোঝা। অর্থাৎ জের ওয়াবার বাগধারার আক্ষরিক অর্থ হলো বোঝার নিচে চাপা পড়া। সুতরাং পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, যে ব্যক্তি বোঝার নিচে পতিত হয়েছেন তিনি আলংকারিক অর্থে কতটা বিপন্ন, বিধ্বস্ত এবং পর্যুদস্ত হতে পারেন।
‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ থেকে জানা যায় জেরবার শব্দটি প্রথম বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে ১৮৭৩ সালে ‘হেনস্থা’ অর্থে। ১৯১৯ সালে ‘হয়রান’ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন প্রমথ চৌধুরী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় জেরবার শব্দটি ‘পর্যুদস্ত’ বা ‘লাঞ্ছিত’ অর্থে পাই ১৯২২ সালে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে জেরবার শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে ঋণগ্রস্ত এবং নিপীড়িত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে জেরবার শব্দটির ব্যবহার করেছেন এভাবে, ‘এক ধারে একটিমাত্র নিমগাছ, তার গুঁড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে।’ জেরবার শব্দটি কবিগুরু তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যযাপনে এই একবারই লিখিতরূপে ব্যবহার করেছেন।
জেরবার শব্দটি প্রকৃত অর্থেই গণমানুষের অন্তরের শব্দ; গ্রামীণ জনপদের সহজ-সরল নিপীড়িত মানুষের অকপট ভাষ্য। কেননা শব্দটি ধ্বনিত হয় যাপিত জীবন থেকে উৎসারিত ক্ষোভ থেকে। আর এই ক্ষোভের কারণ শাসক কর্তৃক শোষিতের ওপর নিষ্পেষণ। কারও কারও মহাজনের দেনার দায়ে নিষ্পেষিত হতে হতে জীবন জেরবার আবার কেউ কেউ মামলা-মোকদ্দমার বেড়াজালে জেরবার। শব্দটি যেন নিষ্পেষিত গণমানুষের একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
রাজীব কুমার সাহা, আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে...
১৭ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি একটি অনন্য মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য যে পথ রচনা করে দিয়েছে, সেই পথই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে সেই পথকে করেছে মসৃণ...
১৭ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা বাধা দেখা যাচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
১৭ ঘণ্টা আগেআজ থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা শুরু হচ্ছে। মাসব্যাপী এই আয়োজন প্রাণের মেলায় পরিণত হোক, সেই কামনা করি। তবে আজ বইমেলা নিয়ে নয়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে যে নাটক অভিনীত হলো, তা নিয়েই কিছু কথা বলা সংগত হবে।
১৭ ঘণ্টা আগে